২০১৭ সালের ঘটনা। সকাল ১১ টায় আউটডোরে তখন লম্বা লাইনটা অজগর সাপের মতো এঁকেবেঁকে গিয়েছে। ৩০ শয্যার খন্ডরুই গ্রামীণ হাসপাতালে ডাক্তার সর্বসাকুল্যে আমরা দুজন। আমি আর সৌমেন পঞ্চাধ্যায়ীদা।
অল্টারনেট ডে ২৪ ঘন্টা করে ডিউটি করি। তবে আউটডোরে একে অন্যকে সাহায্য করে দিই। তো সেদিন ডিউটিতে আমি। একটা জ্বরের রোগীকে দেখে অভ্যস্ত হাতে ওষুধ লিখছি। হঠাৎ হৈহৈ করে কিছু আর্তনাদ শুনলাম ইনডোরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইনডোরটা আউটডোর থেকে প্রায় ১০০মিটার দূরে। পোড়-খাওয়া আমি বিপদের গন্ধ বুঝে দৌড়ে ইনডোরে গেলাম।
দেখি প্রায় ৫০-৬০জন লোক চিৎকার করতে করতে ইনডোরে ঢুকছে। তাদের মধ্যস্থলের একজন বছর তিরিশেক লোকের হাতে একটা নেতিয়ে পড়া বছর তিনেকের বাচ্চা। বাচ্চাটার সারা শরীর ভেজা, সাদা, বরফের মতো ঠান্ডা। জলে ভর্তি পেট বেলুনের মতো ফুলে উঠেছে। শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ। উত্তেজিত জনতার কাছে জানতে পারলাম, তুরকা গ্রামের এই বাচ্চাটা খেলতে খেলতে সবার অলক্ষ্যে একটা পুকুরে ডুবে গিয়েছিল। কতক্ষণ পুকুরে ছিলো কেউ জানেনা। সেখান থেকে তুলে প্রায় চার কিমি রাস্তা পার করে তারা নিয়ে এসেছে। আমি সেই উত্তেজিত জনতার মাঝে ঢুকে বাচ্চাটাকে পরীক্ষা করতে শুরু করলাম। তখনি সৌমেন দা আমায় সরিয়ে বাচ্চাটাকে হাতে তুলে নিলো। নেতানো শরীরটাকে একহাতে উপুড় করে রেখে, অন্য হাত দিয়ে পিঠের ওপর মেরে পেটের জল বের করার চেষ্টা করতে লাগলো।
তারপর চিৎকার করে সিস্টার দিদিকে বললো লেবার রুম থেকে সদ্যোজাত বাচ্চার মিউকাস পরিষ্কার করার রমসন মিউকাস সাকার আনতে। মিউকাস সাকারের একপ্রান্ত বাচ্চার মুখ দিয়ে শ্বাসনালীতে ও অন্য প্রান্ত নিজের মুখে নিয়ে টানতে লাগলো। পুকুরের ঘোলা জল বাচ্চার শরীর থেকে বেরিয়ে এসে জমা হতে লাগলো মিউকাস সাকারের অলিন্দে। প্রায় ৮-৯ টা মিউকাস সাকার ভর্তি জল বের করার পর অবাক হয়ে দেখলাম বাচ্চাটা ছোট্ট একটা শ্বাস নিলো। আরো খানিকক্ষণ দুজনের চেষ্টায় কেঁদে উঠলো সে।
প্রায় ঘন্টা খানেক পর বাচ্চাটাকে অক্সিজেন-শুদ্ধ যখন ৭০কিমি দূরে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে রেফার করলাম, তখন সে ঘোর লাগা গলায় কেঁদে যাচ্ছে। আমাদের কাজে আমরা মোটামুটি সফল, বাকি কাজটা মেডিক্যাল কলেজের শিশু বিশেষজ্ঞরা দক্ষ হাতে করবেন তা জানতাম।
সৌমেনদার মতো ডাক্তাররা প্রতিদিন ঢাল-তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দার হয়ে নিঃশব্দে মিরাকেল ঘটিয়ে যাচ্ছে। নেই তাদের অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা কাজের কোনো প্রচার বা কোনো পুরস্কার। বছরের পর বছর ঘরবাড়ি ছেড়ে হাসপাতাল কোয়ার্টারে পড়ে থেকে ডিউটি করে যাওয়া ও এইরকম টুকটাক মিরাকেল করে যাওয়াই তাদের জীবন। পাওয়ার হিসেবে শুধু জমা হয় পুনর্জন্ম পাওয়া বাচ্চার মায়ের চোখভরা কৃতজ্ঞতা ও আমার মতো সহকর্মীদের শ্রদ্ধা।
ডাঃ সুদীপ্ত চক্রবর্তী
এদের জন্যই সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখনও টিকে আছে।