To tell ‘tea tale’ on a tiptoe night ….
মরি হায় চা-দিবস চলিয়া যায় –যাব বললেই যেতে দিচ্ছে কে! রোজই চা এর দিন। রাত সাড়ে এগারটায় সব কাজ টাজ সেরে টেরে নিশ্চিন্তমনে চা যন্তর মন্তর সাজিয়ে বসি।
ডিনার সে হবে’খন পরে। একা–একাই বসি। Camelia Sinensis এর সঙ্গে গভীর ভালোবাসা, আলাপ প্রলাপ মুখোমুখি একা না বসলে ঠিক জমে না। কাপে ঠোঁট ছোঁয়ানোর ঠিক আগে যে তুরীয় প্রত্যাশার মুহূর্ত –তাকে ইংরেজরা যে কোনো নাম দেয়নি কেন কে জানে, ওরা তো সব সিচুয়েশনের একটা করে ইংরেজী শব্দ তৈরি করে।
ব্রিটিশরা টিপার্টি নিয়ে যতই গর্ব করুক চা-এর সঙ্গে ওদের পরিচয় মোটে চারশ বছর। ১৬৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটা ইংরেজী নিউজ পেপার প্রথম চায়ের কথা ঘোষণা করে –‘চীনদেশ থেকে কি একটা পানীয় এসেছে তাকে ওরা Tcha বলে, ওমুক কফি হাউসে পাওয়া যাচ্ছে’।
বরং ডাচরা চা ফ্যাশনে এগিয়ে ছিল। ব্রিটিশরা একটু গোঁড়া আর চিরকাল পূব দিকে তাকালে একটু নাক সিঁটকায়, যাচাই না করে ‘যাহা পাই তাহা খাই’ ব্র্যান্ড নয়। ডাচরা পূবদিকে এদেশে ওদেশে বাণিজ্য করতে যেত –ফেরার পথে চীনদেশ থেকে চা উপহার আনত। রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সঙ্গে পর্তুগীজ রাজকন্যা ক্যাথরিনের বিয়ে হল। রাণীর চায়ের নেশা চরম –রাণীর মর্জিতে এবার ব্রিটেনে ধীরে ধীরে চা -এর দরজা খুলল । ওদের একবার কোনো জিনিষ যদি পছন্দ হয়ে যায় তার উপর হামলে পড়বেই –সে চা হোক বা কোহিনূর।
চীনদেশে নাকি খ্রীস্টপূর্ব ২৭৩৭ সালে রাজা শেন নাং দৈবাৎ আবিষ্কার করেন –চা একটি অতি সুখের পানীয়।
সেই প্রাচীন কাল থেকে চীনে চা চলত।
কি কান্ড –কাগজ, কম্পাস, ছাপাখানা, বারুদ, চা –এবং করোনা –সবেতেই দেখি চীন প্রথম।
চায়ের মৌতাত জমলে কথায় কথায় কত কথা বলে ফেলি। ফার্স্ট ফ্লাশ, সেকেন্ড ফ্লাশ সবসময় জোটে না , জুটলে কাপ -কেটলি চেটে চেটে খাই। ফ্লেভার ঠিকঠাক হওয়া চাই, না হলে স্নায়ু বেয়ে মাথায় ঠিক কিক ক্লিক কিছুই হয় না, ব্রেনে পিত্তি উঠে যায়, অক্সিজেনও কম যেতে পারে–যাকে তাকে যা ইচ্ছে বলে দিতে পারি।
ভালো চা পাতার অণু পরমাণু নির্যাস শুষে নিতে হলে পাতা ভেজানো শিখতে হবে। রোজ সকালে উঠে স্বরলিপি দেখে দেখে রেওয়াজ করার মতো। এমন চা হাতে ব্যালকনিতে বেতের চেয়ারে বসতে হয়। চায়ে চুমুক দেবার আগে রেলিঙের পেটুক শালিকটা বিস্কুট চাইবে –তাকে ব্রিটিনিয়া মেরির ভাগ একটু দিতে হবে। তখনই সব্জিয়ালা হেঁকে যাবে –মনে পড়বে ‘এইরে ঝুড়িতে আলু নেই তো ‘ — ছুটব চা ফেলে। ফিরে এসে চা জুড়িয়ে জল।
বিকেলে চায়ের জন্য বরাদ্দ সময় নেই। ইভনিং টি সেই রাত সাড়ে এগারটা।
আর চাই ভালো কাপ।
কাঁসার গ্লাসে যদি কেউ দুনিয়ার সবচেয়ে দামী চা দেয় –ব্যাপারটা কি দাঁড়াবে ভাবুন!
ভালো মানে সবসময় দামী নয়। আমাদের চিত্রালয় রথের মেলায় তক্কে তক্কে থাকলে জলের দামে ভালো কাপ ডিশ পাওয়া যায়। কোনো সেটের দু চার পিস ভেঙে সেট কানা হয়ে গেলে বাকিগুলো জলের দামে বেচে।
কাছে পিঠে হ্যান্ডমেড সেরামিকসের আউটলেটগুলোও একটু জেনে রাখা ভাল। শান্তিনেকেতনে যাওয়ার পথে ইলামবাজার জঙ্গল পেরিয়ে Confetti একটা ডেস্টিনেশন হতেই পারে। পুরো শো রুমটাই কিনে নিতে ইচ্ছে করবে। অবাক হয়ে দেখি কারিগররা হয়তো এক বিন্দু ইন্ডিগো ব্লু ছেড়ে দেয় হালকা সি গ্রীনের কানায় –রঙটা কেমন চুঁইয়ে পড়ে নিজেই নক্সা তোলে।
লোনভলা থেকে ফেরার পথে কত যে নতুন ধরনের ব্যাঁকাটেরা কাপ কিনেছি –ওই imperfection টাই ডিজাইন। অনেক রকম কাপ জমাই। কাপ বদল করি কদিন পর। চা আমি নিজেই বানাই, অন্য কারো হাতে পছন্দ হয় না। এ রান্নার কোনো রেসিপি হয় না। ওই যে, ,,সুর সেধে ঠিক সরগমে ফেলতে হবে –কোমল গান্ধার ছুঁয়ে শুদ্ধ মধ্যমের পরে মীড় টেনে নিষাদ।
আমাদের ওপিডি যখন ভীড়ের চাপে ভেঙে পড়ে আর কি , এমার্জেন্সিতে যখন সব মর মর পেশেন্ট — চা-ছিল মৃত সঞ্জীবনী। জিডিএ ভাই বলত –দিদি চা আনি? নোংরা কেটলিতে আসত অখাদ্য পেঁপেপাতা সেদ্ধ কালো চা। হয়তো গত চার পাঁচ ছয় ঘন্টা ঢোঁক গেলার ফুরসত মেলেনি। কাপে ঢাললে, ওই ধোঁয়া ওঠা দেখলেই মনে হত –এবার খাবি খাওয়া রুগীও বেঁচে যাবে।
এ হেন ভদ্রমহিলাটি স্টুডেন্ট লাইফে চা খেত না –কি বিদঘুটে ছিল রে বাবা।। বন্ধুরা যখন বলত –চল, ক্যান্টিনে যাই –সঙ্গ দিত বটে কিন্তু চরম বেরসিকের মতো নটি নোটি naughty no-tea হয়ে বসে থাকত। না-চা বন্ধুটিকে চা ধরাতে না পেরে রুমমেট শ্যামা নাচার হয়ে গিয়েছিল।
পরে কবে যে সে চা ধরল মনে নেই –‘when she was in the middle she came to know that she has started’ and addicted ….
এমনই addiction, যে সামনে বসে অচেনা কেউ ফ্লাস্ক খুলে চা খেলে প্রায় চেয়ে খায় আর কি!
দুনিয়াতে দু’ধরনের লোক–যারা চা ভালোবাসে তারা রামধনুতে সাতরঙ দেখে, চাঁপাফুলের গন্ধ পায় –আর যারা নো-টি র দলে তাদের নিগঘাত জ্যোৎস্নারাতে পেট কামড়ায় ,মাথায় উকুনও হতে পারে।
তবে ওই নুন গোলমরিচ চা পোষায় না বাপু –কেমন হাফ বয়েল ডিমসেদ্ধর গন্ধ পাই। হার্বাল টি মোটেই না –কখনো বাণপ্রস্থে গেলে তখন না হয় ভেবে দেখব। গ্রীণ টি-তেও আমার মস্ত বড় “নো ” — অত আয়ু বাড়িয়ে কাজ নেই অক্সিজেন কমে আসছে পৃথিবীতে। দুধ চায়ের আবেশ ওড়না খোলে সবসময় নয় –শুধু অপার্থিব কিছু মুহূর্তে। যেমন -কেদারনাথের পথে হাঁটার সময় ঠান্ডায় হাত পা অসাড় হয়ে যাচ্ছে, ঝুপঝুপ বৃষ্টি –হনুমান চটির ছেঁড়া নোংরা জোব্বা পরা চটিয়ালা ফুটন্ত কড়া দুধ চা গ্লাসে ঢেলে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন, হাতে এসেই ফুটন্ত চা মিইয়ে জল –তবু সেই চটিয়ালা ঈশ্বর আর গ্লাসের চা তখন ইন্দ্রসভার পানীয়। অথবা শীতের ভোর রাতে কাজিরাঙ্গা জঙ্গল ঘুরে এসে হাতে গরম আসাম সুগন্ধ –দুধ তখন চায়ের সঙ্গে যেন এস্রাজের সুর। অথবা সেই কোজাগরী পূর্ণিমার রাত, পেলিঙে পূর্ণ মহিমায় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে বসে থাকা আপার হেলিপ্যাডের টেবিলটপে –জনমানুষ নেই, হি হি করে কাঁপছি তবু ভূতে পাওয়ার মতো নড়তে পারছি না রাত দুটোতেও –গায়ে লাগা রণজিৎদার হোটেল, ভাবনা গুরুং গোবদা মাগে এলাচ দারচিনি দেওয়া ‘কড়াক চায়ে” হাতে ধরিয়ে দিল –স্বর্গীয় সবটাই। পুরুলিয়ার গ্রামের পথে সেই ছোট ঝুপড়ি, বাঁশের বেঞ্চি –মাধ্যমিক পাশ ফ্যাকাশে বউটি যখন অখাদ্য চা হাতে তুলে দিয়ে বলে –এদিকে তো ভালো পাতা পাওয়া যায় না, অত দামে খাবেও না কেউ, আপনাদের এ চা দিতে সংকোচ হয় –তার সেই মলিন মুখের সংকোচ টুকুই যেন অ্যাডিশনাল ফ্লেভার যোগ করে, সস্তার পাউডার দুধও তুচ্ছ হয়ে যায়।
আমাদের ছোটবেলার রাতসফরের ট্রেন –কাঁচের জানালার ওদিকে ঘুম চোখে চাআআ গর্ম চাআআ গর্ম – কেটলিহাতে যারা ঘুরত তারা যেন অন্য কোন জগতের , চোখের পলক পড়ত কিনা ঠিক দেখা হয়নি –বাবার স্বগতোক্তি মোগলসরাই এল বুঝি, ইঞ্জিন বদলাবে, বাবা রাত দুটোতেও এক ভাঁড় চা জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে নেবে–সেই চাগর্ম আর আসে না, অনেক স্মৃতির মোগলসরাই জাংশনও চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে, আর কোনদিন আসবে না।
রসিক যে জন সেই জানে –জীবনে, মুখোমুখি বসিবার থাকে শুধু চায়ের কাপ ।