আজ একটু আগেই সে এল। চিন্তা করে অতীতের কত কথাই না ভেসে এল মনে। প্রথম সে এসেছিল খুব চেনা বন্ধুর হাত ধরে।
আশা দেবী তখন জলন্ধরে থাকত।
কোন ক্লাসে পড়ি তখন? ক্লাস নাইন কিম্বা টেন। ভারি মুগ্ধ হয়েছিলাম তার রূপে। মন্ত্রমুগ্ধও বলা যেতে পারে।
এরপরে এল চাকরির প্রথম দিকে। আমার কাছে ঠিক না। আমার বউএর কাছে। সেই মুহূর্তে আমি বাড়ি ছিলাম না। সে যখন কাজ সেরে চলে যাচ্ছে, তিনতলা কোয়ার্টার থেকে, সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাবার সময় আমার সাথে দেখাও হয়েছিল তাঁর। আমি তখন সিঁড়ি বেয়ে উঠছি। মুখোমুখি সৌম্যকান্তি সে। এক ঝলক তাকিয়ে আমার দিকে মিষ্টি কনফিডেন্ট হাসি ছুঁড়ে নেমে গেল সে।
তার দু তিন বছরের মধ্যেই সে এল শঙ্করের চেম্বারে।সেখানে বসি তখন। কুড়ি টাকা ফি দিয়ে দেখাল। তার পর ঝাঁপি থেকে বার করল তার সেই মোহন আর সুচারু লোভের ফণা।
এমনই বহুবার। শেষ এল আজকে।
এক এক করে বলি। আমি আর প্রণব। গলায় গলায় ভাব। প্রণবই খবর এনেছিল তার। একেবারে ছাপার অক্ষরে। পঞ্জিকার শেষের দিকের পাতায় তার ঠিকানা লেখা।
প্রণবের পছন্দ ট্রানজিস্টার। আমার পছন্দ রোলেক্স ঘড়ি। স্রেফ একটা পাঁচপয়সার পোস্ট কার্ডে নিজের ঠিকানা আর পছন্দের জিনিসটার নাম লিখে ডাকবাক্সে ফেললেই, দিন কুড়ির মাথায় ভিপি ডাকে এসে হাজির হবে সেই সাতরাজার ধন এক মাণিক।
এসেও ছিল। প্রণব টাকা জোগাড় করতে পারেনি বলে ভিপি ছাড়ান হয়নি ওর। আমারটা পোস্টম্যানকে টাকা দিয়ে ছাড়িয়েছিল মা। প্রণব বিজয়ীর হাসি হেসেছিল যখন জেনেছিল নগদ কুড়িটাকা দিয়ে ছাড়ানো আমার ঘড়িটা ছিল নেহাতই একটা খেলনা ঘড়ি।
অফিস থেকে ফিরে এই সব জেনে আমার গরিব বাবা, না পেটায়নি। শুধু ম্লান হেসে জানিয়েছিল তার কোন বন্ধুও নাকি ওই জলন্ধর থেকেই ছারপোকা মারার মেশিন আনিয়েছিল। যন্ত্রের আয়োজন খুব সামান্য। একটু বালির মত জিনিস আর দুখানা কাঠি। সঙ্গে ডিরেকশন, ছারপোকাটাকে কাঠি দিয়ে হাঁ করিয়ে ওষুধটা তার মুখে ঢেলে দিতে হবে কয়েকদানা।
আজকের কথাটা বলব। কিন্তু সেই গল্পগুলো বলার আগে অন্য দেখা হবার গল্পগুলো বলে নিই। একটু দাঁড়ান।
ওই যে বললাম না, আমার গিন্নির কাছে এসেছিল। সে বারে সে এসেছিল সেলসম্যান সেজে। একগাদা মেডিক্যাল জার্নাল তিন বছর ধরে দেবে ডাকযোগে মাত্র একশ টাকায়। প্রথম কিস্তি দিয়ে যবে আগামি কাল। যথারীতি অ্যাডভান্স নিয়ে সেই যে সে গেল, আর আসেনি। না সে, না সেই জার্নাল।
সে তো বহুরূপী। আরও একবার কিছুদিন বাদেই এল আমার গিন্নির কাছে। তার নাম তখন অতনু দাশ। সল বলে একটা কোম্পানি। তখন ভারি নাম ডাক তার। অলডে বলে একটা অ্যান্টিঅ্যালার্জিক আরও কী কী সব যেন ওষুধ ছিল তাদের। ভারি আন্তরিক সেই অতনু নানারকম বুঝিয়ে কীসব শেয়ার বেচে গেল আমার গিন্নিকে। হাই রিটার্ন। তার পরেই কোম্পানি নিজেকেই বিক্রি করে দিল অন্য কারও কাছে। উঠেই গেল তারপর। সেই সময়ে অনেক ডাক্তার সেই লোভের ফাঁদে পড়ে টাকা খুইয়েছিল।
শঙ্করের চেম্বারে যেটা ঘটল সেটা বলি। নিছকই ওষুধের দোকানে আলমারির পেছনে বসার কনভেনশনাল খুপরি সেটি।
অবাঙালি দেহাতি দম্পতি এলেন। মামুলি কিছু রোগ। দেখা শেষ। তার পরে হঠাৎই বসবার জায়গাটিতে দুরূহতম কোণে চলে গেলেন দুজনে। পুরুষটি জেব থেকে বার করলেন, রাণী ভিক্টোরিয়ার মাথার ছাপ ওয়ালা ১৮শ কত সালের কিছু মুদ্রা। আর একেবারে শেষে প্রায় কেজি পাঁচেক ওজনের একটা কী যেন বলে তাকে জানিও না ছাই, অসংখ্য সোনালি মটরদানার দিয়ে গাঁথা সাতনড়ি হার।
কী ব্যাপার? না ওঁরা নাকি নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন । সুদূর মুর্শিদাবাদে কোথায় হাইওয়ে তৈরি করতে গিয়ে এক মাটির ঢিবি নাকি পোড়ো ইটের স্তুপ খুঁড়ে এগুলো পেয়েছেন তাঁরা। আমি যদি চাই, এই হাজারটা মটরদানার একটা খুলে নিয়ে স্থানীয় স্যাকরাকে দিয়ে যাচাইও করে নিতে পারি। ওঁরা পুলিশ আর অন্যদের ভারি ভয় পান। তাই আমার হাতে নিতান্ত কম মূল্যে পাঁচ কেজি সোনার সেই অমূল্য সম্পদ অর্পণ করে আজই লালগোলা ধরে মুর্শিদাবাদে ফিরতে চান। সঙ্গে ফাউ হিসেবে পাবো সেই দুষ্প্রাপ্য মুদ্রাগুলি।
আমি কিন্তু তদ্দিনে সেয়ানা হয়ে গেছি। তাঁদের বললাম, – এত টাকা তো সঙ্গে নেই! বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলে কালকে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে দেব।
ফাঁদে পা দিইনি। তাঁরাও আর পরে আসেননি। কিন্তু আক্ষেপ হয়েছিল খুব। কেন সেটা পরে বলছি।
এ রকমেরই বহুবার। বারবার ঘটেছে। হয় মারাত্মক ভয় নয় দারুণ কোনও মনভোলানো লোভ। কিছু একটা এসে ঘায়েল করতে চেয়েছে আমাকে।
শেষবার ঘটল আজ। মোবাইলে মেসেজ এল রাত দশটায় ইলেকট্রিক বিল না দেবার জন্য আমার বাড়ির কারেন্ট কেটে দেওয়া হবে। তাঁদের দেওয়া নাম্বারে শশব্যস্ত হয়ে ফোন করলাম। তাঁরা আমার এটিএম কার্ডের নম্বর জানতে চাইলেন। দিলাম।
আসলে যা দিলাম সমাজ ও সংস্কৃতি বলে একটা বইয়ের আইএসবিএন নাম্বারের সঙ্গে আরও কিছু সংখ্যা লাগিয়ে মোট ষোলোটা ডিজিট।
তাঁরা মাত্র দশটাকা তাঁদের নির্দেশিত নম্বরে খুব তাড়াতাড়ি পাঠাতে বললেন। বারবার করে বললাম এই কার্ড থেকে তাঁদের দাবী মত টাকা দেওয়া যাবে না।
– কেনো, দেবা যাবেক না কেনো? উষ্মার সঙ্গে শুধোলেন অবাঙালি টানে কথা বলা তিনি।
সবিনয়ে বললাম, – আজ্ঞে আমার এটা সুইস ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড। ডলারে বা মার্কে নইলে সুইস মুদ্রায় পেমেন্ট করা যেতে পারে।
তিনি খানিক খটাখট আওয়াজের পর ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, – যান মোশাই, আপনার লাইন চালু কোরে দিলাম।
বলে একটু ক্ষোভের সঙ্গেই বললেন, – আর হ্যাঁ, এর পর একটা ইন্ডিয়ান কার্ড চালু করে নিবেন।
এতদিন ফোন ব্লক, এটিএম ব্লকের হুমকি এসএমএস আসত।
এবার তাঁরা ফিল্ড এক্সটেন্ড করেছেন। ইলেকট্রিসিটিকে আওতায় এনে ফেলেছেন। এর পর থেকে ওই নাম্বারে বহুবার ফোন করেও সাড়া পাচ্ছি না। সম্ভবত আমাকে ব্লক করেছেন তাঁরা।
সে যাই হোক। আক্ষেপের কথাটা বলি।
কেন? আমাকেই কেন? আমাকেই কেন বেছে নেয় এই জালিয়াতেরা? এত এত খড়দাবাসী ডাক্তারের মধ্যে কেন মনে হল, আমিই সেই উদ্দিষ্ট গাধাটি? রাশি রাশি বঙ্গবাসীর মধ্যেই বা কেন আমিই, পরিষেবা বন্ধের হুমকি পাই। রাশি রাশি ফেসবুকবাসীর মধ্যে আমাকেই বা কেন চিরতৃষিত গাধা ঠাউরোয় লোকে? কেন অন্তরঙ্গ সম্বোধনে ডেকে কিছুদিন বাদে ব্লক করে?