“ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্ নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ।।”
(“আত্মার কখনও জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না, অথবা পুনঃ পুনঃ তাঁর উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না৷ তিনি জন্মরহিত শাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চিরনবীন। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না।”)
শ্রীমদভগবদগীতা
“তিনিই নিষ্প্রাণ থেকে প্রাণের উন্মেষ ঘটান আবার প্রাণকে করেন নিষ্প্রাণ। ধূসর জমিনকে তিনিই সজীব করে তোলেন। এমনিভাবে তোমাদেরও মৃত অবস্থা থেকে পুনরুত্থিত করা হবে।”
সূরা রুম, আয়াত ১৯, পবিত্র কোরান
“And the dust returns to the earth as it was, and the spirit returns to God who gave it.”
The Holy Bible
মৃত্যু শাশ্বত, চিরন্তন এবং অবধারিত। এই নিয়ে সব ধর্ম একমত। আত্মার অস্তিত্ব নিয়েও প্রায় একই ভাবনা। আত্মা অবিনশ্বর। তবে পুনর্জন্ম ও মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে অল্পস্বল্প মতভেদ আছে। আর চিকিৎসা শাস্ত্র? সেও শুধু চেষ্টা করে আয়ু বাড়ানোর। অবধারিত মৃত্যুকে শেষ পর্যন্ত ঠেকানো যায় না তা সে বারংবার বলে। বিজ্ঞান এখনও মৃত্যু- পরবর্তী অস্তিত্ব সম্বন্ধে বিশেষ নিশ্চিত নয়। তবে মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত। বিজ্ঞানের ভাষায়, মৃত্যুর অর্থ মস্তিষ্কের মৃত্যু। হৃদপিন্ড সচল থাকলেও যার মস্তিষ্ক মৃত, সে ব্যক্তি মৃত।
কিন্তু ভারতীয় আইনে বড় মারপ্যাঁচ।Withdrawal of Life Support বা Withholding Life Support এই নিয়ে কোন স্পষ্ট আইন নেই।
ব্যক্তিগত ভাবে এতদিন ICU-তে কাজের সূত্রে দেখেছি, ভেন্টিলেশনে বা লাইফ সাপোর্টে থাকা রোগীর বাড়ির লোকজন প্রধানতঃ দুটি কারণে রোগীকে ভেন্টিলেশন থেকে খুলে নেবার কথা বলেন।
১) বিলের বোঝা। অর্থনৈতিক দিক থেকে সমস্ত রকম উৎস গুলি, জীবনবীমা,স্বাস্থ্যবীমা ইত্যাদি নিংড়ে ফেলেও লক্ষ লক্ষ টাকার জোগান বিশেষ করে মধ্যবিত্তদের পক্ষে দুঃস্বপ্নের মত হয়ে দাঁড়ায়।
২) দীর্ঘ রোগভোগে জরাজীর্ণ প্রিয়জন কে মুমূর্ষু অবস্থায়, চোখের সামনে, তিলে তিলে শেষ হয়ে যেতে দেখার মানসিক চাপ।
ডাক্তাররা নিজেদের তরফ থেকে বোঝাবার চেষ্টা করেন যে, কোন স্পষ্ট আইন নেই। তাই ভেন্টিলেশন এভাবে খুলে দেওয়া যায় না। কারণ, পরবর্তী কালে আইনি জটিলতার চিন্তা যেমন আত্মীয়দের আছে, তার চেয়ে শতগুণে সে চিন্তা রয়েছে ডাক্তারদের মনে।
আইন কি বলছে?
প্রচূর বিপরীতধর্মী কথা বলছে।
১) Organ Donation Act 1994 অনুযায়ী, যে ব্যক্তির মরণোত্তর অঙ্গদানের কথা ভাবা হচ্ছে, সেই ব্যক্তির “ব্রেন ডেথ” কথাটা ঘোষণা করতে পারেন চিকিৎসকরা।
২) Indian Medical Council regulations 2002 তে Euthanasia বা ইচ্ছামৃত্যুতে সাহায্য করাকে Unethical এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে। Withdrawal of life support আসলে এক ধরণের Active euthanasia,যা একমাত্র প্রযোজ্য বলা হয় মরণোত্তর অঙ্গদানের ক্ষেত্রে।
৩)2006 সালে আসে “Medical Treatment of Terminally ill patient (for the protection of patients and medical practitioners)- একটু ব্যাখ্যা করি।
ভারতীয় সংবিধানের Article 21 যা আসলে বলছে বেঁচে থাকাটাই মৌলিক অধিকার, তা একেবারেই Withdrawal of support এর পরিপন্থী। ভেন্টিলেশন খুলে নেওয়াটা একেবারে অসাংবিধানিক পর্যায়ে চলে যাবে। এদিকে, Indian Penal Code এর Suicide (309) বা Abetment of Suicide(306) অনুযায়ী, আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া তো অপরাধই, আত্মহত্যার চেষ্টা নিজেই একটি অপরাধ। এই দিক ঠিক রাখতে গিয়ে ওদিকে দীর্ঘ রোগভোগের যন্ত্রণা থেকে মানুষ মুক্তি পেতে চাইলে (Euthanasia), শুধু পেনাল কোড, মেডিক্যাল কাউন্সিল বা ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ক্রিটিকাল কেয়ার মেডিসিনই নয়, ভারতের উচ্চ আদালতও সেটিকে গ্রাহ্য করতে পারছেন না। ভারতে এই নিয়ে শেষ ঘোষণা হয়েছে ২০১১ সালে অরুণা শানবাগের ক্ষেত্রে। ৩৭ বছর ধরে ‘ভেজিটেটিভ স্টেট’ (Vegetative state)-এ থাকা অরুণার euthanasia+র আবেদন নাকচ হয়ে যায়। তবে সুপ্রিম কোর্ট বলে যে, এক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ অবস্থায় “passive euthanasia” করা যেতে পারে। অর্থাৎ খাবার, জল ইত্যাদি অত্যাবশ্যক উপাদান শরীরে সরবরাহ না করা,অবশ্যই আত্মীয়দের অনুমতি নিয়ে! কি বিচিত্র ব্যাপার। সম্মানিত, মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকার আছে, কিন্তু মর্যাদাপূর্ণ মৃত্যু ( dignified death) ব্যক্তির মৌলিক অধিকার নয় এখনো!
এইসব কারণে জীবনের শেষ অবস্থায় যে উন্নতমানের ” End of life care” দেওয়া যায়, তাতে অনেকভাবেই আইনগত জটিলতা র সম্মুখীন হন ডাক্তার ও আত্মীয় উভয়পক্ষ। “শেষ অবস্থায় প্রিয় মানুষ টা কে হাসপাতালে অবধি নিয়ে গেল না, চিকিৎসা ও করাল না” আত্মীয়দের সমালোচনার মুখে পড়ার ভয় থেকেই, মৃত্যু আসন্ন জেনেও রোগীকে ভেন্টিলেশনে দেবার কনসেন্ট দেন অনেকে। তারপর পড়ে যান চক্রব্যূহে। ভেন্টিলেশন তো এক্ষেত্রে আয়ু বাড়াবে, জীবন ফিরিয়ে দেবে না!
এইসব ভেবে ২০০৬ সালে Law Commission of India র ১৯৬ তম Draft bill আসে। এতে বলা হয় –
-সবার আগে দেখতে হবে রোগীর জন্যে সবথেকে ভালো কি হতে পারে- “best interest of the patient”.
– রোগীর চিকিৎসা না নেওয়ার অধিকার বা প্রত্যাখ্যান কে গ্রাহ্য করতে হবে, জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
-রোগী নিজে মতামত দেবার মত মানসিক ও শারীরিক অবস্থায় না থাকলে, অথবা বাড়ির লোকের informed decision না থাকলে, ডাক্তার ই রোগীর best interest এর কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন… কত কি ভাবতে হবে ডাক্তার দের? বিল বলছে… ” include medical, emotional, ethical,social and welfare considerations” !!!
– Withdrawal of Life Support বা Witholding Life support এর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে, আগে হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ রা একত্রিত হয়ে চিকিৎসার অনুপযোগিতা( Futile life support treatment) সম্বন্ধে একমত হবেন এবং সেই সিদ্ধান্ত আত্মীয়দের জানানো হবে।
– তৎকালীন মেডিকেল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া কে একটি End of life care এর guideline বের করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
অর্থাৎ ডাক্তাররা যে তিমিরে সে তিমিরেই রয়ে গেলেন। রোগীর বেস্ট ইন্টারেস্টও ভাবতে হবে, আবার আর্থসামাজিক দিকটাও দেখতে হবে। আইনের দিক থেকেও ভুল হলে চলবে না!
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি ভেন্টিলেশন থেকে বের করার আইনি জটিলতা সম্পর্কে রোগীর পরিবার কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে কনসেন্ট ফর্মে সই করানোর জন্য রীতিমতো জোরাজুরি করা হয় হাসপাতাল তরফে।যেখানে পেশেন্ট কন্ডিশন (I.P.F with lung cancer,non performing terminally ill patient)পরিষ্কার ইংগিত করছে ভেন্টিলেশন থেকে না ফেরার।কোলকাতার নামী একটি হসপিটালের ঘটনা।
এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও রোগীর আত্মীয়ের মধ্যে খোলাখুলি আলোচনা হওয়া ভীষণ জরুরি। আত্মীয় দের মধ্যে যে আবেগ কাজ করে তাকেও ডাক্তার কে গুরুত্ব দিতে হয়। তবে শেষ সিদ্ধান্ত কিন্তু রোগীর আত্মীয়দের ই নিতে হয়। ভেন্টিলেশনে দেবার ও না দেবার সমস্ত দিক গুলি খতিয়ে দেখে। তাও, যদি এমন হয় যে রোগীর আত্মীয় ভেন্টিলেশনে না দিতে মনস্থ করেছেন, আর হাসপাতাল এর তরফ থেকে জোর করে ভেন্টিলেশনে দেবার সই করানো হয়েছে, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করে দেখতে পারেন। এক্ষেত্রে যদি সেই আলোচনা, অর্থাৎ “ইনফর্মড কন্সেন্ট” নেবার প্রক্রিয়া টি কোথাও নথিবদ্ধ করা আছে তাহলে কোর্টের সুবিধে হয়। একবার ইনফর্মড কন্সেন্টে হ্যাঁ বলার পর আর ভেন্টিলেশনে দেবার পর, না বললে ফিরে আসার আর পথ নেই। শেষ পর্ব টি পড়ে দেখতে অনুরোধ করছি। আর এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের দেশের বেশীর ভাগ হাসপাতালকে এখনো মুমূর্ষু রোগীর আত্মীয় দের কাউন্সেলিং এ অনেক উন্নতি করতে হবে।