মেয়েটা ভীষণ ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে সত্যসাধনবাবুকে। সত্য সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। হাসপাতালের কিছু বিপজ্জনক ডিউটি তো করতে হবেই। সেটা মেয়েকে বোঝানো দায়। মেয়ের অবশ্য বাবার ডিউটি করা নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি সাবধানতা না নিয়ে ডিউটি করায়। এই যেমন এমারজেন্সি ডিউটি করতে হবে পিপিই কিট পরে। পিপিই কিট একবার পরে ফেললে ডিউটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর খোলা যায়না। এই ছয়ঘন্টা থেকে আটঘন্টা পুরো টিনড রসগোল্লা ( নিজেকে রসগোল্লা ভাবার কারণ হাই ব্লাড সুগার), যতক্ষণ না সিল কাটা হচ্ছে ততক্ষণ ঠিক থাকবে।
কিন্তু ডায়াবেটিসের জন্য সত্যকে একটু ঘনঘনই বাথরুম যেতে হয়। তার ওপর পিপিই কিট পরলে তো কথা নেই, মনে হয় এক্ষুনি না গেলে পেট ফেটে মারা যাবে। আর একবার পিপিই কিটের কোনো অংশ খোলা মানে সেটি সঙ্গে সঙ্গে বাতিল। সরকার দিনে তিন-চার সেট করে পিপিই কিট দিতে পারবে না, সুতরাং প্রতিদিন হাজার টাকার পিপিই কিনতে হচ্ছে ডাক্তারদের।
সত্যর বড় গায়ে লাগে। প্রথম দিন ঠিক আঠাশ মিনিটের মাথায়, দ্বিতীয় দিন দেড়ঘন্টা, তৃতীয় দিন দশ মিনিটে তাকে পোশাক খুলে টয়লেটে যেতে হয়েছিল । যেন টেলএন্ডারের টেস্ট ক্রিকেটে ক্রিজে টিঁকে থাকার সময়। এই লজ্জাজনক পরিসংখ্যান মেয়ে রিমাকে জানায়নি সত্য। মেয়ে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করবে। কৌতূহলী প্রতিবেশীরা পিপিই কিট খুলে ফেলার কারণ জেনে গেলে বড্ড লজ্জার হবে ব্যাপারটা।
করোনা নিয়ে প্রথমদিকে খুব জানার চেষ্টা করেছিল সত্য। কিন্তু করোনা ব্যাটা ভাইরাস জগতের গিরগিটি, মুহুর্মুহু রঙ বদলায়। তারপর থেকে সুকুমার রায়ের হযবরলকেই করোনা ভাইরাসের ওপর অথেনটিক বই হিসেবে মেনে নিয়েছে সত্য, লাল বেড়াল থেকে রুমাল হতে বিন্দুমাত্র সময় নেয় না বজ্জাতটা। ছড়ানোর প্যাটার্নটাও তো গোলমেলে – কলকেতা ডায়মন্ডহারবার, রানাঘাট থেকে তিব্বত। গোষ্ঠী সংক্রমণ না হয়েও গুষ্টি শুদ্ধো করোনা আক্রান্ত। সুতরাং জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই।
স্বাস্থ্য ভবন থেকে রবিবার করে রাতের বেলা ওয়েবক্লাস হয়। কেউ হাঁদাভোঁদার গল্পের মতো চশমায় চোখ এঁকে ঘুমোয় তো কেউ কায়দা করে মোবাইলে নিজের ছবিটাকে অফ করে রাখে। সত্যর মতো অনেকেই অবশ্য মনোযোগ দিয়ে বক্তব্যগুলো শোনার চেষ্টা করে। একটা কারণেই শুনতে হয় – চিকিৎসা পদ্ধতিতে আবার কোনো পরিবর্তন এলো কিনা। কারণ শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা তো ডাক্তারদেরই করতে হবে।
ট্রাম্প বেচারি তো হুড়মুড় করে গুচ্ছের হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কিনে আর রাখার জায়গা পাচ্ছে না। আমেরিকান দর্শন অনুযায়ী থিংক বিগ করতে গিয়ে বিগড়ে গেছে আমেরিকার সাধারণ মানুষের মেজাজ। এখন ওষুধটা নিয়ে বেশকিছু ডাক্তার সন্দিগ্ধ হয়ে পড়েছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে শুদ্ধ করোনা ভাইরাস ঘোলের সরবৎ খাইয়ে ছেড়েছে এভাবে।
ওয়েবক্লাস নিয়ে আবার বাচ্চাদেরও মারাত্মক সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পাশের বাড়ির তিন্নির সোজাসাপটা প্রশ্ন সত্যকে- “তোমাদের অনলাইন ক্লাসের দিদিমণি কেন শুধু রোববার রাতে ক্লাস নেয়? তোমাদের কি সারা সপ্তাহের হোমওয়ার্ক দিয়ে দেয়?”
সত্য এড়িয়ে গিয়ে সুকুমার রায়কেই মনে মনে ঢাল করে -হেড অফিসের বড় বাবুদের মাথার ব্যামো থাকাটা আশ্চর্যের কিছু না।
এমারজেন্সি ডিউটি ছাড়াও আউটডোর, পোস্টমর্টেম, ব্লাড ক্যাম্প, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোয়ারান্টাইন সেন্টারে যেতে হয় সত্যকে। সত্য মেয়েকে বলেনি যে সব ডিউটিতেই অল্পবিস্তর করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে। শুধু কি তাই- রাস্তাঘাটে সামনে ডাক্তার পেলে অনেকের রোগনারার কথা ঝট করে মনে পড়ে যায়।
সেদিন এক ভদ্রলোক দুম করে মুখের সামনে মাস্ক খুলে কৃষ্ণের ব্রহ্মান্ড দর্শন করানোর মতো হাঁ করে বলে ওঠে “আমার টনসিলটা একটু দেখুন তো ডাক্তারবাবু, মনে হচ্ছে পেকেছে।”
একটু বিরক্তির সাথে সত্য বলেছে – “ভীষণ পেকেছে, পাকাভাবটা পাকাপোক্ত ভাবে পেছন পর্যন্ত নেমে গেছে।” কোনো নেতা-মন্ত্রী অথবা অন্যকোনো প্রফেশনের কারো কাছে এরকম করোনা মরশুমে অতর্কিতে হাঁ করলে বৃন্দাবন দর্শনের ব্যবস্থা করে দেবে সে।
হাঁ করা ভদ্রলোক একজন ইএনটি স্পেশালিষ্টের কাছে সত্যবাবুর যারপরনাই নিন্দা করেছে।
এরপরেও কিছু হ্যাহ্যা পাবলিক আছে, যারা “চিনতে পারছেন না ডাক্তারবাবু ” বলে মুখের সামনে মাস্ক নামিয়ে দাঁতের বিজ্ঞাপন করে। সবাইকে যে হাড়েহাড়ে চেনা আছে সেটা বলা যায়না। হাসপাতালে গন্ডগোলের সময় এরাই আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাবে বিনে পয়সায় হাতের সুখ করে নেয়। একটা মরে যাওয়া মানুষ “স্যালাইন টানছে” এই অভিযোগে হাসপাতালে একবার ভয়ংকর অশান্তি করেছিল এরকম একজন। আঙুল নড়ে ওঠা বা স্যালাইন চালু থাকা যে সবসময় জীবনের চিহ্ন নয় সেটা এইসব শিক্ষিত মানুষজনকে বোঝানো দায়।
সত্য ভাবে, তবু তো সে ভালো আছে। মেডিসিন, ইএনটির ডাক্তারবাবুদের একেবারে করোনা ভাইরাসের বাজারে বসে কাজ করতে হয়। সেইসব ডাক্তার, নার্সরা অপ্রতুল সুরক্ষা নিয়ে দিনের পর দিন পরিষেবা দিয়ে চলেছে। সেদিন এক সার্জন দুঃখ করছিলেন। আপাদমস্তক মেডিসিনের রোগটা তাদেরও অদ্ভুত পথ ধরে জ্বালাচ্ছে। অ্যাক্সিডেন্টের পেশেন্টগুলোকে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চিকিৎসা করতে হয়, সেলাই দিতে হয়। তাদের করোনা স্ট্যাটাস নিয়ে দুশ্চিন্তা করার মতো অবকাশ থাকে না। গাইনি ডিপার্টমেন্টেও করোনার জন্য ডেলিভারি আটকে থাকে না। মোটকথা নিজের মৃত্যুভয়কে জয় করতে হয় সমস্ত ফ্রন্ট লাইনে থাকা ডাক্তার নার্সদের।
সাবধানের যেমন মার নেই, মারেরও সাবধান নেই। চোখের সামনে একসাথে পড়ে আসা, এক কলেজে থাকা ডাক্তারদের মৃত্যু সংবাদ যখন চোখে পড়ে বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। আর খবরের কাগজ বা টিভির পর্দায় সেই খবরগুলো রিমারই আগে চোখে পড়ে। বাবাকে জড়িয়ে কেঁদে উঠে বলে “হারিয়ে যেওনা বাবা।”
ডাক্তাররাও কারো বাবা-মা, কারো ছেলে মেয়ে। তার থেকেও বড়ো সত্যি – তারাও মানুষ। করোনা আক্রমণের জন্য কোনো পেশা দেখে না। ভাইরাস খুব সাম্যবাদী।
বন্ধু, খুব সুন্দর হয়েছে ??
ধন্যবাদ অম্লান ❤??
অসাধারন।
ধন্যবাদ ❤?
খুব ভালো হয়েছে।
❤❤❤???
খুব সুন্দর লিখেছো দাদা।
এরকম বাস্তবধর্মী আরো লেখা চাই।
দিগন্ত ❤❤❤
দাদা,তোমার লেখাযে হৃদয়স্পর্শী সে কথা বলাই বাহুল্য। তাই ও কথা থাক। পিপিই কিট নিয়ে দারিদ্র্য, কিপ্টেমি, ঔদাসিন্য, ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি, ভবিতব্য এগুলোর কোনোটাই দেখানো যাবেনা। এই অসম অনিশ্চিত লড়াইয়ে, যেখানে ঢালই শেষ অস্ত্র, সেখানে যথেচ্ছ হ্যাঁ সজ্ঞানে লিখছি যথেচ্ছ পিপিই ব্যবহার করতে হবে। এ নিয়ে শিথিলতা বরদাস্ত করা হবেনা। সত্যডাক্তার কোনো একজন ডাক্তারের নাম নয়, সবার নাম।তিন্নি একটা মেয়ের নাম নয়, আমাদের ঘরে ঘরে তিন্নি আছ। এটাই গণতন্ত্র।
সৌগত❤❤❤
উঃ কত জনের মনের এবং পারিপার্শ্বের কথা যে লিখে দিলেন ।
ভালোবাসা নেবেন অনির্বাণ দা । ভালো থাকবেন ।
❤❤❤???
পুরো গল্পটি অসাধারণ Sir । আর শেষ অংশটি মন ছুঁয়ে গেল।
আপনি সাবধানে থাকবেন Sir ?
আপনি থাকছেন স্যার । তিন্নিকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারেন না আপনি । এভাবেই চালিয়ে যান । আমরা সঙ্গে আছি আপনার ।
দারুন দারুন
খুব সুন্দর হয়েছে লেখাটা।অন্তর ছুঁয়ে গেল।ভালো থাকুন।
অসাধারণ । কিন্তু শিক্ষিত মানুষকে বোঝানো দায় লাইন টা সেরা ছিল , ওওহহ অসাধারণ চাটুনি ।