আজ আমাদের অনশন সহস্র দিনে পড়ল। আজ মেগা অভিযান। আজ নবান্ন অভিযান।
আমাদের দলে মুখ্যমন্ত্রী আছেন। বিরোধী দলনেতা আছেন। সবাই স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে চলেছেন।
‘এই দুর্নীতি মানি না। এই দুর্নীতির অবসান চাই। যারা জেলে আছেন তাদের শাস্তি চাই। যারা বাইরে আছেন তাদের নিরাপত্তা চাই’।
‘এগুলো সবই বিরোধীদের ষড়যন্ত্র। আমরা বাংলাকে ভাগ হতে দেব না। চলো সবাই নবান্ন চলো’। মুখ্যমন্ত্রী বললেন।
‘সকল টেট বিজেতা এবং তাদের পরিবারের লোকেদের চাকরির দাবি করছি। নবান্ন ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও। নেতাদের চেয়ার থেকে টেনে নামাও’। বিরোধী দলনেতা বললেন।
এমন সময় দেখি একজন হাড্ডিসার লোক চেঁচিয়ে বলছে, ‘হালার মাহাজনরে ফ্যালাইয়া মারো। জিন্দা পুইত্যা দাও’।
আরে এ তো হাড্ডি খিজির। ও এখানে কী করছে?
‘এই খিজির আলি। তুমি এখানে কী করছ? কে মাহাজন? দেখছ না আমরা এখানে টেট বিজেতারা আন্দোলন করছি। দেখছ না মুখ্যমন্ত্রী আমাদের পাশে আছেন। বিরোধী দলনেতা আমাদের পাশে আছেন’।
খিজির শুনেছে কি শোনে নি জানি না। সে আরো চিৎকার দিতে দিতে মিছিলের সাথে সাথে এগিয়ে যায়।
এদিকে পুলিশ বিরাট বিরাট জলকামান নিয়ে এগিয়ে আসছে। সাঁজোয়া গাড়ি করে এগিয়ে আসছে উর্দিধারী মিলিটারি। কী জানি কেন তারা সবাই উর্দূতে কথা বলছে। বুঝতে পারছি না।
মিছিল এগিয়ে চলে ধর্মতলার দিকে। ধর্মতলায় বিরাট এক মঞ্চ করা হয়েছে। তার মাথার ওপরে বিরাট পোস্টার। লেখা ‘সারা ভারত গণতান্ত্রিক শহিদ সমাবেশ’। মঞ্চের একদিকে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা সাদা চুলের একজন বৃদ্ধ নেতা বসে সিগারেট খাচ্ছেন। মাঝে মাঝে মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে তুলে কাশতে কাশতে স্লোগান দিচ্ছেন।
মঞ্চের অন্য দিকে মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতা বসে মুখে হাত দিয়ে কিসব কথা বলছেন।
মঞ্চের নিচেই দাঁড়িয়ে আছে সেই মেয়েটি। গত সহস্র দিন যাকে আমি দেখেছি। গতকাল সবে যার সাথে ইনিয়ে বিনিয়ে এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে পারলাম। আজ সে একটা লাল রঙের সালোয়ার পরে এসেছে। আর কিছু করার নেই। আমাকে সামনে এগিয়ে যেতেই হবে।
হঠাৎ নিজের দিকে চোখ পড়ল। দেখলাম আমার কোনো অঙ্গবস্ত্র নেই। হা কপাল। এই অবস্থায় আমি সামনে যাই কী করে? অথচ আমাকে যেভাবেই হোক মঞ্চে উঠতে হবে। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বক্তৃতা দিতে হবে।
কী লজ্জার ব্যাপার! গায়ে জামাকাপড় না দিয়েই কিভাবে বেরিয়ে পড়লাম? আমার কী বিন্দুমাত্র কমন সেন্স নেই?
এদিকে মিছিলের সকলের গলার স্বর ক্রমশ চড়া হয়েই চলেছে। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে আছি বলে মনে হচ্ছে। অথচ আমাকে যে আগে যেতেই হবে। পাশের টেট বিজেতা ছেলেটি একটি গামছা পরে আছে। ভিড়ের মধ্যে আমি তার গামছাটাই টেনে পরে নিলাম। ছেলেটি হাত তুলে স্লোগান দিতে এত ব্যস্ত যে সে বুঝতেও পারল না।
আমি গামছাকে কোমরে জড়িয়ে খালি গায়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এতক্ষণে আমার কনফিডেন্স আবার যেন ফিরে পাচ্ছি। আমার লজ্জাটা কেটে গেছে। মঞ্চের ওপর মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন একজন বিচারক। তার মাথায় সাদা উইগ। তিনি একটি কাঠের হাতুড়ি খুব জোরে জোরে টেবিলে মারছেন আর বলছেন, ‘অর্ডার। অর্ডার’।
তার হাতুড়ির ঘায়ে চারিদিকে ধুলোয় ঢেকে যাচ্ছে। হবে না, ধর্মতলায় যা পলিউশন! সেই ধুলোর মধ্যে দেখা যাচ্ছে আমাদের বাড়িতে টিভি চলছে। আমরা সবাই মা, বাবা, বোন একসাথে বসে টিভিতে লাইভ নবান্ন অভিযান দেখছি।
বোন হঠাৎ করে বলে উঠল, ‘সত্যি, দাদাটা না কেমন যেন? কোথায় একটু সেজেগুজে যাবে তা না। একটা গামছা পরে চলে গেছে!’
বাবা বলল, ‘আরে ওর মাথায় কত চাপ বল। গামছা পরে গেছে এই অনেক’।
আমি ওদের পাশে বসে মিটিমিটি হাসতে থাকি। বোনও আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল।
এদিকে সভা জমে গেছে। আমি গামছা পরেই ডায়াসের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমি এগিয়ে যেতেই সবার মধ্যে আলোড়ন বেড়ে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখি মুখ্যমন্ত্রী আর বিরোধী দলনেতার মাঝের চেয়ারটা ফাঁকা। মুখ্যমন্ত্রী আমাকে হাসিমুখে ইশারায় ডাকছেন ওর পাশে বসার জন্য।
আমি দ্বিধাগ্রস্ত। কী করব বুঝে পাচ্ছি না। এমন সময় একটি বিরাট প্লায়ার আর একটি দৈত্যাকৃতি সাইকেলের চেন আছড়ে পড়ল মঞ্চের ওপর। ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘ওইদিকে তাকান ক্যালায়? কন কন আপনাগো লগে মাহাজন কেমন উংলি করসে হেই কথা কন’।
আরে মহা সমস্যা হলো তো। খিজির আলি এটা অন্য আন্দোলন। এটা আমাদের জীবনমরণের লড়াই। আপনি ভুল করে এই মিছিলে ঢুকে পড়েছেন।
নীচে থেকে লাল সালোয়ার পরা টেট বিজেতা মেয়েটিও বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ, খিজির আলি তুমি শান্ত হও। মাহাজনের ব্যাপারে আমরা পরে আসছি’।
ওর ওই একটি কথায় আমার সারা শরীরে যেন হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ খেলে গেল। গামছা-টামছা পুড়ে গেল কিনা কে জানে? গেলে যাক। আমি দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে মাইকটা পুরুষাঙ্গের মতো চেপে ধরলাম।