পূর্বপ্রকাশিতের পর
সেদিন অবশ্য জজসাহেব পরে আমার সাথে সদয় ব্যবহারই করেছিলেন। সকলে এসে হাজির হলে, আমার সাক্ষ্যই সবার আগে নিয়ে আমাকে তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়েছিলেন। এমন কিন্তু সব কেসে, সবসময় হয় না। ‘সামনে’ সকাল দশটায় হাজিরা লেখা থাকে। হয়তো সকাল দশটায় পৌছে দেখলাম, কোর্টের চত্তরে জনপ্রাণী নেই। গোটা চত্তর জুড়ে, হাটচালার মত, উকিল-মুহুরীদের চালার নিচের চেয়ার টেবিলে দু একটা মাছি উড়ে বেড়াচ্ছে। এক কোনে একটা চায়ের দোকানে দোকানদার একাই বসে আছে, করুণ মুখে। একটা চা দিতে বলে সামনের বাঁশের মাচায় বসলাম। বেচারার দোকানে হয়তো আমিই সেদিন বৌনি করলাম। চায়ের গ্লাসটা হাতে নিয়ে, সাবধানে জিজ্ঞাসা করলাম, সব শুনশান কেন? জানা গেল, কি একটা কারণে ক’দিন উকিলবাবুরা কর্মবিরতি করেছেন। গেল; হাসপাতালের কাজকর্ম ফেলে, রাতের ট্রেনে আধ জাগা হয়ে এতদূর এসে বৃথাই ফিরে যেতে হবে। আবার একদিন তো আসতে হবেই; তার থেকে বড় কথা, “হাজিরা” লিখে না নিয়ে গেলে, আবার হয়তো কোনদিন, “বেঁধে আনার ফরমান জারি” হবে। অতএব, দায় আমার, সরকারী উকিলবাবুরা, অর্থাৎ পাবলিক প্রসিকিউটার কোথায় আছেন খুঁজে বের করার। কোর্টে কাজকাম চলছে না, তাই ওনারাও ধীরেসুস্থে এলেন। ওনাকে নিজের পরিচয় দিয়ে, নিমন্ত্রণ পত্রটি দেখালে, মুখে কিছু না বললেও, বেশ বোঝা যায়, ভয়ানক বিরক্ত হয়েছেন। এমন একটা উটকো আপদকে এখন আবার হাজিরা লিখে দিয়ে, সরকারী পবিত্র বেগুনী কালী লাগিয়ে দিতে হবে।
বেগুনী কালী? কোর্টে গেলে, ভোটের কালীর মত দেগে দেয় নাকি! আরে না না; ঐ যে সরকারী উকিলবাবুরা একটা কলমের খোঁচা দিলেন, তার তলায় একটা রবার ষ্টাম্প না পড়লে তো ওটা শুদ্ধতা পেল না। হাজারবার শুদ্ধতা দিতে দিতে, ঐ কালীর দাগে কী অক্ষর ফুটে উঠল, দেবা ন জানন্তি।
উকিলবাবুতো দিলেন কলমের খোঁচা ; কিন্তু ঐ ছুটির বাজারে ওনার পিয়ন লোকটি হয়তো সেদিন আসবেই না। অতএব ঐ কালীর ছাপ দেওয়ার মত অপকর্মটি উকিলবাবুকে নিজ হাতেই করতে হল। কার না মুখ ব্যাজার হয় বলুন।
ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতেই হয়। এদিন আমার কাজকর্ম সকাল সাড়ে দশটা কি পৌনে এগারোটায় মিটে গেল। দু রাত ট্রেনে কাটিয়ে, দুদিন হাসপাতালের কাজে “ফাঁকি দিয়ে”, (মেয়ের পরীক্ষার কথা সরকারী কর্মচারির মাথায় রাখাই অপরাধ) যে মহান দায়িত্ব পালন করে এলাম, সেটা তো বলতেই হয়।
সাধারণত ঐ পাবলিক প্রসিকিউটার বা পি পির সাথে দেখা হলেই উনি আমাদের নিমন্ত্রণ পত্রে লেখা কেস নম্বরটি দেখে, কেস ডায়েরি বা সি ডি দেখতে দেন। এক তাড়া নানান কিসিমের কাগজের ভেতর থেকে নিজের হাতের লেখা ইনজুরী রিপোর্ট দেখে মনে একরকম উৎকন্ঠার অবসান হয়। দশ বছর আগে কোন কপালে কালশিটে পড়া রুগী দেখেছিলাম, ঐ কাগজটি না দেখলে কারও পক্ষেই সম্ভব নয় মনে রাখা। এই কেসে আমার এমনই কপালের ফের যে, দায়িত্বে থাকা পি পি আমাকে আগে সি ডিটাও দেখান নি। এক একটা কেসে, আসামি পক্ষের উকিলবাবু এক এক রকম আইনের ফাঁক বের করার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে ওদের উকিলবাবু আমাকে জেরা করার সময়, আর যাই করুন, আজন্ম বৈষ্ণব সন্ন্যাসীর মত, প্রয়াত পিতৃদেবকে অপমান করে কিছু বলেন নি।
একেবারে গবেট, টুকে পাশকরা উকিলবাবুও পেয়েছি কখনও। তাদের প্রশ্ন বা মন্তব্য শুনে ঘৃণার উদ্রেক ছাড়া অন্য কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। এসব লোক যখন জেরা করে, রাস্তার ঘেয়ো কুকুরকে যেমন নিরাপদ দুরত্ব দিয়ে এড়িয়ে যেতে হয়, তেমনি করেই নিজেয় শিক্ষাদীক্ষা, সুকুমার প্রবৃত্তি সব জলাঞ্জলি দিয়ে চুপ করে সাক্ষীর কাঠগড়া থেকে নেমে আসতে হয়।
যাই হোক; এক্ষেত্রে যদিও বেশ বুঝলাম, আমার একটি নির্বিকার উত্তরই উকিলবাবুর হাতে প্রয়োজনীয় অস্ত্রটি যুগিয়ে দিল; দিনের শুরুর অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা কোনরকম বিশেষ চিন্তাভাবনা থেকে আমাকে বিরত করল। যারা একবারও এরকম সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠেছেন, তাদের কাছে কোন নতুন তথ্যই নয়; এমন কয়েকটি কথা বলে নিই।
আমি অন্তত দশ বারোবার কোর্টে সাক্ষী দিতে গিয়েছি, দুটি জেলায় আর একটি মহকুমা কোর্টে। কিন্তু কোথাও, সিনেমায় যেমন দেখা যায়, গীতা হাতে বা ঈশ্বরের নামে কোন শপথ নিতে বলেনি কেউ। একটা ছাপানো কাগজ কাঠগড়ায় আঠা দিয়ে আটকান আছে, দেখেছি কয়েক জায়গায়; ঐ সব, “সত্য বলিব……..” ইত্যাদি লেখা। কেউ কোনদিন পড়তেও বলেনি।
সাধারণভাবে যা আমি প্রতিবারই দেখেছি, পি পি কিংবা সহকারী পি পি বলেন, ডাক্তারবাবু, চলুন। সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়িয়ে বিচারক মহোদয়কে নমস্কার জানানোর পরই, পি পি, ঐ সি ডি, অর্থাৎ এক তাড়া কাগজের ভেতর আমার লেখা ইনজুরী রিপোর্টটি বের করে হাতে ধরিয়ে দেন। এমনও হয়েছে, ওখানেই প্রথম দেখলাম ঐ মহার্ঘ কাগজটি। একবারতো দেখি ওটি আমার লেখাই নয়। এরপর চলল, ঐ কাগজের তাড়া থেকে আমার অতি পরিচিত জঘন্য হস্তাক্ষরে লেখা কোন ভুর্জপত্রও যদি কোন প্রত্নসামগ্রির মত পাওয়া যায় তার মরিয়া খোঁজ। না, আমার পুরনো কর্মস্থলের একটি ছোট্ট চিরকুট খুঁজে পেলেও, ওটি কার লেখা উদ্ধার করা গেল না। ওখান থেকে রুগী কলকাতার যে মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়েছিল, পরে ওখানেই মারাও যায়; তার কয়েকটি নিদর্শন পেলাম। কিন্তু ঐ মেডিক্যাল কলেজের সাথে আমার কোন সম্পর্ক কোনদিন ছিল না। অগত্যা মহামান্য আদালতের মূল্যবান মিনিট কুড়ি সময় নষ্ট করে, কাঠগড়া থেকে নেমে এলাম।
আর আমার হাসপাতালের কাজের একটি দিন যে বৃথা নষ্ট হল! ওসব “ছোটোলোকের হাসপাতালের, থার্ড ক্লাশ ডাক্তারের” সময় নষ্ট নিয়ে কেউ কোনদিন ভাবে না। আমি তো মাসের শেষে পুরো বেতনই পাবো; একদিন হাসপাতালের রুগীদের না দেখলে, একটাকা বেতন কম দেবে, এমন কোন আইন এখনও এদেশে হয়নি। হ্যা, ঠিকই ভাবছেন; বেতন একটু বেশীও তো দিতে পারে! সেরকমও যে কেউ কেউ ভাবে না তা নয়। এবার একটু মনে মনে হিসেবটা করেই নিন। ঐ যে দেড়দিন আগে জানতে পেরে কলকাতা থেকে রায়গঞ্জ ছুটলাম; আমার ব্যক্তিগত কাজকর্ম সব ছেড়ে দিন, রেলের ভাড়াটাতো নিজের পকেট থেকে দিলাম। একজন প্রথম শ্রেণির সরকারী আমলার হিসেবে, রেলে যে শ্রেণীতে ভ্রমণ আমার প্রাপ্য, আজ পর্যন্ত সেটা ভাবার দুঃসাহস দেখাইনি। কেন? বলছি। অন্য দপ্তরের, ঐ একই পদমর্যদার কোন আমলার পিয়্ন, যে শ্রেণীর টিকিট পায়, সেই দামের টিকিট কেটে, আমার কর্মস্থলে টি এ বিল করার জন্য জমা দিয়েছি, সাত আট বছরেও সে বিল দেওয়ার মত “আলটমেন্ট” আসেনি! পরে আর কোনদিন ওরকম ভিখারির মত, চারশ তিরিশ টাকা চাওয়ার ইচ্ছাও হয়নি।
রায়গঞ্জে আমার অনেক বন্ধুবান্ধব আছে। আজও ওরা ছেলের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করে। কোর্টের কাজ সেরে, ওদের কারো মোটর বাইকে চড়ে, তিন চারজনের বাড়ী ঘুরে নিই। তাও পরে যখন কেউ জানতে পারে, ঐ বার তার বাড়ী যাওয়ার সময় হয়নি, রাগ করে। পরের বার অবশ্যই যাব, এমন কথা দিতে হয়।
অনেককে একরাত হোটেলেও থাকতে হয়। সেসব পয়সা কেউ কোনদিন পেয়েছে কিনা জানিনা। ঐ টাকা বিল করে বের করার থেকে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লটারির পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশী।
অনেক, এবং অনেকের “মন কি বাত” বলে ফেললাম। এবার আবার সেই রায়গঞ্জের সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েই কথা বলি। সি ডি টি হাতে দিয়ে পি পি বলেন, ঐ যে একটি রুগী আপনি দেখেছিলেন, সেটির সম্বন্ধে বলুন। এর আগে জজসাহেব, আমার নাম ধাম, পিতৃপরিচয় লিখে নিয়েছেন। আদালতে আধার কার্ড দেখানোর চল হয়েছে কিনা জানিনা। এখন তো “রাজদ্বারে শ্বশানে চ” ঐ পরিচয়পত্রটি অপরিহার্য। এখন কোথায় কি কাজ করি, আর ঐ যে, হাতের ইনজুরী রিপোর্টটির তারিখ, ঐদিন কোথায় কি পদে ছিলাম, এসব আদালতের নিয়মমাফিক লিপিবদ্ধ হল।
আমি যেহেতু ইংরেজীতেই রিপোর্টটি লিখেছি, ঐ বিজাতীয় ভাষাতেই জানালাম, রিপোর্টে লেখা রুগীটির বর্ণনা। তার বাইরে একটি শব্দও উচ্চারণে আমার পরম পূজনীয় গুরুজনের নিষেধ আছে। কোনদিন বলিও না। তবে হ্যাঁ, ঐ বিজাতীয় ভাষাতেই কথা বলার সুযোগ একবারই নিয়েছিলাম, সে আর একটা গল্প। এখানে তো পড়ে দিলাম, “ইকাইমোসিস অন লেফ্ট সাইড আফ দি ফোরহেড, কজ্ড বাই আ বাম্বু স্টিক”। জজসাহেব লিখেও নিলেন। ওনার হাতে লেখা কাগজটি পরে আমি সই করে দিলে, সেটিই আদালতগ্রাহ্য মহার্ঘ জিনিষ। ঐ যে দশ বছর আগে, রুগীর সামনে বসে, হাতে গরম রিপোর্ট লেখা হয়েছে, তার কোন মূল্যই নেই আইনের চোখে।
এরপর এলেন ডিফেন্স ল ইয়ার, অর্থাৎ সোজা বাংলায় যে উকিলবাবু আসামিকে নির্দোষ প্রমাণ করবেন তিনি। এক্ষেত্রে এই উকিলবাবু যে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করে এসেছেন, ওনার একটি প্রশ্নেই বুঝেছিলাম। থার্ড ক্লাশ উকিলবাবুদের মত, ডাক্তারের ব্যক্তিগত জীবন বা ছাত্রজীবনে পড়াশুনায় ফাঁকি ইত্যাদি বলে, বিভ্রান্ত করে কোন ভুল বলিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা এক্ষেত্রে ছিল না। উনি শুধু বললেন, অবশ্যই বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায়, “আচ্ছা ডাক্তারবাবু, এই যে কপালে আঘাতের চিহ্নটি বললেন, কোন মানুষ হোচট্ খেয়ে শক্ত পাথরটাথরের ওপর পড়লে, ওরকম চিহ্ন পাওয়া যেতে পারে?” উত্তরে “হ্যা” বললাম। উনি আদালতকে জানালেন, আর কিছু জানার নেই। জজসাহেবকে নমস্কার করে নেমে এলাম। মিনিট পাঁচেক পরই পেশকারবাবু ডেকে ঐ জজসাহেবের লেখা কাগজে সই করালেন। হাজিরার কাগজটাও সত্তর করে দিলেন।
এ বারের মত আদালতে হাজিরার মহান দায়িত্ব শেষ করে এক বন্ধুর বাড়ীর দিকে হাঁটা দিলাম। ঐ মামলার ফল কি হল; কে কেমন বিচার পেল, এসব চিন্তা ভাবনা ঠিক এজলাসের দরজার বাইরেই এসে, জন্মগতভাবে প্রাপ্ত মহার্ঘতম হার্ডডিস্ক থেকে চিরতরে মুছে ফেললাম। এটাতে জায়গা যতোটা পরিষ্কার রাখাযায়, ততোই মঙ্গল।