নীল সাগরের বুকে এক হারিয়ে যাওয়া দ্বীপ। সুদূর দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার চ্যানেল দ্বীপপুঞ্জের একটা দ্বীপ।তটে কুড়িয়ে পাওয়া তিমির হাড়, ঘাসপাতার ছাউনি, মরা সীলের চামড়ার একটা কুটির।সামনের ঝড়ে পড়া একটা গাছের কান্ডের ওপর এক নারী।সমুদ্রের হাওয়া ঝিনুকে শঙ্খে এলোমেলো বাঁশি বাজায়। যুবতীর সীল মাছের পোশাক হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে যেতে চায়। এ নারীর নাম নেই।নারীর ভাষা নেই।জনশূন্য এই দ্বীপে ভাষায় প্রয়োজন হয় না।ঈষৎ রুখু চুল বাতাসে ওড়ে, শঙ্খচিল-পাখি-সাঁতরে ক্লান্ত সীল মাছ, ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাসা মাছেরা বালুকাবেলায় পড়ে থাকে। বাতাস বহে, হয়তো বাতাসে সেই কথা ভাসে।বাতাস তো সব প্রশ্নের উত্তর বাঁশিতে বাজায়, আকাশ নিষ্পলক চেয়ে থাকে।তখন শিশু নারী, পুরুষের দুশোজন মানুষের জীবনস্পন্দনে কাঁপতো এই দ্বীপের হৃদয়,সেই সব কথা।আকাশ, বাতাস পৃথিবী কিছুই ভোলে না।আনামী দ্বীপের হিয়ার সকল কান্না লেখা আছে বাতাসের ভাষায়।তারপর ধর্মশিকারীরা এলো।দ্বীপের নাম হলো স্যান নিকোলাস দ্বীপ।সেটা সন ষোলোশ দুই।তিমিঙ্গিলের দল প্রথম এই দ্বীপটাকে খুঁজে পায়।ও মা,তিমিঙ্গিল জানেন না?যারা তিমি শিকার করে তাদের আমরা তিমিঙ্গিল বলবো। তারপর কী হলো?দিন বহে গেল ঢেউয়ের মতোন।চিহ্ন রইলো না কিছুই। আঠেরোশো তিরিশ সনে এলো মানুষধরার দল।সেই দ্বীপের দুশো প্রকৃতির সন্তানকে,দুশো মানবসন্তানকে জাহাজের খোলে ঢুকিয়ে নিয়ে গেল তাদের দেশে।প্রথম তাদের খৃষ্টধর্মে দীক্ষা দেওয়া হলো।তারা বুঝলো না, তাদের ঈশ্বর -আকাশ,সমুদ্র, বাতাস সব বদলে নীল চোখের দাড়িওয়ালা(যদিও জানিনা পশ্চিম এশিয়ায় আফ্রিকা সন্নিহিত দেশে নীলচোখের সাদা চামড়া মানুষ কোথা থেকে এলো?)এক দেবতা তাদের তখন থেকে তাদের নতুন ঈশ্বর হলেন।যদিও তারা কেউ অপরিচিত পরিবেশে, দূষিত রোগদীর্ণ বাতাসে,দেবতারূপী মানুষের নামেও সাত সপ্তাহের বেশী বাঁচেনি….কেউ না,বিশ্বাস করুন একজনও না।দয়াময় খৃষ্টের নামেও বাঁচলো না-একটা পুরো জনজাতি ধ্বংস হয়ে গেল।তিমিশিকারীরা যখন ধর্মশিকারী;তখন সব কিছুই শিকারী আর শিকারের হিসেবে হয়।কটা প্রকৃতির সন্তানকে ধর্মের নিগড়ে বাঁধা গেল- ঈশ্বরের সন্তান বানানো গেল সেটাই বিচার্য।ধর্ম বাঁচলো কিন্তু সব মানুষ শেষ হলো।
তবুও গল্প শেষ হলোনা।একটি মানবী পালিয়ে গেছিলো এই ধর্মবিদ্বেষীদের হাত এড়িয়ে।এই লোলুপ মানুষধরাদের নাগালের বাইরে সে পালিয়ে গেল-জঙ্গলে, পাহাড়ে, আকাশের তলায়, সমুদ্রের তীরে তীরে সে তার নিঃসঙ্গ প্রাকৃতিক জীবন কাটালো। আঠেরোটা বছর।হয়তো একাকী ভালো ছিলো না।সঙ্গে শুধু ছিলো আদিম সেই চিরস্থির প্রকৃতি।সব সঙ্গীই তখন গেছে ঈঙ্গিতে মুছিয়া।তার অশ্রুতে,সামান্য হলেও,হয়তো সমুদ্রের জলের পরিমাণ বেড়েছিল।আঠেরোটা বছর পরে আবার এলো সেই ধর্মের নামে খুনীদের দল। তুলে নিয়ে গেল তাকে খাঁচায় পুরে।আহা সেই বন্য মানবী-তাকে তারা কী নামে ডাকবে?যদিও সে বোঝে না এই সব ভাষা।তার ভাষা বুঝতে পারা সবাই তখন কবরে শয়ান।এখানের দূষিত বাতাসে,দূষিত মানুষের সংস্রবে সে কয়েক সপ্তাহ পরেই মারা গেল।তাকে কী অবিচার সইতে হয়েছে, কতোটা অপমানের ছিলো সেই বন্দীজীবন; সেটা কিন্তু লেখা নেই।লোভী মানুষ তার ভাষা জানতো না।তবু সে দীক্ষিত হলো খৃষ্টধর্মে।নতুন নাম হলো জুয়ানা মারিয়া।দ্য লোন লেডি। মৃত্যুশয্যায় তাকে কেউ প্রিয় নামে ডাকে নি-যে নামে তার তাকে তার জন্মদাত্রী ডাকতো।শোনায় নি বাতাসের বাঁশি, শোনায় নি শঙ্খচিলের ডাক, সমুদ্রের আকুল গর্জন-আয় মেয়ে ফিরে আমাদের কাছে-ধর্ম আর সভ্যতার কলুষ ছেড়ে-ফিরে আয় ঝাউবনে, উপলে উপলে।মরে গেল একজন স্বাধীন মানবী তার দুঃখসুখের না বলা গল্প নিয়ে।এরপর থেকে শুধু সভ্য জগতের অসভ্যতার জয়গান।