সবে চাকরিতে জয়েন করার জন্য নর্থবেঙ্গল চলে এসেছি কলকাতা ছেড়ে। এসেই কিছুদিন শিক্ষকতা করলাম মন দিয়ে। তারপর বুঝতে পারলাম, ঠিক সময় কাটানো যাচ্ছে না।
ডাক্তারি পড়া, ইন্টার্নশিপ, হাউজস্টাফশিপের যে মারাত্মক রগড়ানি সাড়ে ছয় বছর শরীরের কোষে কোষে একটা পরিবর্তন এনে দিয়েছে, সেটা ঠিক সুখী সুখী শিক্ষকতার জীবনে তাল মেলাতে পারছে না আর!
ক্লাস নিয়ে ঘরে ফিরে বিকেল, রাত, পরদিন সকাল অব্দি অখণ্ড অবসর। একলা ঘর … সবাইকে ছেড়ে যেন পরবাসে নির্বাসিত জীবন তখন। বুঝলাম, ছন্দপতন ঘটেছে। এবং সেটা নিয়মই! মাঝে মাঝে ইচ্ছে হতো – ফিরে যাই। কিন্ত কোথায়? সব বন্ধুরা যে যার মতো বেরিয়ে যাবে এখন। সবাইকেই জীবন টানছে পায়ে দড়ি বেঁধে।
বুঝলাম, যতই শখ থাকুক শিক্ষকতার , এ কাজ করার জন্য বোধহয় আরো অনেক ধৈর্য দরকার। আরো অনেক কিছু শিখে আসা দরকার। মাঝে মাঝে মনে হতো– আমাদের মত অল্প বয়সীদের এই চাকরিতে ঢুকতে দেয়াই উচিত নয়!
উপায় নেই বলে পকেটের কথা ভেবে যদিও বা চাকরিতে থাকতে হবে বলে ঠিক করলাম, নিজের ভেতরে কুটকুট শুরু হলো। বেরোতে হবে। এতোদিন যে মানুষের কাছে পৌঁছে যাবার জন্য এতো এতো চেষ্টা করলাম, সেটা ক্লাস রুমের ভেতর থেকে আমাকে ঠেলতে লাগলো বাইরে।
বিকেলের দিকে কাজ নেই, পড়াশোনা সানসেটে তুলে রেখেছি , কখনো কখনো হেঁটে আসি নদীর পাড়ে। বসে থাকি শুকিয়ে যাওয়া এক নদীর জলে পা ডুবিয়ে। একটা বিশাল আকাশ সেখানে নেমে আসে দূর পাহাড়ের মাথায়। আস্তে আস্তে অন্ধকার নামে শুকনো বালাসন নদীর বুকে, পাথর বালির সাথে মিশে …আমার বুকেও।
দূরে কার্শিয়াং-এ অন্ধকার পাহাড়ের গায়ে আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে আলো…. সে এক অদ্ভুত দৃশ্য … যাঁরা দেখেছে, তাঁরা বুঝতে পারবে– দিনের বেলার সবুজ নিশ্চল পাহাড়ের গায়ে শত শত আলো জ্বলে উঠলে কেমন লাগে … আমি দেখতে দেখতে, ঘরে ফিরতে ফিরতে মনের অজান্তেই সে আলোর খানিকটা নিয়ে আসি … আমার অন্ধকার একলা ঘরে সে আলো জীবনের হদিস দেয় বাকি রাত।
কখনো গান শুনি, ধেড়ে গলায় গেয়ে উঠি – আজ মন চেয়েছে আমি … , কখনো কখনো শিস্ দিয়ে উঠি একলাই। কখনো কখনো বাঁশি শুনি … আমার বড় প্রিয়। কত শখ ছিল– একদিন আমিও বাজাবো … একদিন আমিও গভীর রাতের অন্ধকারে খোলা জানালার পাশে বসে বাজাবো বেহাগ …. তারপর ললিত রাগ ….. সকালের আলো ফুটতে ফুটতে শুরু করবো ভৈরবী…. সবুজ ঘাসের উপর ছড়িয়ে পড়বে ভোরের আলো আর ভৈরবী সুর …সে আমার আর হয়ে উঠলো না!
একটা বাঁশি কিনেছিলাম বহুদিন আগে। যথারীতি কলকাতা ছেড়ে আসার সময় সেটি চুপিচুপি ব্যাগের এক কোনে লুকিয়ে নিয়েও এসেছিলাম। সেখানেই সে নির্বাসিত হয়ে আছে আসার পর থেকে। একবার বের করে গায়ে হাত বুলাই তাঁর … আবার রেখে দিই। রাগ করে কিনা, কে জানে! মনে হতো, সব বাঁশিই তো বাজতে চায়!
কেউ কেউ সুরেলা শ্বাস বায়ু পায়, বেজে ওঠে সুরে … কেউ কেউ পায় না, আমার মত নিতান্তই বেসুরো মানুষের হাত বোলানো হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের জীবনের সান্ত্বনা।
সেই বয়সে, মানে চব্বিশ পঁচিশে, কিচ্ছু করার নেই – এর চেয়ে বিষাদ আর কিছু হয় না! শেষে ঠিক করলাম– পড়াশোনা করতে হবে। দেখলাম– একলা একলা পড়াশোনা করার অভ্যাস শেষ ছ’বছরে শেষ হয়ে গেছে!
আর বোধহয় কিছু হলো না আমার দ্বারা!
অবশেষে একদিন ঠিক করলাম– যা শিখেছি সেই নিয়ে একদিন বেরিয়ে পড়বো মানুষের কাছে। বিকেলের অবসরে কোথাও একটা জায়গা ঠিক করে বসবো চেম্বার খুলে। টাকা পয়সা না আসুক, আমার ডাক্তারি শিক্ষা আদৌ কিছু হয়েছে কিনা, সেটা বাজিয়ে দেখার খুব ইচ্ছে হলো। মানুষের কাছে না গেলে, সেটা কিছুতেই যাচাই করা যাবে না।
ঠিক হলো অনেকটা দূরে একটা গ্রামে যাবো। বিকেলটা কেটে যাবে যাওয়া আসা করতে করতে। অল্প কয়েকজন রোগী দেখবো, ব্যস!
সত্যি বলতে, প্রথম প্রথম সপ্তাহে একদিনই বিকেলে যেতাম। মাসখানেক দেখলাম, ভালোই রোগী আসছে। বেশ কিছু রোগী দেখেছি, নিজের মত চিকিৎসা করেছি। হ্যাঁ, কতকটা কপিবুক ডাক্তারি সেটা। অভিজ্ঞতা কম।
তাই বাস্তবের সাথে মেলাতে অসুবিধা হতো। ধরা যাক, একজনের হার্ট অ্যাটাক । আমি তো জানি, এইসময় কিছু জরুরী ওষুধ দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। কিন্ত সে গণ্ডগ্রামে হাসপাতালে ভর্তি হয় না! শুধু আউটডোর! রোগীকে বললাম। কি বুঝলেন জানি না, অবাক হলেন! আমিও অবাক হলাম!
এই করে করে যখন একটু জানা শোনা হলো, সময় বাড়ালাম। দু’দিন করে বিকেলে। এই সময়েই আবিষ্কার করলাম– রোগী দেখে যে টাকা ইনকাম করতে হয়, সেটা আমার কাছে গৌণ হয়ে গেছে! ওষুধের দোকানদার যা দেয় ফিজ বাবদ, আমার কোন কাজেই লাগে না! মনেও থাকে না কত টাকা দিল। আমি হিসেবও করি না।
হ্যাঁ, এই কাজটি এখনো করতে পারি না। বুঝতে পারি, এই সুযোগে আমার হকের টাকা যার সুযোগ আছে সেই মেরে দিচ্ছে! আমার ভালো লাগে না সেটা বলতে! কেন কে জানে!
ততদিনে আবার আমার কুটকুট খানিকটা শুরু হয়েছে। বন্ধুরা পড়াশোনা করে। পোস্ট গ্রাজুয়েট করতে হবে।
শিখতে হবে অনেক কিছু। কত পড়া বাকি। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। বাড়ি ফিরে বই পড়তে বসার চেষ্টা শুরু হলো।
একদিন বিকেলে চেম্বারে বসে আছি। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ করে আছি। একজন মধ্যবয়সী মহিলা এলেন। সে গ্রামের মহিলারা সাধারণত একা কেউ ডাক্তারের কাছে আসে না। স্বামী বা বাড়ির অন্য কেউ বা পাড়ার কোন মহিলা সঙ্গ দেয় তাদের। একটু অবাক হলাম। বললাম– সাথে কে আছে?
কপিবুক ডাক্তারি! মহিলা অ্যাটেন্ডান্ট না থাকলে দেখবো না। আজ অন্য কোন মহিলা রোগী ছিলও ন !
কেউ আসেনি বলে আমি বলেই দিলাম, দেখবো না আজ। দোকানদার বলল যে মেয়েটি রেগুলার থাকে, সে আজ নেই।
মহিলা প্রায় কাকুতি মিনতি শুরু করলো।
বললাম– আজ আপনার সব কিছু শুনে লিখে রাখবো শুধু। তিনদিন পর আবার আসবেন।
নাম ধাম লিখলাম। জিজ্ঞেস করলাম– কি সমস্যা?
– শরীল শুকাই যাচ্চে।
– কতদিন ধরে এমন হচ্ছে?
– দুই এক বছর হবে ।
– ঠিক করে বলুন কতদিন। আর কি কি সমস্যা হয়?
– রাইতে রাইতে গা গরম। খাশি আর কফ।
– আগে কোন অসুখ হয়েছে? বাড়িতে কারো কোন অসুখ আছে?
– না। বাড়ির মানুষ থাহে না তো।
– আশেপাশে কারো কোন অসুখ আছে? টিবি অসুখ আছে নাকি কারো?
মহিলা কি একটু চমকে উঠলেন? কেন?
মহিলা মনে হয় অস্বস্তি বোধ করছেন দেখে বললাম– কি হলো বলুন?
– ক্যামনে জানমু? একটু সতর্ক, তড়িঘড়ি করে বলার ভঙ্গি।
– জানেন কি না, তাই জানতে চাই।
– হেডা তো জানতি অইবো।
– আচ্ছা। সব জেনে পরের দিন আসবেন।
– আপনার মাসিক ঠিকমতো হয়? কোন অপারেশন হয়েছে?
– হ। কোনটার জবাব দিল বুঝলাম না। যাকগে পরের দিন দেখে নেয়া যাবে।
মহিলা দেখছি চেয়ার ছেড়ে উঠছেন না।
– কিছু বলবেন কি?
মহিলা কিছু না বলে উঠতে যাবেন।
– দাঁড়ান, আপনার বর কি করে?
– কি কাম, জানি না। বাড়ি থাহে না।
চলে গেলেন অতঃপর। কিছু একটা ব্যাপার কি মহিলা লুকিয়ে যাচ্ছেন? ডাক্তারের গোয়েন্দা মনের ভেতর কেমন যেন একটা খটকা লাগলো!
পরের পর রোগী এলো। দেখে ফিরতে ফিরতে ভাবছি– আমাদের দেশে স্বাস্থ্য নিয়ে কি পরিমাণ অসচেতনত !
মহিলা এতোদিন ধরে চুপ করে বাড়িতে বসে রইলো?
টিবিই হবার কথা। এখন তো বিনামূল্যে চিকিৎসাও হয় টিবির! তাহলে কেন এমন হয়?
পরের দিন মহিলা এসেছেন। শেষ রোগী তিনিই। সাথে একজন মহিলাকে নিয়ে এসেছেন। আগের দিনের প্রেসক্রিপশন চেয়ে নিলাম। খুঁটিনাটি সব দেখে পরীক্ষা করলাম। যতটা বোঝা গেল– এ টিবির রোগীই। একটা কফ পরীক্ষা আর বুকের এক্স-রে করাতে দিলাম। কিন্ত আরো অনেক কিছু হতে পারে। অন্য অসুখ থাকতে পারে টিবির সাথে। বুঝিয়ে দিলাম কি কি করতে হবে।
সাথে আসা মহিলা বেরিয়ে গেলেন বাইরে, সেটা দেখেই রোগিনী বললেন– ডাইকতার, এট্টা কতা কমু।
রোগী দেখা শেষ হলে এই রকম সময়ে আমাদের দেশের রোগীরা কি কি বলেন– তার ফিরিস্তি শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। কেউ বাড়ির বাচ্চা বা অন্য কারোর জন্য ওষুধ লিখে দিতে বলবে (একবার ফিজ দিয়ে দু’জনের চিকিৎসা!), কেউ বলবে– কি কি খাবো না, কি করে ওষুধ খাবো, ওষুধ কখন খাবো ইত্যাদি। নয়তো – ডাক্তার, আমার কিছু হয়নি তো? ভালো হয়ে যাবে তো? আবার আসতে হবে? নয়তো এমন একটা কথা বলবেন – যাতে এতোক্ষণ ধরে যা যা লেখা হয়েছে, যা যা ইতিহাস বলেছেন, যা যা রোগ লক্ষণ বলেছেন, সব বৃথা হয়ে যাবে!!!
মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয় তখন ডাক্তারের। পুরো ডায়াগনসিসটা পাল্টে যাবে কখনো কখনো। সব ফের লিখতে হবে!!
কেউ কেউ না বুঝে, কেউ কেউ ইচ্ছে করে বলবে না!! অনেক পণ্ডিত রোগী আবার ডাক্তারকে টেস্ট করতে আসেন! ভালো কথা! আমরাও বুঝি এগুলো! তাই কথাটা শেষের কথা শোনা জরুরি। বললাম– হ্যাঁ বলুন।
– এইডস না কি য্যানো ওডা কি?
যা ভেবেছি তাই! নিশ্চিত মারাত্মক একটা ক্লু দেবেন আমাকে ফের ভাবতে হবে। মাথার মধ্যে এইডস-এর রোগীর টিবি … ইত্যাদি কঠিন কঠিন ব্যাপার চলে এসেছে। নড়েচড়ে বসলাম।- কেন বলুন তো?
– অ্যামনে …
– এটা এক ধরনের ভাইরাস থেকে হয়। কঠিন অসুখ।
– অইলে মাইনসে বাঁচে?
– রোগী কোন অবস্থায় ধরা পড়ে, সেটা দেখতে হবে। ওষুধ আছে এখন। তবে বাঁচলেও নানা সমস্যায় পড়তে হয়। চিকিৎসা করাতে হয় নিয়ম মেনে।
মহিলার চোখ মুখ কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। শাড়ির আঁচল তুলেছেন একহাতে।
বললাম – পরিচিত কারো আছে নাকি? তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলুন।
মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করছে। এনাকে কি এইচআইভি র টেস্ট …. ধুর! আগে কমন অসুখ ভাবতে হবে। পরে দেখা যাবে। মহিলা উঠছেন না কেন?
– আর কিছু বলবেন?
মহিলা এবার ভেঙে পড়লেন। – সোয়ামি ডা বাইচবো না ডাইকতার?
– মানে? আমি প্রায় লাফিয়ে উঠেছি!
মহিলার মুখ চোখ কেমন যেন কুঁচকে যাচ্ছে। রাগ ঘৃণা – কি আছে তাতে? কেনই বা?
– হ! হারামিডার ওইডা অইচে।
আমার ভেতরের ডাক্তার সাবধান। শক্ত হয়ে বসেছি। অনুভুতি প্রকাশ করা যাবে না।
– আপনি তো বললেন না যে স্বামীর এইডস আছে! কোথায় সে? আপনি একসাথে থাকেন? প্রেসক্রিপশনটা দিন। ওটা লিখে রাখতে হবে।
মহিলার চোখ বেয়ে নামছে জল। সে মুখের ভাষা আমি তাকিয়ে পড়তে পারবো না বলে কাগজের দিকে তাকিয়ে আছি।- বলুন।
– বাড়ি থাহে না। সুরত না কোতায় এট্টা থাহে।
– কবে ধরা পড়েছে?
– দুই বচর আগে।
– এখন আপনারা একসাথে থাকেন? তাঁর এখন কি অবস্থা?
সেক্সুয়াল ট্রান্সমিশন হয় এইচআইভি র। মাথা ঘুরছে।
– জানি না। হালায় ধরা পড়ার পর একবার আইচিলো, হের পর থেইক্যা আহে না।
– খবর নিন।
– তালাক অইয়া গ্যাছে। হারামিডা আমারে মিত্যা দোষ দিয়া পলাইচে।
– কেন কেন?
– হক্কলে জাইন্যা যাইবো, হের লাইগ্যা আমার নামে বদনাম দিয়া পলাইচে। রাগে গজগজ করছেন মহিলা ।
বুঝলাম, কাউকে একটা বলতে পেরে যেন স্বস্তি পেলেন। আমাদের এমন বাস্তব কতবার শুনতে হয়েছে। ঘাবড়াই না আর। একজন গ্রামের মহিলা, যাঁর হয়তো জীবন কেটে যায় হাঁড়ি কড়াই এর ঝনঝনানির মাঝে, নয়তো বাচ্চা জন্ম দিয়ে, সোয়ামির আবদার অত্যাচার সহ্য করে, সেই মহিলার এমন ব্যক্তিগত কথা কি আমাদের সমাজ এখনো শোনে? কেউ জিজ্ঞেস করে? আমরাই কি করতে পারি? ভাবার চেষ্টা করলাম।
মনে মনে বললাম– ডাক্তার, তোমার এখনো কিছুই শেখা হয়নি! কতটুকু দেখেছো তুমি জীবনে? কাজের জন্য একটুখানি একলা থাকার দুঃখ যাপন করেই সহ্য করতে পারো না! এমন হলে?
মহিলাকে দেখে বুঝলাম আরো কিছু বলে খানিকটা হালকা হতে চান। বললাম– আপনার আর একটা পরীক্ষা লিখে দিলাম। করাবেন।
এঁদের কথায় বিশ্বাস করা যায় না। কি জানি হয়তো এরও!
– আইচ্ছা ডাইকতার, আমারে দেইখ্যা কি মনে অয় আমার কি অইতে পারে ওইডা?
সাবধান ডাক্তার! কি বলবে? যা ভাবছিলে ….- পারে। তবে হয়েছে কিনা বলা যাবে না এখন। পরীক্ষা করাতে হবে। এই পর্যন্ত বলে বললাম– রিপোর্ট নিয়ে আসবেন।
এক মাস যাইনি চেম্বারে। নানা কারণ ছিল। শেষে একদিন বিকেলে ফের গেলাম। কিছু পুরোনো রোগী দেখলাম। কয়েকজন নতুন। শেষ রোগী এলেন। সেই মহিলা। সঙ্গে একজন পুরুষ মানুষ। মধ্যবয়স্ক।
– ভালো আছেন?
– হু।
রিপোর্ট দেখালেন। দেখলাম, এইচআইভি নেগেটিভ। কিন্ত টিবির পরীক্ষা পজিটিভ। একটু স্বস্তি পেলাম। কমন অসুখ। চিকিৎসা সহজ। রোগ সেরেও যায়। হাসি হাসি মুখ করে বললাম– মন্দের ভালো। টিবি হয়েছে। চিকিৎসা করান। সেরে যাবে।
মহিলা এবং সঙ্গের পুরুষ দুজনেরই মুখে স্বস্তি।
তাও সাবধানতা অবলম্বন করে বললাম – ফের একবার এইচআইভি টেস্ট করাবেন অন্য জায়গা থেকে। অনেক সময় ধরা না ও পড়তে পারে।
ভয় আমরাও পাই যে! ভগবান তো নই।
পুরুষ মানুষটি বললো– তুমি ওষুধ নিয়ে বাড়ি যাও। আমি যাচ্ছি একটা কাজ করে।
মহিলা একটু লজ্জা পেল কি? ধ্যাৎ!
কারো ব্যক্তিগত জীবনে কি হচ্ছে সেসব জেনে সব সময় লাভ নেই।
আমি বললাম– ওষুধ একদম নিয়মিত খাবেন। বন্ধ করলে ফের পুরো ডোজ খেতে হবে।
মহিলা মাথা নাড়ালেন। – হেডা অইয়া যাবো। আইচ্ছা ডাইকতার, আরেট্টা কতা জিগামু? আপনে আমাগো বাড়ি একদিন যাইবেন?
হেসে ফেললাম। – আচ্ছা সে দেখা যাবে।
এমন অনেকেই বলেন। আমাদের শুধু শোনা হয়। যাওয়া হয় না। কত জায়গায়ই তো যেতে হতো জীবনে – ভাবি। মহিলা খুশ দিল একদম আগের দিনের কিছুই নাই। ভালো লাগে ডাক্তারের চেম্বারে এমন একটা পরিবেশ যখন তৈরি হয়।
– ডাইকতার বাবু , এইডা অইলো হেই মানুষ যার নামে হারামিডা বদনাম দিছিল। কি বদমাইশ! আমিও ঠিক কইরেছি, বদনাম যহন দিলি, ওর লগেই থাকমু!
বুঝলাম গল্প অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে। এ গল্প ঠিক আমার দরকারি নয়। তবু হেসে বললাম – বাহ্ ভাল।
মহিলা নিজেই বলে চলেছেন – আমি অরে লইয়াই থাকমু। কি করমু? একলা মাইয়া মানুষ, এই গেরামের হক্কলে আমারে দোষ দ্যায়। হালায়ও আমারে দোষ দিছে। নিজে কোন মাগীর ধারে যায় হেডা না কইয়া আমারে দোষ দ্যায়!
মহিলা আস্তে আস্তে ফের রেগে যাচ্ছেন। মুখের ভাষায় তীব্র অনুভূতি। চোখে জল ও কি আসছে ফের? কেন?
কতটুকু জানি আমি? একটা সংসার … স্বামী স্ত্রীর জটিল রসায়ন …. সমাজের সাথে তার প্রতিনিয়ত ক্রিয়া বিক্রিয়া … ভাঙা গড়া … এ কি আমি এখনো জানি?
বুঝলাম, জানতে হয় এসবও। জীবনে সব কিছুই চলতে চলতে শিখতে হয়।
বললাম – আসুন এবার। ভালো থাকবেন।
মহিলাও হয়তো বুঝতে পারলেন যে আমাকে বলে তাঁর মনের রাগ প্রকাশ ছাড়া আর কিছু হবে না।
ভাবলাম, এই সমাজে একজন মহিলা এভাবে ভাবতে পারছে, এটুকু অন্ততঃ ভালো লক্ষণ। অনেকেই পারে না।
মহিলা নড়েচড়ে বসলেন। উঠতে যাবেন। প্রেসক্রিপশন নিয়েছেন। আমিও বেরিয়ে পড়বো। আমি ফিরবো আমার একলা ঘরে।
এরকম রোগী একজন এলেই পুরো একটা দিনের বাকি সব চিন্তা ভাবনা শেষ হয়ে যায়। পাথর হতে পারি না। ঘরে ফিরে ভাবি। মাথায় চক্কর মারে জীবনের বিভিন্ন দিক। বুঝতে পারি, বুকের ভেতর কিছু একটা আছে এখনো।
আমি দরজার বাইরে বেরিয়ে অপেক্ষা করছি বাসের জন্য। দেখলাম, মহিলা ও পাশেই দাঁড়িয়ে। কোন গ্রামে ফিরবেন জানি না।
– ও ডাইকতার, আপনে ও বাসে যাইবেন?
– হুম।
– কোতায় যান আপনে?
হাসলাম। – বাস কোথায় নিয়ে যায় দেখি । ঘরের কাছেই নামানোর কথা। তারপর, ঘর ছাড়া আর কোথায় যাবো?
– আইচ্ছা। কিচু মনে না করলি এট্টা শ্যাষ কতা জিগামু?
আমার ডাক্তারি শেষ চেম্বারেই । বাইরে একজন সাধারণ মানুষ আমি। আর কোন পরিচয় রাখিনা। তাই অজানা কেউ আমাকে চিনতেও পারে না। এটুকু আমার নিজের জন্য ঠিক করা আছে। তাই চিকিৎসা বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে ও জবাব দিই না সাধারণতঃ তবু মানুষ প্রশ্ন করতেই থাকেন।
– বলুন। মহিলা র দিকে তাকালামও না। অনেক গল্প শুনেছি। আর নয়।
– আইচ্ছা, ওই সোয়ামি হারামি ডা যদি ফিইরা আহে, আপনে চিকিচ্চা কইরা ওরে বাঁচাইতে পাইরবেন না?
এতোটা চমকে উঠলাম যে হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেল রাস্তায়। তুলে নিয়ে বিস্ময়াবিষ্ট তাকালাম মহিলার দিকে।
না! কোন নাটকীয় ভঙ্গি নেই। রাগ নেই, ক্ষোভ নেই। চোখের জল আছে কি? অন্য কোথাও?
আমার মুখে কথা সরছে না।
তাঁর মুখে প্রশ্নের উত্তরটুকু পাওয়ার আকুতি। কিন্ত কেন?
আমি চটজলদি উত্তর দিলাম – রোগীকে না দেখে বলা যাবে না। যদি আমার কাছে আসে তো চেষ্টা করবো।
বাস এসে গেছে। আমি পা বাড়ালাম। মহিলা কি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন? কি ভাবছেন? একজন অতি সাধারন গ্রাম্য মহিলা, যে কোনদিন হয়তো স্বামীর সংসার ছাড়া অন্য কিছু ভাবেনি, আজ এক অসহনীয় পরিস্থিতি তে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজছেন, সমাজ সংসার তাঁর কাছে ভাঙাচোরা ঘুণ ধরা, নিজের স্বামীর কাছ থেকে চরম অপমান সহ্য করে অন্য একজনকে নিয়ে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটাতে চাইছেন – সেই মহিলার এইরকম পুরোপুরি উল্টো অথচ মূল্যবান হৃদয়স্পর্শী চিন্তা ভাবনা করার ক্ষমতা রাখেন – এটা জানলে বা বুঝলে বুকের ঠিক কোথায় কত বড় ধাক্কা লাগে, সেদিন বুঝলাম।
বাসের জানালার পাশে বসে দেখছিলাম সবুজ ঘাস, ধানের মাঠ – সেইসব গ্রাম পেরিয়ে আমি ফিরবো ঘরে। গ্রাম পাল্টে যাওয়া শহরে আমার ভাড়া করা ঘর। সেখানে এখন সবুজ খুব কম। ভাবছি, মানুষের হৃদয়েও যে সবুজ থাকে – তাকে কি আমরা যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখি? বিকেলের এই নরম আলো কি পড়ে সেই সবুজে?
সকালের সুর কি মেশে শিশির ভেজা সেই সবুজে? রাতে কার্শিয়াং এর সবুজ পাহাড়ের মত সেখানে কি আলো জ্বেলে রাখি সবসময়?
জানি না।
মরমী লেখা। যতদিন পারেন ধরে রাখুন। বড়ো অভাব এর। বড়ো প্রয়োজনও।