পশ্চিমবঙ্গ সরকার পয়লা জুলাই ছুটি ঘোষণা করেছেন। ছুটি দিয়ে নাকি চিকিৎসকদের সম্মান জানানো হবে। এই উদ্যোগ স্বভাবতই চিকিৎসকদের বৃহৎ অংশের কাছে বস্তুত পক্ষে খুব হাস্যকর ঠেকেছে। ছুটি বস্তুটি বেশিরভাগ চিকিৎসকের ধরাছোঁয়ার বাইরে। রাজ্যের মোট চিকিৎসকের মাত্র এক তৃতীয়াংশ সরকারী ব্যবস্থার সঙ্গী। সরকারী চিকিৎসকদের ছুটিও আমলা নির্ভর। তাই ছুটি সম্মান জানানোর কোন পদ্ধতি হতে পারে না। সরকার চিকিৎসকদের সম্মান জানানোর কথা ভেবেছে এর জন্য তাঁদের ধন্যবাদ প্রাপ্য কিন্তু যে পথ ও পদ্ধতি তাঁরা ভেবেছেন তার কোন ব্যবহারিক মূল্য নেই।
সারা দেশে তো বটেই, আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার একদা অগ্রণী পিঠস্থান এই রাজ্যেও চিকিৎসকদের মূল চাহিদা এই সরকার বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। চিকিৎসকদের একমাত্র মুখপাত্র এক সময় ভাবা হতো আই এম এ কে। সেই সর্বমান্য প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে দিগভ্রান্ত পথিকের মতো দিশেহারা হয়ে রাজনীতির কারিগর হয়ে উঠেছে। তার,জায়গা দখল করেছে WBDF। এই সংগঠন তার জন্মলগ্ন থেকে এই কথা বলে এসেছে যে, চিকিৎসকদের সম্মানিত করার,সবচেয়ে ভালো উপায় হল তাঁদের নায্য দাবিদাওয়ার প্রতি নজর দেওয়া।
চিকিৎসকদের দুরকম দাবী ছিল- একটি তাঁদের সুরক্ষার দাবী, আরেকটি স্বাস্থ্যের অধিকারের রাজনৈতিক স্বীকৃতি।
2017 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কর্পোরেট হাসপাতালগুলোকে শায়েস্তা করার নাম করে এই রাজ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের ক্ষোভ ও উষ্মার বর্শামুখ চিকিৎসকদের দিকে তাক করা হয়েছিল। তার অবশ্যম্ভাবী ফল হয়েছিল একের পর এক চিকিৎসকের উপর হামলা। 2017-2020 এই তিন বছরের সময়কালে প্রায় 300 জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। 70 বছরের অতিবৃদ্ধ চিকিৎসককে পাথর দিয়ে মাথা ফাটানো হয়েছে, সপরিবারে বৃদ্ধ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নিজের বাড়ীতে আক্রান্ত হয়েছেন। গ্রামে চিকিৎসকদের দলবদ্ধ হয়ে মারা হয়েছে। এই সব ঘটনা ঘটেছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। প্রায় সর্বক্ষেত্রে শাসকদলের নেতারা এর সাথে জড়িত ছিলেন। নামকরা কর্পোরেট হাসপাতালে পুলিশ কর্মী দ্বারা চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। এই সংক্রান্ত বিস্তৃত রিপোর্ট স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর হাতে জমা দেওয়া হয়েছে। সেখানে এফ আই আরের কপি থেকে আক্রমণকারীদের নাম ও ছবি অবধি জমা দেওয়া হয়েছে। প্রশাসন একজনকেও গ্রেপ্তার করে নি, একজন নেতার বিরুদ্ধে দল কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় নি।
কর্পোরেট হাসপাতালকে শায়েস্তা করার নামে WBCEA 2017 চালু করা হল। এই ব্যবস্থায়ও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলেন চিকিৎসকরা। কর্পোরেট পুঁজি যারা বিনিয়োগ করেছে তাদের বদলে সেই হাসপাতালে চাকুরিরত চিকিৎসকদের দায়ী করার প্রক্রিয়া শুরু হল। মানুষের ক্ষোভ বেশি অর্থ ব্যয়ের বিরুদ্ধে অথচ সেই বিলে সেই ক্ষোভ প্রশমনের কোন ব্যবস্থা নেই, তার দায় চাপিয়ে দেওয়া হল চিকিৎসকদের উপরে। সব চেয়ে ক্ষতি হল সিঙ্গল চেম্বার এস্টাব্লিশমেন্টগুলোর। উল্টো দিকে CERC-র মাধ্যমে কর্পোরেট হাসপাতালগুলোর বিচার ব্যবস্থা থাকলেও তার এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে তাকে চিকিৎসক হেনস্থার একটি অস্ত্র বানিয়ে ফেলা হল। একই ভাবে মেডিকেল কাউন্সিলকে রাজনৈতিক অস্ত্র বানিয়ে চিকিৎসকদের শায়েস্তা করা শুরু হল।
আমরা মনে করি যে, চিকিৎসা ও সামগ্রিক ভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে মানুষের ক্ষোভের মূল কারণ হল সব মানুষের জন্য একটি অভিন্ন সমমানের আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার অভাব। মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকার না থাকলে আশু ক্ষোভের জ্বালামুখ চিকিৎসকের দিকে ধাবিত হবে কারণ চিকিৎসা ব্যবস্থার শীর্ষে থাকার জন্য আঙ্কিক নিয়মে তাঁদেরকে অনাদিকাল ধরে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। অথচ, উপযুক্ত পরিকাঠামো না থাকলে চিকিৎসক যে কত অসহায় সেটা বোঝার মত মননশীলতা সমাজের নেই, সরকারের নেই, উপভোক্তাদের ও তো নেইই।
শ্রীনাথ রেড্ডি কমিটি বলেছিল যে যদি পরিকাঠামো উন্নত করতে হয় তাহলে জিডিপির 2.5% খরচ করতে হবে। তাহলে নিজের পকেট থেকে উপভোক্তার খরচ কমে 35% হবে। বর্তমানে চিকিৎসা ব্যয়ের সবচেয়ে বেশি 70-80% মানুষ তার নিজের পকেট থেকে খরচ করে, অনেক সময় নিজের সর্বস্ব ব্যয় করে সে খরচ মেটায়। এর ফলে সে ঋণের জালে পড়ে ও রোগীদের শতকরা 5% দারিদ্রসীমার নীচে চলে যেতে বাধ্য হয়। এর পরিবর্ত ব্যবস্থা হিসেবে ইন্সুরেন্সের একটা ব্যবস্থা হয়েছে। ইন্সুরেন্স যে সরকারের টাকা বুড়ি ছুঁয়ে আসলে বৃহত পুঁজির কাছে স্থানান্তরিত হয় সে বিষয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ প্রমাণ দিয়েছেন।
কোভিড 19 চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কেন সরকারের নিজস্ব পরিকাঠামো দরকার, কেন সরকারী ব্যবস্থার বিকল্প বেসরকারি ব্যবস্থা নয়!
সরকারী ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য যে যৎসামান্য অর্থ ব্যয় করা দরকার তার চেয়ে বেশি সরকার বৃহৎ পুঁজির জন্য নানারকম ছাড় দেন, ট্যাক্স মকুব করেন বা অনেক সময় তাদের ঋণ মুছে দেন। আরেকটি, কথা সেস আদায় করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি হয় না। সেসের অর্থের যে যথাযথ ব্যবহার হয়না তা এমনকি সরকারও স্বীকার করেছে। তেলের বর্ধিত ট্যাক্স বাবদ সরকার এক বছরে প্রায় 6 লক্ষ কোটি টাকা আয় করেছে তা জিডিপির প্রায় 2.5%। সরকারের টাকা নেই এই যুক্তি তাই মানা যায় না। রাজ্য সরকারের SGDP র 2.5% খরচ করতে হলে বাজেট হওয়া উচিত ছিল বর্তমান খরচের চারগুণ।
চিকিৎসক দিবসে সরকার দ্বারা চিকিৎসকদের সম্মান জানানোর প্রতি পূর্ণ মর্যাদা দিয়েও বলতে চাই যে সম্মান জানানোর সহজতম রাস্তায় না হেঁটে সরকারের উচিত চিকিৎসকদের দাবিদাওয়ার প্রতি মনোযোগী হওয়া। রাজনীতি তার জায়গায় থাকুক, কিন্তু দেশে ভবিষ্যতের চিকিৎসক ও সব নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের কর্তব্য সঠিক পালন করতে পারলেই চিকিৎসকরা সম্মানিত বোধ করবেন। তখনো তাঁদের ছুটি মিলবে না তবে তাঁরা অন্ততঃ বুকে বল পাবেন যে সমাজ তাঁদের সাথে আছে।