‘এই ই সি জি-টা দেখে একটু বলবেন প্লিজ – ঠিক আছে কি না।’
‘ই সি জি তে কোনো গন্ডগোল নেই তো ডাক্তার বাবু?’
ইসিজি-র লম্বা ফিতের মত কাগজটা দেখিয়ে এরকম অনুরোধ বা প্রশ্ন অনেকেই করে থাকেন। ডাক্তারকে ই সি জি নিয়ে প্রশ্ন করা হবে- এতে আর কি অস্বাভাবিক আছে?
কিন্তু একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞকে একটা এক্স-রে প্লেট দেখিয়ে প্রশ্ন করুন তো- এতে হাড়ের মধ্যে পূঁজ দেখা যাচ্ছে কি না? তিনি সম্ভবতঃ বলতে পারবেন না। বলতে পারলেও উত্তরটা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, চক্ষু বিশেষজ্ঞ বহুদিন হাড়ের এক্স-রে নিয়ে চর্চা করেন না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই হাড়ের ভিতর পূঁজ জমে থাকলে এক্স-রে তে কিরকম দেখতে হয়- সেটা তিনি ভুলে গেছেন। ঠিক তেমনই একজন কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ- যিনি হয়ত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কাজে সারা পৃথিবীর বড় বড় হাসপাতালে চষে বেড়ান- তাঁর পক্ষে বোঝা সম্ভব না, অপথালমোস্কোপের মধ্যে দিয়ে রেটিনাকে কেমন দেখতে লাগে!
কিন্তু ই সি জি-র বিষয়টা এরকম নয়। সব ডাক্তারকে ই সি জি-র আদ্যপ্রান্ত বুঝতে হবে- মোটামুটি এটাই এখানে দস্তুর। এমনকি বিয়েবাড়ির নেমন্তন্নে গিয়েও লোকে পকেট থেকে ই সি জি-র লম্বা ফিতে বের করে আমার মতামত জানতে চেয়েছে। তারপর – এটা আমি কিছু বুঝি না- এই উত্তর শুনে প্রবল সন্দেহের চোখে আমাকে দেখেছে। তাই আজকাল আমি হাতে সময় থাকলেও নেমন্তন্ন বাড়িতে দেরি করে যাই। পৌঁছেই উপহার দিয়ে তক্ষুনি খেতে বসে যাই এবং খাওয়া শেষ করেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে পড়ি।
এমনিতেই অস্থিবিশেষজ্ঞদের ইসিজি দেখা নিয়ে মজার মজার গল্প প্রচলিত আছে, যার কয়েকটা বেশ সন্মানহানিকর। যেমন, মেডিক্যাল রিসার্চ-এ ‘ডাবল ব্লাইন্ড ষ্টাডি’-র প্রকৃষ্ট উদাহরণ নাকি- দুজন অস্থিবিশেষজ্ঞ একসঙ্গে একটা ই সি জি পড়ার চেষ্টা করছে! আপনারাই বলুন, এগুলো কি ঠিক? কোনো হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ কি হাতের হাড় ভাঙার একটা এক্সরে প্লেট দেখে বলতে পারবেন যে, কোন ক্ষেত্রে অপারেশন করতে হবে, আর কোন ক্ষেত্রে প্লাষ্টারেই কাজ হয়ে যাবে? না, কেউ তাঁদের থেকে এরকম আশাও করে না।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের থেকে আমি সবসময়েই সসম্ভ্রমে একটু দূরে থাকার চেষ্টা করি। তবে ভবিষ্যতে হয়তো অত দূরে সরে থাকা সম্ভব হবে না। কারণ আমারও একটা হৃদযন্ত্র আছে। কেউই বিশ্বাস করে না যে আমি শেষ ই সি জি পড়েছি (হাতে করে ধরে পড়ার ভান করা নয়) নয় নয় করে আঠেরো বছর আগে। যখন আমি প্ল্যাব পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তার পর থেকে শুধুই হাড়ের হ্যাভারশিয়ান সিষ্টেমে ঘোরাঘুরি। যেখানে ই সি জি-র প্রবেশ একেবারে নিষেধ। তাই বলে কি মেডিসিন ও হৃদরোগ ছাড়া অন্য বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের ইসিজি-র কিছুই জানার প্রয়োজন নেই? তা নয়। ই সি জি স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক সেটা তো দেখে বুঝতে হবে এবং প্রয়োজনে রোগীকে উপযুক্ত বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাতে হবে!
সব শেষে একটা দুঃখজনক অধ্যায় বর্ণনা করে এই লেখা শেষ করি।
মাঝে মাঝে বুকে ব্যথা হচ্ছিল আমার এক বন্ধুর। রুটিনমাফিক অ্যান্টাসিড পর্ব শেষ করে তিনি তখন একটা ই সি জি করিয়েছেন। এক অনুষ্ঠানে পানভোজনের ফাঁকে তিনি পকেট থেকে ই সি জি-র ফিতেটা বের করে বললেন, ‘কদিন যাবৎ খুব গ্যাস হচ্ছে। প্যান ডি খেয়ে কমছে না। তাই একটা ই সি জি করিয়েছি। দেখুন তো, সব ঠিক আছে কি না। ডাক্তারের কাছে গেলেই তো এখুনি একগাদা ওষুধ লিখে দেবে!’
ই সি জি-র রিপোর্ট নেই। কিন্তু ফিতেটা দেখে আমার বেশ অস্বাভাবিক মনে হল। হৃদযন্ত্রের রক্তসঞ্চালনে সমস্যা হলে এরকম হতে পারে। আমি বললাম, ‘আমার তো দেখে বেশ সমস্যা আছে বলে মনে হচ্ছে। আর দেরী না করে একজন হার্টের ডাক্তারকে দেখিয়ে নিন।’
‘আবার হার্টের ডাক্তার কেন? আপনিই বলুন না!’
‘আমি তো হাড়ের ডাক্তার, হার্টের নই।’
এরপর বেশ কিছুদিন আমাদের দেখা হয় নি। পরে আমি শুনি যে, মাঝে ওই ব্যক্তি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দু-তিনটে হাসপাতাল ঘুরে শেষ পর্যন্ত অ্যাঞ্জিওপ্লাষ্টি করিয়েছিলেন এবং সব জায়গায় বলে বেড়িয়েছিলেন যে তাঁর বন্ধু ডাক্তার ই সি জি দেখে কিচ্ছু বুঝতে পারে নি। তাই তার এই অবস্থা!