★
বীথির ইনবক্সে পিং করল অচেনা একটা নাম। – একটু কথা বলা যাবে আপনার সঙ্গে? ফোন নাম্বারটা যদি দেন!
– আপনি, মানে ঠিক চিনলাম না তো!
– ও হো, সেটাই বলা হয়নি তো! আমি হচ্ছি “সুন্দরের জয়” বলে যে সাহিত্য গ্রুপ তার অ্যাডমিন।
– ও, ওই যে, যে গ্রুপটা “সোশ্যাল মিডিয়ার আলাপ-বিলাপ” বলে একটা ইভেন্টের জন্য লেখা চেয়েছে, সেইটা, না?
– হ্যাঁ, সেটাই। ফোন নাম্বারটা দেবেন?
প্রত্যাশিত ফোনটা এল একটু বাদেই। – আমি কর্ণ সিদ্ধান্ত। ওই যে সুন্দরের জয়…
– হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন স্যার!
স্যারটি কুলকুল করে হাসেন, – স্যার? স্যার আবার কী। সাহিত্যের জগতে বয়সে বড়রা সবাই দাদা আর দিদি। কর্ণদা’ বলে ডাকবেন আমায়।
এই সুন্দরের জয় গ্রুপটা ফেসবুকে খুব নামকরা গ্রুপ। দশ হাজারের ওপর মেম্বার। এ’খানে তো বটেই, বিদেশেও প্রচুর মেম্বার। ছাপা পত্রিকাও বের করেন এঁরা। একটা পয়লা বৈশাখে, অন্যটা শারদীয়া। এবং মেম্বারেরা প্রায় সবাইই বই কেনেন বলে সার্কুলেশনও দেশ আনন্দবাজারের চেয়ে কম নয়। এমন গ্রুপের অ্যাডমিন ফোন করলে তার গুরুত্ব দেশ আনন্দবাজারের সম্পাদকের ফোন করার মতনই। এমন সৌভাগ্যে উচ্ছ্বসিত হয় বীথি।
– শুনুন বীথি, যে জন্য আপনাকে ফোন করা। আমাদের ইভেন্টে মোট দু’টো করে গল্প দেওয়ার কথা। আপনি একটা দিয়েছেন। সেখানে যে গল্পটা বলেছেন, ছোটোবেলায় হারানো বন্ধুকে খোঁজার গল্প, বেশ ভালো সেটা। আমাদের ভালো লেগেছে। কিন্তু কী জানেন…
বাধা দেয় বীথি, – কর্ণদা, আমাকে আপনি তুমি করে বলুন।
– হ্যাঁ, যা বলছিলাম। ওঃ হো সরি, বিদেশ থেকে একটা কল এসেছে। একটু দাঁড়াও। কথা বলে নিই।
বীথি উন্মুখ অপেক্ষা করে।
কিছুক্ষণ পরেই ফোন বাজে আবারও, – যে’টা বলছিলাম। তোমার একটা লেখা দিয়েছ। আর একটাও দেবে নিশ্চয়ই। তোমার অন্যান্য লেখা, ফেসবুকে যা দাও পড়ি। শক্তিশালী কলম তোমার। প্রচুর পোটেনশিয়াল।
বীথির ভেতরটা উত্তেজনায় টগবগ করে। তার সবে শুরু করা লেখক জীবনে এই স্বীকৃতি নোবেল প্রাইজের মত না হোক বুকার বা জ্ঞানপীঠ বলে বোধ হতে থাকে তার। ফোন ধরা হাতের তালু ঘেমে ওঠে।
ওপাশে কর্ণ সিদ্ধান্ত, “কিন্তু আমি তোমাকে দুটো আইডিয়া দেব, যেটা আমাদের এই ইভেন্টের জন্য এক্কেবারে অ্যাপট্। ধরো প্রথমটা হচ্ছে একজন ফেসবুক করা ডাক্তার, বয়স, তা ধরো বাষট্টি কিম্বা পঁয়ষট্টিও হতে পারে, একটা বাইশ বছরের মেয়ের ফ্রেন্ডলিস্টে আছেন। ডাক্তার বাংলা লেখেন ভালো। মাঝে মধ্যে গানও আপলোড করেন। নিজের আঁকা ছবিও। মাল্টিট্যালেন্টেড যাকে বলে। সেই বাইশ বছরের মেয়ের সঙ্গে তাঁর মেসেঞ্জারে আলাপ হয়। ডাক্তার জেনে মেয়েটা হয় তো দু একটা নিজস্ব সমস্যার কথা বলে। ডাক্তার সে’গুলোর সমাধান বলেন। কিম্বা হয়তো এইসব হয়ই না। মোটমাট দু’জনের মধ্যে বেশ নিবিড় একটা আলাপ জমে ওঠে, দুজনের কথা বিনিময় চলে ইনবক্সে, ইনবক্স ছাপিয়ে হোয়াটসঅ্যাপেও। এবং তখন, এই খানেই ক্লাইম্যাক্স বুঝলে তো। ডাক্তারটি সেই মেয়েকে, তোমাকে ডিটেইলস বলছি না, সেই সব ছবি তুলে পাঠাতে বলে যে গুলি একান্ত ভাবে উত্তেজক। আর প্রস্তাবও দিতে থাকে সেই রকম। সেই রকম ভাষায় শরীরের নানা অঙ্গে আদরটাদর করার কথা, বুঝলে তো। তখন ওই ইনবক্সেই যুবতীর রিঅ্যাকশন। সে কখনও সাবমিট করে। শিথিলবসন খোলামেলা সেলফি বিনিময়, কখনও বা সাবঅল্টার্ন ভাষায় আদর বিনিময় মানে ওই ইংরেজিতে যাকে বলে সেক্স চ্যাট, বুঝলে না।”
একটু বিরতি নেন কর্ণ। বীথি চুপ। শুনছে।
– “হ্যালো বীথি, লাইনে আছো তো? আজকাল যা হয়েছে, যখন তখন কল ড্রপ। এবার সেকেন্ড থিমটা। দুই কিশোর কিশোরীর কথোপকথন। হতে হতে প্রেম। তারপরে কিশোরী মেয়েটির প্রাইভেট জিনিস, কথা আর ছবি শেয়ার। এই খানে একটু ইন্টিমেট বর্ণনা। অতঃপর ব্লক খাওয়া। এর পরে ব্ল্যাক মেইল। ছবি ছড়িয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে বুঝলে তো একটু থ্রিলার টাইপ। মেয়েটার ডিপ্রেশন। সেখানে একটু মনস্তাত্ত্বিক টাচ। বুঝলে তো।
মানে দু’টো থিমেই ইনবক্সের আলাপ দিয়ে শুরু করে শরীর পৌঁছোনো, বুঝলে তো বীথি। ওই বুক ক্লিভেজ এইসব। তোমার কলমের যা জোর, তুমি পারবে!”
মানুষটির কথায় কথায় বুঝলে তো বলার ঝোঁক। কিন্তু উনি বুঝলেন না, বুঝতেই পারলেন না, বীথি ধরে ফেলেছে আসলেই উনি এই থিম-প্রস্তাবে নিজেরই অবদমিত ইচ্ছেগুলোকে নগ্ন করে ফেলেছেন।
নইলে প্রথম ফোনেই, আর প্রথমই বা কেন, কোনও ফোনেই কি লেখক হতে চাওয়া একজন মেয়েকে ঠিক এই কথাগুলো বলা যায়?
উনি এ’টাও বুঝলেন না ওঁর গ্রুপের জন্যেই বীথি প্রায় শেষ করে এনেছিল একটা আলো মাখা গল্প, যেখানে এই ইনবক্সে আলাপ দিয়ে শুরু করে এই যুগের এক প্রমিথিউস আগুন বানানোর মন্ত্র শেখাচ্ছে একজনকে, পরিচয়ে যে মেয়ে নয়, পুরুষও নয়, অগ্নিশুদ্ধ হতে চাওয়া যে এক মানুষই শুধু।
অপূর্ব সেই গল্পটা কর্ণকে চিনতে পেরে মুখ লুকোল।
না, বীথি এই গ্রুপে লিখবে না।