সংলাপ ৩
.
(সংলাপ ৩ থেকে শুরু নয়কো মোটেই, সংলাপ ২ আর সংলাপ ১ আগেই গেছে। এ হল একজিমা প্রায় সেরে ওঠা, থুড়ি, কমে যাবার পরে শিশুর বাবা বা মায়ের সঙ্গে ডাক্তারের কথোপকথন। আগে সংলাপ দুটো আছে আমার দেওয়ালেই, আজ-কাল-পরশুর সংলাপ।)
.
— কেমন আছে আপনার মেয়ে?
— এই তো দেখুন, এখন দিব্যি আছে, চুলকানি নেই। চামড়াটা একটু শুকনো, মুখের পুরনো চুলকানির জায়গাগুলো কেমন কালচে হয়ে গেছে। আর দেখুন, মুখে-গলায় কেমন একটা সাদা সাদা দাগ—কী এটা?
— ওটার নাম পিটিরিয়াসিস অ্যালবা। নাম শুনে ঘাবড়ে যাবেন না, ওগুলো শ্বেতি বা তেমন কিছু সিরিয়াস নয়, ওষুধ দিলে কমবে, কদিন পরা আবার হবে, কিন্তু শেষমেশ ঠিক সেরে যাবে।
— আচ্ছা ডাক্তারবাবু, আপনি কী করে ধরলেন এটা অ্যাটোপিক একজিমা? অন্য কোনো চর্মরোগ নয়? কোনো টেস্টও তো করালেন না দেখলাম।
— ও বাবা, সে তো বিরাট গল্প, মোটা বই আছে সে নিয়ে। তার মোদ্দা কথাগুলো অবশ্য আপনার বোঝার মতো করে বাংলা ভাষায় বলা যায়, কিন্তু মেডিকেল কলেজের লেকচারের মতো হবে, আগেই হুঁশিয়ারি দিচ্ছি।
.
অ্যাটোপিক একজিমার ডায়াগনোসিস মূলত ক্লিনিক্যাল, অর্থাৎ রোগের ইতিহাস শুনে, রোগীকে পরীক্ষা করে এই রোগ ধরা যায়। কিছু রক্ত ইত্যাদি পরীক্ষা করতে হতে পারে, তবে সেটা রোগ ধরার জন্য নয়, চিকিৎসার সুবিধার জন্য, রোগের জটিলতা ধরার জন্য, বা ঐরকম নানা কারণে।
.
ক্লিনিকালি কী কী দেখি আমরা? প্রথম কথা হল, অ্যাটোপিক একজিমায় বেশ কিছুদিন ধরে চুলকাবে, বা, একবার হয়তো চুলকানি কমবে, কিন্তু আবার চুলকানি শুরু হবে, চট করে পুরো সারবে না। দ্বিতীয় দেখার জিনিস হলো কোন বয়সে হচ্ছে, আর কোথায় হচ্ছে। শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে রোগ শুরু হয় ৫ বছর বয়সের মধ্যে। এক বছর বয়সের মধ্যে হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, যেমন আপনার মেয়ের হয়েছে। আর এক বছরের মধ্যে বয়সীদের রোগ শুরু হয় সাধারণত মুখে ও মাথায়, বিশেষ করে দুটো গাল, কপাল—এইসব জায়গায় চুলকায়, লাল হয়ে যায়, একটু খোসা-ওঠা ভাব থাকতে পারে, সামান্য রস কাটতে পারে। গায়ে, মানে আমরা যাকে ধড় বা দেহকাণ্ড বলি, সেখানে হতে পারে, হাতে পায়ের বাইরের দিকেও হতে পারে। মুখ-মাথার বাইরে এসব জায়গায় হলে বুঝতে হবে রোগটা একটু বেশি তীব্র, অথবা প্রথম অবস্থায় যত্ন নেওয়া হয় নি, হয়তো ভাবা হয়েছে রোগটা চামড়ায় বেরিয়ে গেলেই ভাল। তবে মুখ-মাথা-ধড়-হাত-পা, যেখানেই হোক, চুলকানি, লালভাব, খোসা-ওঠা, রস কাটা—এসব থাকে।
.
যেমন বয়স বাড়তে থাকে রোগের জায়গা ও চরিত্র বদলাতে থাকে। একটু বড়ো বয়সে, মানে মোটামুটি একবছর থেকে পাঁচবছর পর্যন্ত, রোগ শুরু হলে বা আগে শুরু হওয়া রোগ না সারলে, মুখের চামড়া হয়তো ঠিক থাকে, কিন্তু হাতের কনুই আর পায়ের হাঁটু– এদের ভাঁজের দিকটায়, কব্জির সামনের দিকে, গোড়ালিতে চুলকায়। আগের মতো ততোটা লাল হয় না, বরং চুলকে চুলকে চামড়াটা খানিক মোটা আর কালো হয়ে যায়, জায়গাটা শুকনো খড়ি-ওঠা মতন হয়, রস কাটার সম্ভাবনা কম। আরেকটু বেশি বয়সে, ধরুন দশ-বারো বছর বয়সে, এইরকম প্যাটার্নই বজায় থাকে, কিন্তু তার সঙ্গে আবার মুখ, হাত-পায়ের পাতা ও আঙ্গুলে একজিমা দেখা দিতে পারে। আর গোল-গোল চাকা-চাকা লালচে-কালো একটু উঁচু দাগ, দেখলে হঠাৎ দাদ বলে ভুল হয়, এমন ‘মুদ্রাকৃতি একজিমা’ দেখা যায় একবছর বয়স থেকে পরে যে কোনো বয়সে। বেশি বয়সে অ্যাটোপিক একজিমা নানান রূপ নিতে পারে, আর তেমন বেশি লোকের হয়ও না, তাই সেটা নিয়ে আর বলছি না।
.
যে কোনো বয়সে এছাড়াও দেখা যায় সাধারণভাবে শুকনো ত্বক, বা কোনো কোনো সময় শুকনো ত্বকের ওপর মাছের আঁশের মতো দাগ (ইকথিওসিস), হাত-পায়ের পাতায় অনেক রেখা অগভীর রেখা, নানা জায়গায় চামড়ার ওপরের স্তর মোটা হবার ফলে কালো দাগ, এবং লোমকূপে শক্ত কাঁটা-কাঁটা ভাব, যাকে বাংলায় ‘পদ্মকাঁটা’ বলার চল আছে। অবশ্য ‘পদ্মকাঁটা’ আরও অনেক কারণে হতে পারে। মুখে ঘাড়ে হাতে সাদা সাদা ছোপ হতে পারে, আমরা বলি পিটিরিয়াসিস অ্যালবা, সেটাও অ্যাটোপিক একজিমা ছাড়া অন্য কারণে হতে পারে। এছাড়াও অনেক ছোটোখাট দেখার জিনিস আছে।
.
ইতিহাস নেবার সময় মনে রাখতে হবে, রোগীর নিজের বা তার কোনো রক্তসম্পর্কিত নিকটাত্মীয়, যথা মা-বাবা ভাই বোন ইত্যাদির কোনো অ্যাটোপিক রোগ আছে বা ছিল কিনা।
.
— আপনাকে খামোকা বকালাম, এত কিছু মনে থাকবে না ডাক্তারবাবু। কিন্তু আমার ভাগ্নে, ঐ যে মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করল এই জুলাইতে, বলছিল এটা সেবোরিক না কি যেন বলে, সেই একজিমা হতে পারে। বাচ্চাদের ডিপার্টমেন্টে এরকম দেখেছে নাকি।
— হ্যাঁ, অনেক সময় সেবোরিক ডার্মাটাইটিস বা সেবোরিক একজিমা থেকে অ্যাটোপিক একজিমাকে আলাদা করে চেনা শক্ত, যদিও আপনার মেয়ের কেসটা সোজাসাপটা অ্যাটোপিক। আপনার মনে রাখা সম্ভব নয়, তবু বলে দিই, বাচ্চা বয়সের সেবোরিক ডার্মাটাইটিস চোখের ভ্রু, নাকের পাশ, কানের পেছন, কুঁচকি, বগল, আর মাথায় লালচে খোসা-ওঠা হয়, মাথায় খুস্কির মতো দেখায়, আর অ্যাটোপিকের মতো এতটা চুলকানি সাধারণত হয় না। একবছর বয়সের পর সেবোরিক ডার্মাটাইটিস নিজে নিজেই সেরে উঠতে থাকে, অবশ্য কোনো অ্যাটোপিকও ওভাবে সেরে উঠতে পারে।
.
এছাড়াও অ্যাটোপিক একজিমার সঙ্গে গুলিয়ে যেতে পারে অন্য কিছু রোগও। স্পর্শজনিত একজিমা, সোরিয়াসিস, দাদ আর খোস বা স্কেবিজ— এদেরকে একবার দেখেই অ্যাটোপিক একজিমার থেকে আলাদা করতে সবসময় পারা যায় না। তবে কয়েকবার যত্ন করে দেখলে, রোগের ইতিহাস খুঁটিয়ে শুনলে, ভুল হবার চান্স কম।
.
— আপনি বেশ ভালোই পড়ালেন, কিন্তু আমার কিছু মনে থাকলে হয়! তবে বুঝলাম, অভিজ্ঞ ডাক্তার যত্ন নিয়ে দেখলে রোগটা প্রায় সবসময়েই ধরতে পারেন, আর গুচ্ছের পরীক্ষার দরকার নেই। কিন্তু আমার মেয়েরই এমন একটা রোগ হলো …
— অ্যাটোপিক একজিমা খুব কমন রোগ। আমাদের দেশে পরিসংখ্যানের অভাব, কিন্তু আমেরিকান বিশেষজ্ঞ সংস্থা বলছে, ওদের দেশে শতকরা ১৫ ভাগ বাচ্চার অ্যাটোপিক একজিমা হয়। এটাকে তেমন ‘দুর্ভাগ্য’ মনে করার চাইতে বরং ভাবুন, আপনার ‘সৌভাগ্য’ যে মেয়ের একজিমাটা বেশি তীব্র নয়, তাড়াতাড়ি ধরা পড়েছে, আর ওষুধে রোগটা খুব ভাল সাড়া দিয়েছে। এবার নিয়ম মতো দেখিয়ে যাওয়া আর দরকার মতো ওষুধ কমানো-বাড়ানো, ব্যাস!