এইতো সেদিন।
দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকীতে ডুয়ার্স বেড়াতে গিয়েছিল নন্দিনী আর মনোজিৎ। জয়ন্তীর হোটেলে কনে দেখা আলোয় এক পরিশ্রান্ত বিকালে ওরা ঠিক করল বিছানার তৃতীয় অংশীদারকে এবারে নিয়ে আসার সময় হয়েছে। প্রথমত ছাব্বিশ বছরের নন্দিনীর মাতৃত্বের স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা। তাছাড়া কিছুটা ভয়ও জমা হচ্ছিল আস্তে আস্তে – দু তরফের পরিচিত জনের সন্তানধারণে নানারকম সমস্যা, সেসবের জটিল, ব্যয়বহুল অথচ অনিশ্চিত চিকিৎসার খবরাখবর জেনে। তাছাড়া আজ চাইলে কালই তো আর গর্ভধারণ হচ্ছে না। তারপরে আরও ন’মাসের গল্প। বাস্তবে সাবধানতা উঠিয়ে নেওয়ার পরের মাসেই গর্ভবতী হল নন্দিনী। এক সকালে ঘরে বসে দুজনে কিট পরীক্ষার পরে বাবা-বাবা ভাব করে মনোজিতের পায়চারি আজ আবার মনে পড়ল তার।
বাড়ির কাছেই ডাঃ সুশান্ত জানার ছিমছাম সাধ্যবিত্ত নার্সিংহোম মাদার্স অ্যাবোড। অতএব ওঁকেই দেখানো হবে এবং ওখানেই ডেলিভারি হবে এমন ঠিক হল। নিয়মমাফিক রক্তপরীক্ষাগুলি করতে দিলেন ডাঃ জানা। তখনই জানা গেল অজান্তে মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে রসগোল্লা-রসিক নন্দিনী ডায়াবিটিক হয়ে বসে আছে। রিপোর্ট দেখে ডাক্তারবাবুর সাময়িক ভ্রূকুঞ্চন চোখ এড়ালো না হবু মা-বাবার। তিনি ওঁদের বুঝিয়ে বললেন, কেন পরবর্তী দিনগুলির জন্য একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞকে নিয়মিত দেখানো প্রয়োজন। এখানেই প্রতি শনিবার চেম্বার করেন ডাঃ অরুণকান্তি রায়, জেনেরাল মেডিসিনে এম ডি। আর জি কর হাসপাতালের অ্যাসোশিয়েট প্রফেসর। যথেষ্ট অভিজ্ঞ এবং দায়িত্বশীল। সত্যি বলতে, সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার শুনে আগমার্কা মধ্যবিত্তের মত একটু যে নাক সিঁটকায়নি নন্দিনী, তা নয়। কিন্তু ওর স্বামী, যে কিনা সবে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি ছেড়ে জুলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াতে ঢুকেছে, সে ওকে বোঝাল – “কাম অন নন্দা, ডাঃ রায় একটা নামকরা মেডিক্যাল কলেজের অ্যাসোশিয়েট প্রফেসর। তুমি কি ভাবছ, প্রাইভেট হাসপাতালের ডক্টরদের থেকে উনি কিছু কম নলেজিয়েবল? কর্পোরেট ডক্টররা কিন্তু ওই মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ওঁদের কাছ থেকেই পড়াশোনা শিখে আসেন। হতে পারে ওঁদের সেই ফাইভ স্টার গ্ল্যামার বা মাথার পিছনে হ্যালোটা থাকে না। আর তাছাড়া ডাঃ জানা ওঁকে ট্রাস্ট করেন, একটা টিমওয়ার্কের ব্যাপার আছে… আমার মনে হয় এটায় তোমার খুঁতখুঁতানি থাকা উচিৎ নয়।”
তারপরেও সোর্স কাজে লাগিয়ে ডাঃ রায়ের সম্বন্ধে তত্ত্বতালাশ করে এল সে। অমায়িক জ্ঞানী মানুষ, ছাত্রমহলে জনপ্রিয় একেআর নামে। মাঝে মাঝে ভাবে নন্দিনী, সেদিন যদি সে স্বামীর কথা না মেনে জোরালো আপত্তি করত, অন্য কোনও চিকিৎসকের কাছে দেখাতে যেত, হয়ত ভালই হত। এই রকম এক নাছোড়বান্দা অনুভূতি নিয়ে তাকে সকলের অগোচরে এক বিপন্ন জীবন কাটাতে হত না। নিজের মনে একবার হাসে সে, আধো চোখে দেখে নেয় গাড়ি সবে টালিগঞ্জ ট্রামডিপো পার হয়ে স্টুডিওপাড়ার দিকে এগোচ্ছে। মনোজিৎকে একবার গভীর দৃষ্টিতে আদর করে আবার চোখ বন্ধ করে সে।
প্রথম থেকেই ইনসুলিন শুরু হল নন্দিনীর। সুগার চড়ে আর পাল্লা দিয়ে বাড়ে ইনসুলিনের ডোজ। বাড়িতে গ্লুকোমিটারে নিত্য আঙুল ফুটিয়ে সুগার মাপা, খাতায় তোলা আর একেআর-কে এসএমএস করে জানানো। রাতে রিপোর্ট দেখে পরের দুদিনের ডোজ বলে দেন ডাঃ রায়। দু তিন সপ্তাহ অন্তর চেম্বারে দেখেন। এই অবস্থায় চড়া সুগারের বিপদ, তার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ম মানা ও ওষুধ খাওয়া – সব বুঝিয়ে দেন অসীম ধৈর্য্যে।
চৌত্রিশ সপ্তাহের মাথায় নন্দিনীর রক্তচাপ বাড়তে আরম্ভ করল। প্রেশারের ওষুধ শুরু হল, প্রথমে একটা, তারপরে বেড়ে দুটো। ছত্রিশ সপ্তাহে মূত্রে প্রোটিন পাওয়া গেল – অর্থাৎ প্রি-এক্লামপ্শিয়া। মাতৃত্বকালীন ভয়াবহ বিপদগুলির মধ্যে একটি। স্টেরয়েড দেওয়া হল গর্ভস্থ শিশুর অপরিণত ফুসফুসকে কার্যক্ষম করানোর জন্য যাতে দ্রুত প্রসব করানো যায়- রক্তে সুগার বাড়ল হৈ হৈ করে। সেই স্টেরয়েডের কাজ শুরু হওয়ার আগেই রক্তে অনুচক্রিকা নামতে লাগল, লিভারের এনজাইম চলে গেল উপরের দিকে। ডাক্তারবাবুরা বললেন হেল্প সিনড্রোমের লক্ষণ – জীবনসংকট একেবারে ঘাড়ের উপরে বসে তার আগুনে শ্বাস ফেলছে। দ্রুত প্রসবের সিদ্ধান্ত নিলেন ডাঃ জানা এবং ডাঃ রায়।
নন্দিনীর প্রবল ইচ্ছা স্বাভাবিক প্রসবের – জীবনের এ অভিজ্ঞতা থেকে সে বঞ্চিত হতে চায় না। ব্যথা সে দাঁতমুখ চেপে সহ্য করে নেবে। ওষুধ প্রয়োগ হল প্রসববেদনা জাগানোর জন্য। সেদিন সন্ধ্যায় মা হল নন্দিনী। রাতে শুরু হল মৃগী। ডাক্তারবাবুরা বললেন এক্লাম্পশিয়া। ওষুধ, রক্ত আর চিকিৎসক-নার্সদের বিনিদ্র রজনীযাপনের নৌকা বেয়ে জীবন-মরণের মাঝের নদী পার হল সে। ছুটির সময় ডাঃ জানা দম্পতিকে ডেকে বললেন – “ডেলিভারিটা আমি করলাম ঠিকই, তোমাকে বাঁচালেন কিন্তু ডাঃ রায়। এতগুলো মারাত্মক সমস্যা একসাথে জড়ো হয়েছিল, আমরা কতটা চিন্তায় পড়েছিলাম তোমাকে নিয়ে, সে তোমাদের বোঝাতে পারব না।”
ছেলে কোলে ঘরে ফিরল নন্দিনী। জীবনের আশঙ্কা দূর হল কিন্তু সাতাশ বছর বয়স থেকে চিরসঙ্গী হয়ে গেল ডায়াবিটিসের ওষুধ, নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর ডাঃ অরুণকান্তি রায়ের চেম্বারে ভিজিট করা। সে রুটিনে প্রথম ছেদ পড়ল তের বছর পরে – দু হাজার বিশের শুরুতে যখন করোনা এসে আপামর মানুষের জীবনের গোড়া ধরে দিল ঝাঁকিয়ে। দুনিয়াটা বদলে গেল, স্তব্ধ হয়ে গেল তার ভিতরের একান্ত নিজস্ব একটা পৃথিবীর চলন।
একান্ত নিজস্ব? সত্যি? শব্দদুটো ভেবে মনে মনে হাসে নন্দিনী। যে অনুভূতিকে সে এইমাত্র একান্ত নিজের বলে নিজেকে প্রবোধ দিল, তাকে প্রথম তার অন্তঃস্থল থেকে বার করে চিনিয়ে দেয় তার স্বামী মনোজিৎ – প্রচলিত ধারণায় যে তার স্ত্রীর মনোজগতের এই খবর পেলে দাম্পত্যে ঘূর্ণিঝড় ওঠার কথা। আশ্চর্য মানুষটা।
সেই সন্ধ্যার কথা মনে পড়ল নন্দিনীর। তখন সে আড়িয়াদহতে তার মা’র কাছে। দেড়মাস বয়সের পিকুকে কিছুক্ষণের জন্য শ্বশুরবাড়িতে রেখে ডাঃ জানা এবং ডাঃ রায় উভয়কে দেখিয়ে মায়ের কাছে ফিরছে সারাদিনের জন্য গাড়ি ভাড়া করা গাড়িতে।ফেরার পথে সেন্ট্রাল এভেন্যুতে চাং ওয়া’য় কিছুক্ষণের বিরতি। মনোজিতের পাক্কা হিসাব করা আছে, উনিশ সপ্তাহে অ্যানোম্যালি স্ক্যান করিয়ে ফেরার সময় তারা দুজন শেষবারের মত রেস্টুরেন্টে খেয়েছিল। তাছাড়া, কলকাতায় যে দুয়েকটা খাওয়ার জায়গায় এখনো নিভৃত কেবিন আছে, চাং ওয়া তার মধ্যে একটা, তাই নবীন সদস্যের এক্সক্লুসিভ মাদার ডেয়ারির সাপ্লাই বজায় রাখতে কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। একথা শুনে হেসে স্বভাবমত স্বামীর ভুঁড়িতে রামচিমটি কেটেছিল নন্দিনী – “নিজে পেটুকঠাকুর, তাই বলে অন্নপ্রাশনের আগেই ছেলেকে রেস্টুরেন্ট দেখানো! পারা গেল না তোমাকে নিয়ে।”
খেতে খেতেই কথাটা পাড়ল মনোজিৎ দেহ কাঁপিয়ে হা হা করে হাসতে হাসতে।- “তুমি ত দেখছি ডাঃ রায়ের উপরে একদম ফিদা হয়ে গেছ নন্দা।”
চমকে ওঠে নন্দিনী – “ধ্যাত্, সবসময় ফাজলামি। যাহোক কিছু একটা বললেই হল যখন তখন, না? একজন পঞ্চাশ বছরের আধবুড়ো লোক…..” বলে হঠাৎই যেন মন দেয় কোলে ঘুমন্ত ছেলের দিকে।
মুখের খাবারটা ধীরেসুস্থে শেষ করে আবার হাসতে হাসতে মনোজিৎ বলে – “সে অস্বীকার করছ করো, কিন্তু যে রেটে ওনাকে পনেরো মিনিট ধরে ঝাড়ি মেরে গেলে, উনিই দেখলাম দুয়েকবার লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলেন।”
– “ঝাড়ি! দেখো, ঐসব রকের কথাবার্তা বলবে না কিন্তু।” মৃদু কণ্ঠে ছদ্ম রাগ দেখায় নন্দিনী, তবে ঝোঁকটাও যে খুব একটা জোরালো ছিল, তা সে বলতে পারত না।
– “বেশ সখী। ঝাড়ি-ফারি নয়। তুমি নির্নিমেষলোচনে চিকিৎসক অরুণকান্তি রায় মহাশয়কে অবলোকন করিতেছিলে এবং তাহাতে উনি ক্ষণে ক্ষণে যারপরনাই লজ্জিত হইয়া চক্ষু নিমীলন করিতেছিলেন। এতদৃশ আচরণ তুমি পূর্বে গর্ভাবস্থাতেও করিতে তবে অদ্য কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত বোধ হইল। হল? বাংলায় আমি কিন্তু সেযুগের উচ্চ মাধ্যমিকে একশো বত্রিশ পেয়েছিলাম।” শেষ করে একটা চিলি চিকেন মুখে তোলে মনোজিৎ।
– “চুপ করো তো। উনি বোঝাচ্ছিলেন আর আমি কি সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকব! তাড়াতাড়ি শেষ করে ওঠো এবারে। অনেক দূরের রাস্তা এখনো। ওদিকে যা জ্যাম তুমি নিশ্চই জানো।”
– “ওরে ব্বাবা, তা জানব না! বিয়ে করতে যাওয়ার দিন তো ভাবছিলাম লগ্নটাই পেরিয়ে গেল, আর পুরোনো বাংলা সিনেমার মত কোনও মহানুভব নায়ক এসে তোমার মাকে বলল – যদি আমাকে যোগ্য মনে করেন, আমি আপনার কন্যার পাণিগ্রহণ করতে সম্মত আছি।” প্রসঙ্গ ঘুরে গেল অন্যদিকে – বাসরঘরের সুখস্মৃতিতে।
গাড়িতে উঠে মনোজিৎ এবারে দেড় মাসের ছেলেকে ভবিষ্যতে কোন স্কুলে ভর্তি করাবে, কিভাবে স্কুলে যাতায়াত করবে এসবের পরিকল্পনায় মেতে রইল। তারপরে আসন্ন অন্নপ্রাশনের মেনু ঠিক করতে বসল। সে জানলও না নিজের অজান্তে সে যেন তার অর্ধাঙ্গিনীর অবচেতনের কোন্ অতলে পড়ে থাকা গজদন্তের কৌটা তুলে এনে তার সামনে খুলে ধরে বলল – ‘দেখো তো, চেনো কি এই লুকানো মুক্তোটা?’ কে জানে, চোখে আঙুল দিয়ে চিনিয়ে না দিলে তার মনের সে গহীন ভাবের সমাচার নন্দিনী নিজে আদৌ পেত কিনা?
মনোজিৎ বকে চলে, গাড়ি চালককে আড়াল করে শিশুকে স্তন্যপান করাতে করাতে চিন্তায় ডুব দেয় নন্দিনী। মনোজিৎ ঠিক বলছে না ত? সত্যিই কি সে একটু বেশিরকম আবিষ্ট হয়ে ডাঃ রায়ের কথা শোনে? ডাক্তারবাবুর দিকে তার অনিমেষ দৃষ্টি কি শুধু একজন রোগিণীর, না কি একজন মোহগ্রস্তর? ভাবতে ভাবতেই সে যেন হঠাৎ সমাধান করে ফেলে দেড়মাস আগে তার মনের এক রহস্যের। সেইদিন নার্সিংহোম থেকে ছুটির সকাল। তার মনে এত খুশি – সন্তান কোলে নিয়ে বাড়ি ফেরা, মরণের দুয়ার থেকে ফিরে আসা। মা, ভাই এসেছে তাকে নিয়ে যেতে। স্বামী মিষ্টিমুখ করাতে ব্যস্ত। আহ্লাদিত শ্বশুর-শাশুড়ী। তৃপ্ত নার্সিহোমের কর্মীরা সবাই। এসবের মধ্যেও একটা বিষাদের রাগিণী একটানা বেজে চলেছে তার মনে। মনে হচ্ছে যেন আরও ক’দিন ভর্তি থাকতে পারলে খারাপ কিছু হত না। অথচ সে ত শরীরে সম্পূর্ণ সুস্থ। মায়ের বাড়িতে ফিরে সেদিন সন্ধ্যায় তার হঠাৎ মনে হয়েছিল পরের দিন থেকে ত একেআর তাকে আর দেখতে আসবেন না। আজ মনোজিতের কথাগুলোর পরে সে দুইয়ে-দুইয়ে চার করে আবিষ্কার করল তার সেদিনের সেই আপাতদৃষ্টিতে ব্যাখ্যার অতীত মনখারাপের কারণ।
ঠান্ডা গাড়ির মধ্যে বসেও সেদিন ঘামতে শুরু করেছিল নন্দিনী। এ কিসে মরল সে!
এর পরে আগামী পর্বে।