আপনি হয়তো জানেন না যে গত বেশ কিছুদিন ধরেই কলকাতা মেডিকেল কলেজের জুনিয়র ডাক্তারেরা আন্দোলন করছে আপনার স্বাস্থ্যের অধিকার নিয়ে। হ্যাঁ ঠিকই শুনলেন।
আপনি, আপনার পরিবারের চিকিৎসার অধিকারের জন্য৷ গত ৭ই মে থেকে কলকাতা মেডিকেল কলেজের জুনিয়র ডাক্তারেরা অসম্ভব দক্ষতার সাথে সামলে আসছেন লেভেল 4 করোনা রোগীদের। একাধিক বার খবরের কাগজের হেডলাইনে এসেছে কত জন রোগীকে এখানকার চিকিৎসকেরা সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়েছেন। প্রাথমিক ভাবে পিপিই, সুরক্ষা সরঞ্জাম সংক্রান্ত যে অসুবিধা ছিল তা ক্রমাগত আন্দোলনের ফলে এক প্রস্থ মিটেছে, কিন্তু প্রচারের আলোর নীচের অন্ধকারটা টের পাওয়া যাচ্ছে একটু খেয়াল করলেই। কোভিড-অনলি করে দেওয়ার ফলে মেডিকেল কলেজের যে অংশে করোনা চিকিৎসা হচ্ছে বাকি অংশগুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে, তালাবন্ধ মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা করাতে এসে হয়রান হচ্ছেন হাজার হাজার রোগী। তাই কোভিড চিকিৎসার পাশাপাশি করোনা নেই, এমন রোগীদেরও চিকিৎসা করতে চেয়ে, রোগীস্বার্থে আন্দোলন শুরু করেছে মেডিকেল কলেজের জুনিয়র ডাক্তারেরা।
কোভিড অতিমারী আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা কোথায়, সরকারি হাসপাতাল গুলো কেন জরুরি, ‘বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে’ এই কুযুক্তি আসলে কতটা ভ্রান্ত এবং সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে উন্নত করা ছাড়া যে কোনো রকম স্বাস্থ্য সঙ্কটের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে না তা অত্যন্ত স্পষ্ট। স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে এ জন্য। জনস্বাস্থ্যের উপর জোর দিতে হবে। কমিউনিটি স্তরে প্রিভেনটিভ মেডিসিনের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, ইতিমধ্যে রয়েছে এমন পরিকাঠামোকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি প্যানডেমিকের মোকাবিলায় নতুন পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, করোনার মোকাবিলায় যে মডেলটা বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে তা আসলে বহু ত্রুটিযুক্ত। আমাদের, বুঝে নিতে হবে করোনা কেবল তিন-চার মাসের বিষয় নয়, এ আমাদের সাথেই থাকবে, হতে পারে সেটা কয়েক বছর। ফলে করোনা মোকাবিলায় যে পরিকল্পনাই আমরা করব সেটা এমন ভাবে হতে হবে যেখানে সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে যাতে যথাযথ প্রোটোকল মেনে কোভিড চিকিৎসাও চলে এবং তার পাশাপাশি অন্যান্য বহু জটিল রোগের চিকিৎসাও সমানতালে চলে। একটিকে বাড়তি গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্যটাকে অবহেলা করলেই সমস্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা জাস্ট ধসে পড়বে।
কয়েকটা উদাহরণ দিই, মনে করুন আপনার হঠাৎ বুকে ব্যথা, কার্ডিয়াক এরেস্ট অথবা হঠাৎ এক্সিডেন্টে আপনার পরিবারের কেউ আহত।
আপনি কোথায় ছুটবেন? কলকাতা মেডিকেল কলেজ কিন্তু আপনার জন্য বন্ধ। কেমো বা রেডিয়েশন পাওয়া ক্যান্সার রোগী হোন, বা নিয়মিত রক্ত দিতে হয় এমন থ্যালাসেমিয়া পেশেন্ট, দুমাস আগে ডেট পাওয়া জটিল কার্ডিওথোরাসিক অপারেশন হোক বা সিটি স্ক্যান, এম আর আই এর মত পরীক্ষা যার ডেট ছিল এর মাঝেই… সবার জন্য কিন্তু নো এন্ট্রি! যদি একমাত্র আপনার করোনার উপসর্গ থাকে তাহলেই তার চিকিৎসা পাবেন। এ তো গেল কেবল আপনার একার কথা, মেডিকেল কলেজ এর মত টার্সিয়ারি হাসপাতালে কত সংখ্যক মানুষ চিকিৎসা পান সেই হিসেবটা দিলে হয়তো স্পষ্ট হবে কত রোগী আসলে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
একটাই হিসেব দিচ্ছি, (এরকম অন্তত বিভিন্ন বিভাগের একশোটা আলাদা তথ্য রয়েছে) গত জানুয়ারি মাসে( কোভিড ১৯-এর আগে) সার্জারি বিভাগে মেজর ও মাইনর কেস মিলিয়ে মোট অপারেশন এর সংখ্যা ১৩১৬ টি এবং অর্থোপেডিক বিভাগে সংখ্যাটা প্রায় ২৯০। কোভিড অনলি করে দেওয়ার ফলে গত তিনমাসে অপারেশনের সংখ্যা কত জানেন? সংখ্যাটা ২!!!
কি হচ্ছে তাহলে এত রোগীর যাদের অপারেশন হওয়ার কথা ছিল? যাদের ইমার্জেন্সি তারা হয় বেসরকারিতে বহু টাকা খরচ করে করতে বাধ্য হচ্ছেন আর যাদের ক্ষমতা নেই তারা অসহায়ের মতো ঘুরছেন, ফোন করছেন জুনিয়র ডাক্তারদের, বিফল মনোরথ হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে বসে আছেন। একই কথা প্রযোজ্য ক্যান্সাররোগী দের ক্ষেত্রে। কয়েকটা সাইকেল কেমো বা রেডিয়েশন পেয়ে যারা সুস্থ হচ্ছিলেন খানিক চিকিৎসা বন্ধ থাকায় মৃত্যুপথযাত্রী আজকে, অনেকে মারাও গেছেন।
বহু সুপারস্পেশালিটি বিভাগ যেখানে দেখাতে গোটা রাজ্য থেকে রোগীরা আসতেন ও প্রায় বিনামূল্যে চিকিৎসা পেতেন সেগুলোর আর অস্তিত্বই নেই। এর পর আপনি গ্যাস্ট্রো বা নিউরো বা এন্ডোক্রিন যদি দেখাতে চান তাহলে জেনে রাখুন এই বিভাগগুলো জাস্ট নেই হয়ে রয়েছে। এবং সেটা অনির্দিষ্টকালের জন্য। এভাবে একটা টার্সিয়ারি সরকারি হাসপাতালকে জাস্ট পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি জুনিয়র ডাক্তারদের একটা বড় অংশকে, তারা চিকিৎসা করতে চাওয়া সত্বেও যথাযথ ভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না। তারা দাবি জানাচ্ছেন যে তাদের বানানো প্ল্যান অফ একশন অনুযায়ী চললে খুব ভালো ভাবে কোভিড তো বটেই বাকি রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সরকার বোধ হয় কোভিড স্ট্যাটিটিক্সের কুমীরছানা দেখিয়ে পপুলিস্ট রাজনৈতিক স্টান্ট খেলতে চাইছে। নাহলে অতি সহজে বোঝা সম্ভব যে জুনিয়র ডাক্তারেরা যে দাবিদাওয়া করছেন তা কতটা যুক্তিযুক্ত আর সাধারণ মানুষ যাদের সরকারি হাসপাতাল ছাড়া গতি নেই তাদের কতটা ক্ষতি হচ্ছে এহেন অবিবেচক অনড় মনোভাবে।
শেষত, আরও একটা কথা না বললে নয়, মেডিকেল কলেজ একটা টিচিং হসপিটাল। যেখানে তিনটে শিক্ষাবর্ষ মিলিয়ে প্রায় ৯০০ জুনিয়র ডাক্তার ও চারটি শিক্ষাবর্ষ মিলিয়ে ১০০০ আন্ডারগ্রাজুয়েট ছাত্রছাত্রী রয়েছে৷ এই গোটা হাসপাতালে হাজার হাজার রোগীদের চিকিৎসা করার সাথেই চলে তাদের পড়াশোনা, ক্লিনিক্যাল ট্রেনিং, গবেষণা। এই সব কাজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া মানে এই হাসপাতালে যে চিকিৎসকেরা চিকিৎসা দিতেন, গবেষণা করতেন তাদের কে যথাযথ ভাবে ব্যবহার না করা যা আসলে ক্ষতি করছে এবং করবে সাধারণ রোগীদেরই।
এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সমাধান হতে পারে একটাই, গোটা মডেলটাকে পরিকল্পনা মাফিক সাজানো। কোভিড ডেডিকেটেড অংশ থাকুক সব হাসপাতালেই। সাথে চলুক করোনা নয়, এমন রোগীদের চিকিৎসা। করোনা মোকাবিলায় আমাদের ডিসেন্ট্রালাইজড হতেই হবে। তাতে অতিরিক্ত সংক্রমণ এর সম্ভাবনা যেমন দূর হবে তেমনই ‘Equitable Distribution’ হবে সমস্ত রোগীদের চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রেই।
এর সাথে কোভিড-ডেডিকেটেড হাসপাতাল বানাতে হবে কোনো টার্সিয়ারি সরকারি হাসপাতালকে পঙ্গু না করে। নতুন পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে, প্রয়োজনে সুপার স্পেশালিটি বিল্ডিং গুলোকে এর জন্য তৈরি করতে হবে, বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে অধিগ্রহণ করতে হবে, রেফারেল ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে, কোভিড বিভাগ ও নন কোভিড বিভাগ ভাগ করে যথাযথ সুরক্ষাবিধি মেনে সমস্ত রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা দিতে হবে।
আগামীকাল চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্মানার্থে ছুটি ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। এদিকে কাল থেকেই কোভিডের পাশাপাশি করোনা নয় এমন সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার অধিকারের দাবিতে প্রতিবাদে বসতে চলেছে জুনিয়র ডাক্তারেরা। বহুবার কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে ডি এম ই, এমন কি স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর সাথে কথা বলেও অচলাবস্থা কাটে নি কোনোভাবেই। ফলে জুনিয়র ডাক্তারেরা ঠিক করেছেন তারা যেমন কোভিড রোগীদের চিকিৎসা করছিলেন তেমন চালিয়ে যাবেন, সাথে নন কোভিড রোগীদের চিকিৎসার দাবিতে প্রতিবাদ ও চালিয়ে যাবেন।
#UnlockMCK
#InclusiveNotExclusive
#DoctorsForPeople
‘সহ নাগরিকদের প্রতি’ – প্রতিবেদনটি খুব জরুরি সময়োপযোগী লেখা। খুবই লজ্জিত এই খবরটি জানা ছিল না বলে। প্রতিটি দাবির সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত। আপনাদের/জুনিয়র ডাঃ দের পূর্ববর্তী আন্দোলনগুলোর পাশে সবসময়ই দাঁড়িয়েছি। এক্ষেত্রেও অবশ্যই তার ব্যতিক্রম হবে না।একটাই জানার ব্যাপার,এই অতিমারীর সময়ে ওরা কি পদ্ধতিতে আন্দোলন করছে?
প্রতিবেদন টি সময়োগযোগী লেখা – ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধা জানাই আপনাদের ।
Doctor’s Day
Salute
Great
সব রুগীর চিকিৎসা হওয়া একান্ত দরকার। আমি একজন সাধারণ নাগরিক আপনাদের দাবিকে সমর্থন জানাচ্ছি। অনেক সময় সরকারও ভুল করে, তাই সরকারের কাছে আবেদন এই ব্যাপারটা একটু বিবেচনা করুন।