কথায় বলে, জনমানসের স্মৃতি খুব দুর্বল। বড়জোর দুটো প্রজন্ম। অথবা তার চেয়ে একটু বেশী। যা মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় অথবা শ্রুতির অভিজ্ঞতায় প্রাপ্ত। তার বেশী নয়। প্রাচীনকালে মানুষ শ্রুতিধর ছিল। মহাকাব্য, শ্লোক, কীর্তন প্রভৃতি শ্রুতির শিক্ষায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রবাহিত হত। কারণ লেখার সরঞ্জাম-অর্থ্যাৎ প্যপিরাস, পার্চমেন্ট, ভূর্জপত্র, তালপাতা ছিল সীমিত।
মানুষের শ্রুতির সে ক্ষমতা লোপ পেয়েছে বহুকাল। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধের কাহিনী আবছা হলেও আজকের প্রজন্মের বেশীরভাগ লোক জানে। কারণ এই ঘটনার জাতীয় বা আন্তর্জাতিক প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। কিন্তু তার থেকে কিছু কম প্রভাবশালী ঘটনা, যা ওর কাছাকাছি সময়ে ঘটেছিল? যেমন ১৯৭০-এর বন্যা। আসাম বা ওড়িশায় ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর জাতিদাঙ্গা। কতজনের মনে আছে এসব? এই ধরণের দুঃখজনক এবং খারাপ ঘটনা আমরা হয়ত মনে রাখতে চাই না। কিন্তু না চাইলেও এইসব দুঃসহ স্মৃতিরও প্রয়োজন আছে- এর থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে এই ধরণের ঘটনা প্রতিহত করার জন্য। ধান-ভানতে-শিবের গীত অনেক গাইলাম। এবার আসল প্রসঙ্গে আসি।
কোভিড যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঈর্ষনীয় সাফল্যের একটা কারণ ওদের অতীতের থেকে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ এবং ক্ষমতা। ২০০৩ সালের সার্সের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এবং তার পরে ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু মহামারীর স্মৃতির প্রতিবর্ত ক্রিয়া ওইসব দেশের সরকারকে কোভিড-১৯ অতিমারী প্রতিহত করার ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্হা নিতে বাধ্য করেছে। ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু মহামারীর সময়ে সিঙ্গাপুরে কাজ করতে গিয়ে দেখেছিলাম সাধারণ মানুষ, সরকারী হাসপাতাল এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিরকম সংবেদনশীল ও সিরিয়াস। জয়েন করার আগে এইচ-১এন-১ ভ্যাকসিন নিতে হয়েছিল। মাস্ক ছাড়া অর্থোপেডিক ওয়ার্ডেও ঢুকতে দিত না। এই যে সংবেদনশীলতা, সেটা এসেছে খারাপ অভিজ্ঞতা ও খারাপ স্মৃতি থেকে।
জনসাধারণ এবং সেই সঙ্গে সরকার- এদের স্মৃতি খুব দুর্বল। কিন্তু সাহিত্যিকদের? ‘সাহিত্য সমাজের দর্পণ’ বলা হয়ে থাকে। তা সেই দর্পণে কেমন পড়ে মহামারীর ছায়া?
চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ভয়ঙ্কর প্লেগ মহামারীতে প্রায় উজাড় হয়ে গিয়েছিল ইউরোপ। ওই মহাদেশের জনসংখ্যার এক ষষ্ঠমাংশ মুছে গিয়েছিল পৃথিবী থেকে। ইউরোপীয় রেনেসাঁর পীঠস্থান ফ্লোরেন্স ও সন্নিহিত টাসকানি অঞ্চলে ‘কালোমৃত্যু’ নামে অভিহিত প্লেগের প্রভাব নিয়ে ১৩৫৩ সালে গিওভান্নি বোকাচ্চিও লিখেছিলেন কালজয়ী সাহিত্য- একশত গল্পের সংকলন ‘ডেকামেরন’। তুলনায় এই সেদিন, ১৯৪০ সালে আলবেয়ার কাম্যু, ফরাসী শাসিত আলজেরিয়ার তুরান শহরের প্লেগ মহামারী নিয়ে লিখলেন ‘দ্য প্লেগ’। এ ছাড়াও আছে ১৮৩৮ সালে নরওয়ের কবি হেনরিক ওয়ের্গেল্যান্ডের কলেরা মহামারী নিয়ে লেখা নাটক ‘ইন্ডিয়ান কলেরা’। তখন কলেরা ঔপনিবেশিক গাঙ্গেয় উত্তর ভারত থেকে অতিমারীর আকারে বার বার ছড়িয়ে পড়ত মধ্যপ্রাচ্য, ইরান হয়ে ইউরোপে। ১৯৮৫ সালে কলম্বিয়ার নোবেল জয়ী লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ-এর লেখা ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’ উপন্যাস তো অনেকে পড়েছেন।
ভারতবর্ষে বারবার কলেরা, গুটিবসন্ত, ম্যালেরিয়া মহামারী ও অতিমারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ে অসংখ্য মৃত্যুর কারণ হয়েছে। ১৯১৮-২০ সালের স্প্যানিশ ফ্লু অতিমারীর ধাক্কায় এই দেশে প্রায় দেড় কোটি মানুষের প্রাণহানি হয়। কিন্তু এত ভয়াবহ ঘটনার সাহিত্যিক বিবরণ প্রায় নেই বললেই চলে।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘পুরাতন ভৃত্য’ (গুটিবসন্ত), মুন্সী প্রেমচন্দ-র ছোটোগল্প ইদগাহ (কলেরা), ‘দুধ কি দাম’ (প্লেগ) ইত্যাদি বিখ্যাত সাহিত্যকর্মে মহামারী এসেছে বটে, কিন্তু কেন্দ্রীয় পটভূমি হিসেবে নয়।
হিন্দী ভাষী কবি সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী ‘নিরালা’-র ‘কুল্লি ভাট’ একমাত্র ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ অতিমারীর প্রেক্ষাপটে লেখা কাহিনী। যা তাঁর অত্যন্ত দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জারিত। তাঁর স্ত্রী, সন্তান ও অনেক আত্মীয় স্বজন সেই মহামারীতে হারিয়ে যায়। নিরালা লিখেছিলেন, ‘দিল্লীর যমুনা নদী মৃতদেহের ভারে ফুলে উঠেছে।’
মাষ্টার ভগবান দাস বুবোনিক প্লেগ নিয়ে ১৯০২ সালে লেখেন ‘প্লেগ কি চুড়াইল’। পান্ডে বেচান শর্মার গল্প ‘বীভৎস’ তে স্প্যানিশ ফ্লু-র ছোঁয়া ছিল। ফণীশ্বর নাথ রেণু (হিন্দী) ১৯৪৪ সালে কলেরা নিয়ে লিখেছিলেন ‘পহলবান কি ঢোলক’।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত উপন্যাসে কলেরা, প্লেগ, গুটি বসন্তের মহামারী বারবার এসেছে। এসেছে কোয়ারান্টিন- রেঙ্গুনের পটভূমিতে। কথাসাহিত্যিক বর্ণনা করেছেন মানুষের ক্রূরতা, নিষ্ঠুরতা, মহামারীর অভিঘাতে ভেঙ্গে যাওয়া কৃত্রিম ভালোবাসা। অন্যদিকে কোনো কোনো চরিত্রের অপরিসীম দায়িত্ববোধ এবং মানবসেবার কাহিনী।
মহামারীর বিষয়ক সাহিত্য সমাজের পঙ্কিলতার দিকে মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, আবার অনাগত বিপদ থেকে সতর্কও করে। এই অতিমারী একদিন চলে যাবে। কিন্ত এ আবার অন্যরূপে ফিরে আসতে পারে।
সেই কারণে বহুল প্রচারিত ও স্বনামধন্য সাহিত্যিকগণ, গদগদ প্রেমকাহিনী এবং প্রেমের কবিতা লেখার মাঝে মাঝে এই অতিমারী পরিস্থিতির বিবরণ যদি লিখে যান, তাহলে ভবিষ্যত প্রজন্মের মানুষ সতর্কিত এবং উপকৃত হয়।
ফিচারড ইমেজ পরিচয়ঃ মধ্যযুগীয় ইউরোপে প্লেগ মহামারীর কালে সামাজিক অরাজকতা ও আতঙ্কের পটভূমিতে চিত্রকর পিটার ব্রুগেল-এর ছবি ‘ দ্য ট্রাম্ফ অফ ডেথ’।