ঠিক দুই মাস হল সরকারী চাকরী থেকে অবসর নিয়েছি। এর মধ্যে বহু মানুষ জানতে চেয়েছেন, কেমন আছি বা কেমন লাগছে। কোন আশ্রমে বা মিশনে যোগ দিয়ে, দু মাসেই কি বলা যায়, কেমন আছেন? দু মাসেই কি আধ্যাত্মিক উপলব্ধি হয়ে যায়? একটা দীর্ঘ দিনের অভ্যাস থেকে নতুন জীবন ধারায় পৌঁছে সেটা কেমন লাগছে, বুঝতে একটু সময় লাগবেই।
আজ সকাল থেকেই বেশ মেঘলা, বর্ষা বাদলার দিন। আমার জানালার বাইরে দেখতে পাচ্ছি, কতো লোক কাজে যাচ্ছেন। সবাই সরকারী চাকরী করতে যাচ্ছেন তা তো নয়। বেসরকারি চাকরী, মিস্ত্রী, কাজের মাসি, আয়া, দোকানদার, কতো কি পেশা। আমার কিন্তু মনে হল গোপাল ভাঁড়ের একটি গল্প।
এক বর্ষা বাদলার রাতে গোপাল রাজবাড়ি থেকে বাড়ী ফিরছিল। রাস্তার একটু জল জমেছে, জোরে বৃষ্টি নামার জন্য, গোপাল এক সাধারণ মানুষের কুটিরের চালের তলায় ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। গোপালের পায়ের ছপ ছপ শব্দ শুনে কুটিরের ভেতরের মহিলা বললেন, একটা কুকুর না শেয়াল আমাদের ছাঁচে এসে দাঁড়াল। ঘরের লোকটি বলল, আরে না, নিশ্চয়ই রাজ কর্মচারি; ওরা ছাড়া এই দুর্যোগে কুকুর শেয়াল কেউ বেরোয় না।
সত্যিই কি আমাদের সেরকম দুরবস্থা ছিল? পিছন ফিয়ে তাকালে সেরকম কিছু দিনের কথা মনে পড়ে বৈকি। প্রথমে বর্ষার কথাই বলি।
কয়েক বছর আগে এক বর্ষার সকালে হাসপাতালে যাচ্ছিলাম। পার্ক সার্কাস স্টেশনে নেমে সাত আট মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাই। ছাতা ছিল, তাই একটু একটু বৃষ্টি পড়লেও হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু মাঝ পথে প্রচণ্ড বেগে বৃষ্টি নামল। আমি একটি বাড়ির শেডের নিচে দাঁড়িয়ে গেলাম। ক্রমশ বাড়ছে বৃষ্টি। সামনের রাস্তা দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখি রাস্তা দিয়ে আমার সহকর্মী এক লেডি ডাক্তার হাসপাতালের দিকে চলেছেন। ছাতা আছে, কিন্তু একেবারে কাক ভেজা যাকে বলে। বুঝলাম, আমার পরের কোন ট্রেনে এসে নেমেছেন, ছাতা খোলার আগেই ভিজে গেছেন। রাস্তায় না দাঁড়িয়ে ভিজে সোজা হাঁটা দিয়েছেন, হাসপাতালে পৌঁছে, অপারেশন থিয়েটারের পোশাক পরে নিতে পারবেন। প্রায় তিরিশ বছর এর চাকরী জীবনে অসংখ্য বার এমন কাক ভেজা হয়ে কাজে যেতে হয়েছে, বা কাজ থেকে ফিরেছি। আর কুকুর শেয়াল বেরোতে পারেনি এমন দিনে দুবার, রাজ কর্মচারি হয়ে পথে নামতে হয়েছিল।
আম্পানের দিন সকালে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। তখন কোভিডে লক ডাউন চলছে। নিজেই গাড়ী চালিয়ে গেছলাম। দুপুরে আমার পরে যে ভাইয়ের ডিউটি ছিল সে ঝড়ের ভয়ে আগেই এসে গেছে। খবর ছিল দুপুর আড়াইটার পর ঝড় বাড়বে। আমি দুটো নাগাদ গাড়ী চালিয়ে ফেরার রাস্তা ধরলাম। শহরের ভেতর দিয়ে আসতে তখন মিনিট কুড়ি লাগে, রাস্তা ফাঁকা। সেদিন তো ঝড়ের জন্য আরও ফাঁকা। শিয়ালদা আসতে আসতেই বৃষ্টি প্রচণ্ড বেড়ে গেল। তখন দাঁড়িয়ে গেলে সেদিন আর বাড়ী ফেরা হত না। প্রবল বেগে wiper চালিয়ে ছোটালাম গাড়ী। শ্যামবাজার আসার আগেই ঝড়ের বেগও বেড়ে গেল। তখন আবার টালা ব্রীজের কাজ চলছে, লকগেট দিয়ে আসতে হবে। পাখীর হাটের রাস্তা দিয়ে লকগেটে এসে দেখি বন্ধ। পাশের রাস্তা ধরে কাশীপুর ঘুরে এলাম। বাড়ী পৌঁছে গ্যারেজে গাড়ী ঢুকিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকতে গিয়েই টের পেলাম ঝড়ের গতিতে সব লণ্ড ভন্ড হচ্ছে। আমার যে রাজকর্মচারি ভাই আমাকে দুপুর দুটোর আগে ছেড়ে ডিউটি ধরেছিল, সে পরদিন দুপুর দুটোর আগে বাড়ী ফিরতে পারেনি। যাবে কি করে? গাছ পড়ে কলকাতার রাস্তা সব বন্ধ। পরের ডাক্তার হাসপাতালে না এলে ও তো আর বাড়ী যেতে পারে না।
লক ডাউনের প্রথম দিকে, এক রাত্রে গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে চলেছি। বেলগাছিয়া রোডে ওঠার আগে সিগন্যালে দাঁড়িয়েছি। এমন শুনশান কলকাতার রাস্তা আর কোনোদিন দেখিনি। সত্যিই রাস্তায় শেয়াল কুকুর নেই। হঠাৎ আমার পাশে একটি মোটর বাইক এসে দাঁড়াল। আরোহী ছেলেটি হিন্দিতে জানতে চাইল, শিয়ালদা কোন দিকে। বললাম, ডান দিকের রাস্তা ধরে যেতে। কিন্তু শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। এমন নির্জন রাতের রাস্তায় জীবনে আর কখনো বের হতে হবেনা। আমি তো আর রাজ কর্মচারি নই।
আজ সকাল থেকেই যে সকল রাজ কর্মচারি ভোটের ডিউটি করতে বেরোচ্ছেন তাঁদের কথা ভাবতে গিয়ে আমার মেজদার কথা মনে পড়ল। আমরা ঐদিন দুপুরে শিশু কন্যাকে কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি করেছি। রাত্রে হাসপাতালের পাশের দোকানে খেতে গিয়ে, ফট ফাট পটকার শব্দ শুনেছি। আমাদের খাওয়া হতেই দোকানদার বলল, আপনারা হাসপাতালে থাকবেন? তাড়াতাড়ি গিয়ে ঢুকে যান, শব্দ শুনছেন তো! মেজদা পরদিনও হাসপাতালে এল না। কি ব্যাপার? ছোড়দা জানাল, গতকাল কলকাতায় ভোট ছিল, মেজদা ভোট নিতে গেছল। বাড়ী ফিরে অসুস্থ হয়ে গেছে। ওদের বুথের সহকর্মী এক ভোটারকে আই কার্ড দেখাতে বলেছিলেন। আনছি বলে লোকটি ফিরে গিয়ে পিস্তল হাতে ফিরে আসে। দাদার পাশেই তাঁর সহকর্মী অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। যে সকল রাজ কর্মচারি আজ গণতন্ত্রের পবিত্র উৎসবে পুরোহিত হয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য আমার আজকের মত একটি নিশ্চিন্ত অবসরের প্রার্থনা করি।