ফেসবুকে আমার জীবনের সম্ভবত এখন অব্দি সবচেয়ে দাগ কেটে যাওয়া ঘটনাটা শেয়ার করছি।
ডাক্তার হিসেবে মৃত্যু দেখেছি অনেক। আমার অত্যন্ত কাছের মানুষকেও চলে যেতে দেখেছি। কিন্তু সেসব আমার চোখের সামনে। এবার চোখের ভেতর দিয়ে মৃত্যু দেখলাম।
গত পরশু। ডিউটিতেই আছি। দুপুর থেকে পেট কামড়াচ্ছিল। কিছু ওষুধ খেলাম কিন্তু একটা ঘ্যানঘেনে পেট ব্যথা থেকেই গেল। এদিকে নাইট ডিউটি আছে। একটু না ঘুমিয়ে নিলে হবে না। পেট ব্যথার জন্য ঘুম আসছিল না কিছুতেই। সিদ্ধান্ত নিলাম ইঞ্জেকশন নিয়ে নেবো।
খুব সাধারণ পেট ব্যথার ইঞ্জেকশন। ভুরি ভুরি পেশেন্টকে দেওয়া হয়। ভুরি ভুরি পেশেন্ট ওই ইঞ্জেকশন পেয়েই সুস্থ হয়। আর আজ ডাক্তার বলে নয়, সিরিঞ্জ দেখলে আমার ভয় করে না কোনকালেই। কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতাটাও, বলতে নেই, একটু বেশির দিকেই। নার্স দিদিমণিদের সামনে হাত পেতে দিলাম..
বেশ ইয়ার্কি করতে করতেই ইঞ্জেকশন নিচ্ছিলাম। দিদি প্রফেশনাল দক্ষতায় মাখনের মতো ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলেন। তারপর..জাস্ট ধরুন, তিরিশ সেকেন্ড!! হাতটা চুলকোতে শুরু করলো। আমি তখনও স্থির হয়ে দ্বিতীয় ইঞ্জেকশনটা নিচ্ছি।
মাথাটা ঘুরতে আরম্ভ করলো। আমি ‘কষ্ট হচ্ছে’ শুধু এইটুকু বলে চেয়ার থেকে উঠে সামনে নার্স দিদিমণিদের ঘরের দরজাটা ঠেলে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কে যেন পা দুটো ধরে তুলে দিলেন..
দিদিমণিরা হঠাৎ এই অবস্থা দেখে পুরো চমকে হতবাক হয়ে গেছেন। বিদ্যুৎ চমকের মত আমার মাথায় খেলে গেল কী হতে যাচ্ছে। চেঁচিয়ে বললাম ‘অ্যাড্রিনালিন..কুইক’!!
ততক্ষণে মাথা থেকে পা অব্দি কারা যেন অজস্র ঝাঁকুনি দিচ্ছে!! টলমল করছে সামনের পৃথিবী!! হুড়মুড় করে বমি হয়ে গেল। বুঝতে পারছি যে কোনও সময় অজ্ঞান হয়ে যেতে পারি। তখনও যতটা মাথা খেলছিল বলে যাচ্ছিলাম..’অক্সিজেন..আম্বু..চেস্ট কম্প্রেশন..মেডিসিন থেকে হর্ষদাকে ডাকুন..’
ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাস হারিয়েছি বহুদিন। কাল ওই সময়েও একবারের জন্যও কোনও ঠাকুরের নাম বা কথা মনে আসে নি। একজনের মুখই ভেসে উঠছিল- সে আমার মেয়ে,আরশি।
প্রত্যেকটা সেকেন্ড যেন কী বড়!! বুক চেপে ধরছে কেউ!! শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে!! আর কেমন একটা কালো কালো ভয়ের অনুভূতি.. সেটাকে বর্ণনা করার ক্ষমতা এই ‘ভাষা-মজদুর’-এর নেই। সেটাকেই কি আগতপ্রায় মৃত্যু বলে? জানি না।
তারপর অ্যাড্রিনালিন ইঞ্জেকশন!! দেওয়ার সেকেন্ড খানেকের মধ্যেই মনে হল যেন শরীরের ঝাঁকুনিটা অনেক কমে এলো!! অ্যাড্রিনালিন দিয়ে হার্টবিট ফিরিয়েছি অনেকবার। এবার নিজে বুঝলাম।
ততক্ষণে হর্ষদা এসে গেছে। গোটা হাসপাতালের দিদিমণি, ওয়ার্ড বয় আমার জন্য চারদিকে ছোটাছুটি করছেন। আরও কয়েকটা ইঞ্জেকশন দেওয়া হ’ল। কদিন ধরে যে স্টেরয়েড নিয়ে বকবক করছিলাম, আমার জীবনদায়ী ওষুধগুলোর মধ্যে দুটো স্টেরয়েড ছিল। স্টেরয়েড আমাকে বাঁচালো।
অনেকগুলো ইঞ্জেকশন, স্যালাইন পাওয়ার পরেও হর্ষদা প্রেশার চেক করলো.. ৭০/৪০। পালস ৪০-৪৫। মানে পুরো শক!! তারপর আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে এলো।
এবারের কথাগুলো কেটে কেটে পড়ুন।
এই ঘটনা যদি আপনাদের নিকট আত্মীয়ের সাথে হত, আপনি কী করতেন? বলুন,বলুন..
থাক আমিই বলছি। অন-ডিউটি নার্স দিদিমণির চুলের মুঠি ধরতেন, ডাক্তারের মাথা দেওয়ালে ঠুকে দিতেন। মেরেই ফেলতেন হয়তো। তখন আপনার বক্তব্য পরিষ্কার ভুল ইঞ্জেকশন দিয়ে এসব হয়েছে।
এবং, ঠিক এই জায়গাটা নিয়েই আমার বক্তব্য। ‘ভুল ইঞ্জেকশন’ নয়!!! ওটা পেয়েই হাজার হাজার মানুষ সুস্থ হয়েছেন। কিন্তু আমার শরীরে ওটা সহ্য হয়নি। এতে কারো কোনও দোষ নেই। নইলে, বলুন না আমিই কি খুব জেনেবুঝে ওটা নিতে যেতাম? আমার জীবনের, থুড়ি, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলে গেলাম কোনও ডাক্তার বা নার্সিং স্টাফ ইচ্ছে করে পেশেন্টকে ভুল ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে ফেলার কথা ভাবতেও পারেন না। আমার কথা বিশ্বাস না হয়, আপনার ভগবান-আল্লাহ-গড বা আমার না-ঈশ্বরের কসম-এতে কারো কোনও দোষ নেই!!
এবার তার পরের ঘটনায় আসি। যে দুজন দিদি ডিউটিতে ছিলেন তাঁরা তো বটেই, গোটা হাসপাতাল আমার জন্য ছুটে বেড়িয়েছে!! আমি বাড়িতেও কাউকে অনেকক্ষণ জানাই নি। আমি জানতাম, আমি আমার সহকর্মীদের সাথে আছি মানে নিরাপদ হাতে আছি। শুধু শুধু যারা দূরে আছে তাদের টেনশন বাড়িয়ে লাভ নেই।
রাতে আমার জন্য খাবার বানিয়ে পাঠিয়েছেন একজন দিদি। কেউ এসে বারে বারে পালস-বিপি দেখে গেছেন। আর এসব কিছুর মাঝে কে যেন একজন হাতে গুঁজে দিয়ে গেছেন একটা ছোট্ট ফুল!! ফুলটা অনেকটা শুকিয়ে গেছে। বইয়ের পাতার মধ্যে রেখে দিয়েছি। অনেক স্মৃতি ফিকে হয়ে আসবে। তবু এই শুভেচ্ছা আমাকে ঘিরে থাকবেই।
একটু সুস্থ হতে বেড থেকে উঠে বসেছি। সাধারণত বিকেল পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটায় ইভনিং রাউন্ড শুরু করি। ওইদিন রাত দশটায় দিলাম। হাতে তখনও চ্যানেলটা গাঁথা। রাতে আরাধ্যার মা ফোন করেছিলেন। আরাধ্যার কিছু সমস্যা হচ্ছে। আরাধ্যাকে মনে আছে তো? ওই যে খিঁচুনি নিয়ে প্রায় মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়া যে মেয়েটাকে আমরা সবাই মিলে ফিরিয়ে এনেছিলাম..
সকালে অজস্র মানুষের ঢল!! ওপরের ওয়ার্ডের সিস্টার-ইন-চার্জ দিদি, বয়সে আমি যাঁর প্রায় ছেলের বয়সী। এমনি সময় প্রফেশনাল এথিকস মেনে ‘আপনি’ দিয়ে কথা বলেন। কাল সোজ্জা ‘তুই’। ‘তুই ভালো থাক বাবা’ বলা জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। যেখানে এক পা ফেলেছি সবাই খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। শেষের দিকে আমারই উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত লাগছিল। তোমাদের/আপনাদের সবার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। এত মানুষের ভালোবাসা!! আমার জন্য!! আমার মত সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকতে এর চেয়ে বেশি আর কিছু লাগে না।
আর যে কথাগুলো বারবার বলি সেটাই আরও একবার বলি-নার্স দিদিদের শ্রদ্ধা করুন। পুরো মেডিক্যাল সিস্টেমে যদি কোনও একজনকে সম্মান দিতে হয় সেটা নার্সিং স্টাফকে দিন। দোহাই, আপনার জেঠুর শাশুড়ির সেজো পিসির খারাপ অভিজ্ঞতার কথা বলবেন না। ওরকম পাঁক খুঁজে বেড়ালে ভালো কিচ্ছু দেখতে পাবেন না। আমি, আপনি বেঁচে আছি তাঁদের জন্য।
ফেরার সময় পিয়ালী এসেছিল। ক্লান্ত লাগছিল। খড়গপুর স্টেশনে সিঁড়ি-গুলো উঠতে একটু কষ্ট হচ্ছিল। ওকে বলিনি। আপাতত নিরাপদে ফিরে এসেছি। ভালোই আছি।
মাথা-পেটের টিবি নিয়ে ভর্তি বাচ্চাটার বিচ্ছিরি জ্বরটা কমেছে কিন্তু লিভারের দোষের জন্য সবকটা টিবির ওষুধ এখনো চালু করতে পারিনি। সাত নম্বরের জ্বর আসছে। বাড়ি থেকে ফোনে সবার খবর নিচ্ছি।
আজকাল কেন জানিনা,হসপিটাল ছাড়ার সময় মন খারাপ হয়ে যায়। কত কাজ বাকি…ভালো আমাকে থাকতে হবেই..