পুরোনো অভিজ্ঞতা থেকে জানতাম, ওটি’তে যাওয়ার আগে নিজের কি কি প্রস্তুতি দরকার, সেগুলো থাকায়, প্রথমেই নার্স দিদির কাছে impression টা বেশ good girl দের মতো হোল, বললেন সব ready, বাহ্! ইদানিং ছোট ছোট জিনিষের মূল্যায়ণ দেখি না, তাই বেশ মন ছুঁয়ে গেল।
বিনুনি দুটো ওটি’র জামা পরে নিজেই করে নেব ভেবেছিলাম, রাবার ব্যান্ড ব্যাগেই নিয়ে গেছিলাম। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। কিন্তু আয়া মাসি কিছুতেই রাজি হলেন না, ধরেবেঁধে চিরুণি নিয়ে বিনুনি বেঁধে দিতে বসলেন-“নিজে নিজে কেন বাঁধবে, একটু পরে’তো কতো কষ্ট পাবে, তা কোথায় থাক?”
–কেষ্টপুর। তুমি কোথায় থাকো মাসি?
–“নিক্কোপার্ক”
–ও, ওর কাছাকাছি’ই আমার মা-বাবার বাড়ি।
–“কি জন্য ওটি, মা?”
–কেন ET বাড়ছে না, তাই জানবেন।
–“বেবি আসছে না? কতো বছর বিয়ে হয়েছে?”
–২০১১ নভেম্বর।
-“ও… এইতো এখানে এসে গেছ যখন, এবার হয়ে যাবে। রাতে থাকলে দেখা হবে।”
–রাতে থাকব না তো মাসি, দুপুরেই চলে যাব।
-“এমা এলে, আর চলে যাবে..কি সুন্দর কথা বলো….ভালো লাগল, ভালো থেকো মা! আমার নাইট ডিউটি, এখন হ্যান্ডওভার দেবো, আর দেখা হবে না।”
–তুমিও ভালো থেকো মাসি।
“একি রে, ওটি’তে পেশেন্ট হাসছে! ভয় নেই..”
নার্স দিদি বললেন,”ও শীতে হাসছে”।
বললাম, শীতে দাঁতকপাটি লাগছে আর আমি হাসছি? সকলেই হেসে উঠলেন।
এবার অজ্ঞান হওয়ার পালা!
দু’জন কিছুক্ষণ আগে থেকেই দুই আঙুলের টোকায় সরু শিরা’কে মনের মতো করে নিতে উদ্যোগী ছিলেন, বললেন -“শীতে,vein সরু হয়ে গেছে”। ওমনি নতুন কিছু জানার জন্য ছটফট করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, কেন শীতে সরু হয়–উত্তর পেলাম, চামড়ার মতো ওটাও কুচকে যায়। মনে মনে বললাম, হ্যাঁ ওকে তো ক্রিমও দেওয়া যায় না-বোকা বোকা ভাবনায়, নিজেই হাসলাম।পরে ভাবলাম, আমার এল্ডার ব্রাদারের থেকে বিশদে জানতে হবে..কিন্তু সেটা হবে কিনা জানি না, বেশ অনেকদিন ধরেই যে সমস্ত’টাই ব্যস্ততার চাদর চাপা দেওয়া। একবার বরং গুগুলেও দেখে নেব না হয়।
এর মধ্যে যিনি অজ্ঞান করবেন, এসেই বললেন,”চ্যানেল করলি?” বাকি দু’জন বললেন, “খুব সরু vein, কিন্তু একটুও নড়েনি-তাই এক চান্সেই পারফেক্ট হয়েছে, আর পেশেন্ট দেখো এখনো হাসছে…” বড়ই স্নেহশীল মানুষ- হেসে, আমার কপালে হাত বুলিয়ে, পাল্টা উত্তর দিলেন-“তা কি করবে,কাঁদবে নাকি?” এসবের মধ্যে চোখ দরজায়’ই ছিল, বুঝতে পারছিলাম এবার অন্য জগতে যাবো, তার আগে যদি ওটি’তে চেনা মুখ’টা দেখতে পাই! এইসব হতে হতেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। নাকে অনেক হাওয়া, হাতে ইনজেকশান যার আমি নাম দিয়েছি বিষাক্ত তরল, কারণ ওটা যখনই ভেতরে যায় সেই মুহূর্তে ভীষণ জ্বালা-যন্ত্রণা হয়। কে যেন বললেন “হয়ে গেছে”। পরিচিত গলা বলে উঠল,”কি রে তুই অজ্ঞান হয়েছিস?” কে জিজ্ঞেস করলো,তা বুঝতে পেরেই বললাম,না হইনি-হবো, আমি তাড়াতাড়ি হইনা তো—-পরের মুহূর্তেই নিজের কথা নিজেই নস্যাৎ করে যখন চোখ খুললাম, দেখলাম আমি তখন already post-operative patient….! আশেপাশে সবাই সেই care করতেই ব্যস্ত।
এবার ছুটি, বাড়ি যাব। নার্স দিদি খোঁজ নিয়ে মৃদু ধমকের সুরে জানিয়ে গেলেন-স্যুপ বা চা-বিস্কুট না খাইয়ে ছাড়বেন না।
আর একজন আয়া মাসি এসে বললেন, “বাড়ি যাচ্ছ?সব গুছিয়ে দি।”,বললাম গোছানোই। তখনি সকালের ব্রাশ, সাবান, শ্যাম্পুর ব্যাগ দিয়ে বললেন “এটা তোমার নাও।” বললাম- আমি’তো বাড়ি থেকেই এসেছি, এগুলো লাগেনি তো-থাক এখানে। কোনো কথা না শুনেই ব্যাগে ভরে দিয়ে বললেন, “দেখে নিও, ছোটো খাপটায় ভরে দিলাম”। হাসলাম, না বলতে আর মন চাইল না। চ্যানেল খোলার পর ব্লাড বেরোচ্ছিল, একটু পরে নিজে-নিজেই থেমে যাবে ভেবে অতো গুরুত্ব দিয়েছিলাম না, মাসি নিজেই তুলো নিয়ে এসে ড্রেসিং করতে করতে বললেন, যদি কিছু মনে না করো, একটা কথা বলি..”শনি,মঙ্গল বার পাগলদের খেতে দিও, ঠিক বেবি এসে যাবে-এটা একটা টোটকা..”–বড্ড আন্তরিকতার সাথে বললেন। মন খারাপ বা রাগ হওয়ার কথা ছিল কিনা জানি না, আমি শধু স্নেহের পরশ’টুকুই পেলাম। তবে হ্যাঁ, এই ভাবনার বিরোধিতা করার দরকার ছিল, তাই এক্ষেত্রে মৌনতায় অসম্মতিও জানালাম।
Under GA তাও আমি একা নিজে খাট থেকে নেমে wash room গেছি, দিব্য হাঁটতে পারছিলাম, nausea ও আসতে ইতস্তত করছিল, জল-চা সবই সুন্দর খাচ্ছিলাম..এসব দেখে সাদা জামা পড়া সিনিয়ার নার্স দিদি আগের দিন অপারেশান হয়েছে বলে ভুল করছিলেন, সকালে হয়েছে শুনে গাল টিপে আদর করে বললেন,”মেয়ের খুব সহ্য-খুব সাহসী, কোনো কষ্ট নেই?” একগাল হেসে বললাম না’তো কোনো কষ্ট নেই। মনে মনে বললাম, আমায় আমার এল্ডার ব্রাদার অপারেশান করেছে-সে তাঁর পেশেন্ট’দের কষ্ট হতে দেয় না।
শেষে একটি অল্প বয়সী ছেলে অনেক না করা সত্ত্বেও হুইল চেয়ারে করে উবেরে তুলে দিয়ে গেল। ওঁদের protocol, তাই আমিও আমার আপত্তি শিকেয় তুলে রাজি হোলাম..পরিবর্তে সুন্দর একটা হাসিমুখ আর দিদি ডাক উপহার পেলাম।
এই সমস্ত প্রক্রিয়ায়, যিনি ‘captain of the ship’ সেই একজনের সঙ্গ আমার মনে চিরকালের! অন্তত আমার জন্য, তাঁর আর আমার সম্পর্কের শিরায় রক্ত বয়। কিন্তু বাকি পরিযায়ী আলাপের চিরস্থায়ী উষ্ণতার ভাপ চিরকাল মনে থাকবে।
“…….আমার দয়াল বন্ধু আছেতো সেইজনা
যার দয়াতে হয় সকল ব্যথা আনন্দেরই সোনা
হয় সে সুধারসের কণা
আমি তার ঠিকানা খুঁজে বেড়াই এপার ওপার সবখানে।।”