আজ সকালের সপ্তম রোগিনী ঘরে প্রবেশ করলেন। সাদা থান। ঈষৎ ময়লা, তেল হলুদের ছোপ। তুলসী কাঠের কন্ঠি পরেছেন। কপালে তিলককাঠি দিয়ে আঁকা চন্দন ফোঁটা। গলার কোটরেও এক বিন্দু চন্দন। চন্দনগন্ধী হলে কি হবে –বড় অস্থির। এসেই বলেন –লিখ লিখ, আমার নাম লিখ, মালতীবালা দাসী (পরিবর্তিত)।
লিখলাম। বয়স?
— তা ধর গিয়া ষাট সত্তর তো হইব।
— ষাট আর সত্তরের মাঝে যে দশটা বছর দিদি।
— ওই একই হইল গিয়া। আমারে তুমি বাঁচাও দেহি ডাক্তার। কি কষ্ট কি কষ্ট -মইরা গেলাম।
আমি বলি– হয়েছেটা কি?
–পুকা মাগো পুকা –সব্বাঙ্গে পুকা।
এসব সময়ে চুপ করে পেশেন্টের কথা শুনতে হয়। তাকে বলার স্পেস দিতে হয়।
–সারা দিনমান না হয় কাজে কম্মে থাকি, রাতে যে পুকার জ্বালায় একটু শুইতে পারি না মাগো। কি কামড় দেয়– সব্বাঙ্গে কট কট কইরা কামড়ায়।
এবার রোগটা একটু একটু বুঝতে পারছি। জিজ্ঞাসা করলাম–দেখতে পান পোকা গুলো?
— হঃ, পাইনা আবার। পট পট কইরা মারি সারারাত। চামের উপর হাঁটে, মাথায় হাঁটে– পুকা গুলান আমার জীবন অত্তিষ্ঠ কইরা দিল মাগো। আমারে বাঁচাও। এই দেখ এইখানে– বলে হাতের এক জায়গা চিমটিয়ে চামড়া তুলে দেখালেন মালতীবালা।
সব রকম আলো আতসকাঁচ দিয়ে দেখে বললাম– আপনার শরীরে কোথাও কোন পোকা কিন্তু নেই। এর পরের উত্তর যদিও জানা আছে।
ঠিক যা ভেবেছি, তাই। আঁচলের গিঁট খুলে একটা ছোট গয়নার কৌটো বের করলেন, তার মধ্যে সাদা কাগজের পুরিয়া– বেশ রেগে বললেন– কি কও? পুকা নাই? হেই গুলা তয় কি? এত্ত গুলা পুকা সব আমার শরীর থিক্যা ধরছি। পুরিয়ার মধ্যে ক্ষুদি ক্ষুদি কালো কালো গুটলি পাকানো কিসব। জানি, এ রোগে যতই বোঝাই না কেন এগুলো পোকা নয়, পোকা হলেও আপনার শরীরের নয় ওনাকে কিছুতেই কনভিন্স করা যাবে না।
একটু গল্প শুরু করি। — সারাদিন কি করেন আপনি?
— তিন বাড়ি রান্নার কাজ করি মাগো– নইলে কি আর পেট চলে?
— সেকি! এই বয়সে তিন বাড়ি রাঁধেন? বাড়িতে কেউ নেই?
বলেন– নাহ– ওসব কথা ছাড়ান দাও। তুমি আমার দেহের পুকাগুলা মারার ওষুধ দাও দেহি
— আচ্ছা সে দেব, বসুন। আপনার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই?
— তা ধর গিয়া নাই।
— ছেলেপুলে কজনা?
–একটাই ছাওয়াল মাগো। একটা মাইয়া। উফ– দেখতিছ, আবার কামড় দিল। বলে, মাথা থেকে একটু মরা চামড়া তুলে আনলেন।
— ছেলে কোথায় থাকে?
— কুথায় আবার? বউয়ের লগে থাকে। আইজকালকার বেপার বুঝ না মাগো। কত্তা যাবার পর লোকের বাড়ি খাইট্যা পড়ালিখা শিখাইলাম ছেলেরে, বিয়া দিলাম, এট্টু আরাম করার শখ আছিল –তা ছেলে এখন বিডিও অফিসে সরকারি চাকরি করে, ভেন্ন শহরে থাকে, মনেও ভেন্ন হইয়া গেছে আমার থিকা। ওসব কথা ছাড়ান দাও। গুরুদেব কন– যার জইন্য যেমন পথ ঠাকুর ঠিক কইরা রাখছেন তা মাইন্যা লইতে হইব। তুমি আমার পুকা মারতে পারবে কিনা কও ।
— আপনার মেয়ে কোথায় থাকে?
— সেও বড় অভাবে মাগো, তবু সুখে শ্বশুরঘরে আছে, গুরুদেব কন– কন্যা সম্পোদানের পর আর ফিরা তাকাইতে নাই। তারে আমার লগে জড়াইও না। তুমি আমার পুকা মারার বেবস্তা কর। আচ্ছা কও দিন এত পুকা আসে কোথা থেকে?
— সে বড় কঠিন পোশ্ন দিদি, পোকারা আসে কোথা থেকে। মনে মনে বলি। মুখে বলি, — একটু অবসর পেলে কি করেন? মানে হাতে কোনো কাজ নেই এমন সময়ে?
— ও চান্দ আমার, তেমন কি আর কপাল আমার। তিন বাড়ির রান্না, আপনের লইগ্যা রান্না, ঘরের কাজ। মাজায় ব্যথা লইয়াই সব কাজ কাম করি। বড় কষ্ট চান্দ। সব সইতে পারি শুদু পুকা গুলা যদি না কামড়ায়। কিছু কি করন যায় না? কোনো ওষুদ নাই তোমাদের?
আছে। এসব পোকাদের টুসকি মেরে ফেলে দেবার কায়দাটা শিখতে হবে আপনাকে। বলি– কোথাও একটু বেড়িয়ে আসুন না কদিন, ঠাঁইনাড়া হলে অনেক সময় পোকারা মরে যায়।
— অ চান্দ, যমের দুয়ার ছাড়া আর কনে যাব বল দেহি। এক মথুরা বেন্দাবনটা দেখার সাধ ছিল– ছাওয়াল ছোটকালে বলত বড় হইলে লইয়া যাইব। তা আর কই হইল চান্দ। এক রান্নাবাড়ির বৌদির কাছে টাকা জমাই, বৌদি বলসে সামনের বসর নবদ্বীপ লইয়া যাইব।
বড় মুশকিলে ফেললেন দেখছি মালতীবালা।
প্রেসক্রিপশনের বাঁ দিকে খসখস করে রোগের নামটা লিখলাম, ডানদিকে কিছু ওষুধ। নিয়মমাফিক মনের কলকব্জা মেরামতির ডাক্তারের কাছেও রেফার করতে হল। ডাক্তারি ভাষায় একে বলে Delusional Parasitosis. অর্থাৎ শরীরে সত্যি পোকার অস্তিত্ব কিছু নেই, অথচ রোগী ‘শরীরে পোকা হাঁটছে কামড়াচ্ছে ‘ এই ভ্রমে বড় কষ্ট পায়। এই কষ্টের অনুভূতির নাম ‘Formication’, সাধারণত এইসব রোগীর একটা লুকোনো অবসাদ থাকে। নিজের কষ্টের সত্যতা বোঝাতে এই রোগীরা ছোট ছোট মরা চামড়া, কখনো কুড়িয়ে পাওয়া মরা পোকা বা মেঝে দেয়াল থেকে পোকা মেরে জমিয়ে রেখে, তুলে আনে যত্ন করে। মালতীবালা দিদি যেমন গয়নার বাক্সে কাগজের পুরিয়া খুলে দেখালেন আমাকে। বিদেশে দেশলাই বাক্সে ভরে পোকার নমুনা আনত, তাই এই লক্ষণকে ডাক্তারি বইতে বলে ‘Match box sign’।
মালতীবালা আঁচলের গিঁট খুলে ভিজিটের টাকা বের করতে লাগল। সহকারিনীকে ডেকে বললাম– ফ্রি করে দাও। অমনি ঝাঁপিয়ে পড়ল– দেখো চান্দ এটা আমি দিব। গুরুদেব কন–জীবনে ল্যায্য পাওনা সবসময় বুইঝ্যা লইবে। তোমারেও তাই কই।
আমি বলি– আপনার পোকাদের যদি মারতে পারি তখন নেব–এখনো তো ওরা মরে নি।
মালতীবালা মিদু হেসে বললেন– ও চান্দ, অনেক ডাক্তার দেখাইসি। আমি জানি, ওসব পুকাগুলান আমার এ জীবনে মরব না, যতদিন বাঁচব পুকারা আমার চাম, হাড়মাস সব খাবে। তুমি যে আমার লগে এত কথা কইলে, এত ভাবলে– চেষ্টাও করতিছ পুকা মারার– ভিজিটটা তার লগে।
তারপর ফিসফিস করে বললেন– শুনো চান্দ, শরীলে দু’চারটে পুকা থাকা ভাল– অন্য কামড়গুলা তেমন বিঁধে না। আবার একটু জোরে– তয় এত পুকা লইয়া আর পারিনা, দেহি তোমার ওষুধে কি হয়।
মালতীবালা চলে গেল– আমার মাথায় বিনবিন করতে লাগল–পুকা পুকা সব্বাঙ্গে পুকার কামড়!
অসাধারণ