অবশেষে শুভময় যা কায়মনোবাক্যে চাইছিল, তাই পেয়ে গেল। যদিও পেল, পুরোনো এক গল্পের মোড়কে।
সেই যে এক সন্ন্যাসী রোদে পোড়া মাঠে হাঁটার সময় হন্যে হয়ে আকাশে মুখ তুলে চেয়েছিল, একঠো ঘোড়া দিলা দে রাম।
তো নবাবের সৈন্যরা সেই সময় মাঠ পেরোচ্ছিল।
তাদের একটা গর্ভিণী ঘোড়ার বাচ্চা হল। দামী সেই আরবি অশ্বশাবককে সৈন্যরা জবরদস্তি সন্ন্যাসীর কোলে চাপিয়ে হুকুম করল, ‘এ’টাকে কোলে নিয়ে আমাদের পেছনে দৌড়ো।’
সন্ন্যাসী শেষ অবধি প্রার্থিত সেই ঘোড়াই পেল, কিন্তু তির্যক ভাবে।
ঘোড়ার বাচ্চাকে বইতে বইতে সে হাহাকার করে উঠল,
‘উলটা সমঝিলি রাম।’
শুভময়ের কেসটাও তাই। চোখে ঝাপসা দেখে ইদানিং। হাঁটু কনকন। ডায়াবেটিস, প্রস্টেটে শরীর শতছিদ্র। স্মৃতি ঝাপসা। আপিসের ফাইলে প্রায়ই গন্ডগোল করে ফেলে। বাধ্য হয়ে রিটায়ারমেন্টের আকাঙ্ক্ষা চেপে বসেছিল মনে। একটা দরখাস্তও করেছিল। পায়নি। অফিসের ফান্ড বাড়ন্ত। পাওনা মেটানোর নাকি টাকা নেই। তাই বয়েস পেরিয়ে গেলেও কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
সেই সময়েই পাকেচক্রে সাসপেন্ডেড হয়ে গেল আমাদের শুভময়।
কী করে? গল্পটা কিঞ্চিৎ গোলমেলে।
পেনশন পেতে ব্যর্থ শুভময়, একটা লোন অ্যাপ্লিকেশন করেছিল কিছুদিন আগে। সেইটি তাদের বড়সাহেব পত্রপাঠ রিজেক্ট করেছিল ওই ফান্ড শর্টেজেরই অজুহাতে।
সেই বড়সাহেব মানে মিঃ মণ্ডল পারফরম্যান্স ভালো করার জন্য হেড আপিসের প্রাইজ পেল। আসলে কর্মচারীদের চাবকে কাজ করানোর প্রাইজ। মন্ডলই অর্ডার দিল সেই উপলক্ষ্যে তাকে সম্বর্ধনা দিতে হবে।
সম্বর্ধনাসভায় উদ্বোধনী সঙ্গীত যার গাইবার কথা সেই রুমা বোস গাইতে পারবে না। ভোকাল কর্ডে সমস্যা বলে ভয়েস রেস্ট নিতে বলেছে ডাক্তার। কাজেই আর কে আছে খোঁজ পড়ল।
শুভময় জাঁক করে একদা বলেছিল রুমাকে,
‘ছেলেবেলায় গান শিখতাম। বাংলাদেশ যুদ্ধের ধাক্কায় এ’দিকে এসে সব গোল্লায় গ্যাছে।’
সেই তুচ্ছ কথা রুমার মনে ছিল কে বা জানত। রুমা অম্লানবদনে সবাইকে বোঝাল, ‘আমার ভয়েস রেস্ট। শুভময়দা’কে বলো না। উনিই কাজ চালিয়ে দেবেন এখন।’
শুভময় খানিকক্ষণ কিন্তু কিন্তু করে রাজি হয়ে গেল। বোধহয় ভাবল এই করে যদি সাহেবকে ইমপ্রেস করা যায়।
গান সিলেক্ট করে দিল রুমাই। একেবারে লাগসই গান।
শুনে মিঃ মণ্ডল কেন যে কোনও পাষাণ হৃদয় যে গলে ঝর্ণার মত বইবে একেবারে সিওর। ‘তোমারি গেহে, পালিছ স্নেহে, তুমি ধন্য ধন্য হে…’
সেই গানের রাস্তা বেয়েই বিপদ এল।
শুভময় গাইল খুব আবেগ দিয়ে। সুর যে খুব হেরফের হল তা’ও নয়। ছোটবেলায় যেমন গাইত তেমনই চোখ বুজে প্রবল নিষ্ঠায় গাইছিল সে। হঠাৎ গানের মধ্যপথে বড়সাহেব হুড়ুমদুড়ুম উঠে চলে গেল। সম্বর্ধনা না নিয়েই।
তার পরদিন সাসপেনশনের অর্ডার বেরোল। অভিযোগ, অফিস প্রশাসনকে অপমান করেছে সে।
খোঁজ নিতে জানা গেল একাত্তরে বর্ডার পেরোনো শুভময়ের উচ্চারণের দোষে এই গুরুতর কাণ্ড।
বাল্যকালে সে যেখানে বড় হয়েছে সে’খানে ঘোড়াকে বলা হত গুড়া। ধান্য কে দাইন্য।
এতদিন পরে গান গাইবার সময় পূর্বদেশীয় সেই উচ্চারণের সংস্কারে শুভময় গেয়েছে, ‘তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে তুমি দৈন্য দৈন্য হে’।
খালি একবার নয় গানে বারবার ফিরে এসেছে ওই ‘তুমি ধন্য ধন্য হে’ শব্দবন্ধটি। আর প্রতিবারই আবেগভরে ‘তুমি দৈন্য দৈন্য হে’ বলে মাথা দুলিয়ে গেয়েছে শুভময়।
তাই শুনে মণ্ডল সাহেব ধরে নিয়েছে লোন না দেওয়ার আক্রোশে সে ইচ্ছে করেই ধন্য না বলে দৈন্য বলেছে। অফিস প্রসাশন তথা কোম্পানির দৈন্যর কথাটা কৌশলে কায়দা করে প্রচার করেছে।
ব্যাস, আর যায় কোথায়।
তা’ সহকর্মীরা পাশে দাঁড়াল খুব। অফিসের গেটে দাঁড়িয়ে সবাই মিলে শ্লোগান দিল, এমনকি ওই রুমাও, ভোকাল কর্ডের তোয়াক্কা না করেই। ‘আর আমাদের নাই রে ভয়… পথ দেখাল শুভময়’ ‘অত্যাচারী পাচ্ছে ভয়… জাগল এ’বার শুভময়’ ইত্যাদি। প্রায় সবাই বলল, হোক কলরব।
1ঘনিষ্ঠ একজন শুভময়কে বলল তোর নামটার জন্য শ্লোগান বানাতে সুবিধে হল, বুঝলি! আমি সাসপেন্ড হলে মুশকিল হত।
হতই, কেন না সেই বন্ধুর নাম পুণ্ডরীকাক্ষ। যারা যারা হল্লা করেছিল অফিসগেটে ফিট করা সিসিটিভিতে চিনে নিয়ে সেই ব্রিগেডের সবাইকে শোকজ করেছে মণ্ডল। কর্মহীন শুভময় এখন অফিসে ঘোরাঘুরি করে। লোন তো পেলই না। বকেয়া পয়সাকড়ি যদি কিছু পাওয়া যায়। বাকি সময় বাড়িতে গিন্নিকে ঘরের কাজে সাহায্য করে। ঠিক সময়ে রিটায়ারমেন্ট আর পেনশনের জন্য মন খারাপ ছিল তার।
বাসনা পূরণের দেবতা বেচারাকে পাঠিয়ে দিল পেনশনের বদলে সাসপেনশন।
শুভময় মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বলে ওঠে, ‘উলটা সমঝিলি রাম।’