নতুন রোগে বিপর্যস্ত গোটা পৃথিবী। কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পুরনো রোগও। যার নাম ‘তথ্য গোপন’।
করোনার দাপটে নাজেহাল বিশ্ববাসী। সংক্রমণ দিন দিন বাড়ছে। জনজীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আর সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে, তা হল, সাধারণ মানুষের কাছে কতটা সঠিক তথ্য উঠে আসছে?
ইতালি, ব্রিটেন, কিংবা আমেরিকার মতো প্রথম সারির দেশ করোনা দুর্যোগ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। এরমধ্যেই অভিযোগ উঠছে, অনেক ক্ষেত্রেই তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ঠিক মতো করা হচ্ছে না। তথ্য গোপনের অভিযোগও উঠেছে।
ইতালিতে করোনার ভয়াবহতার ছবি দেখে এই খোঁজ প্রথম শুরু হয়। ইতালির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অন্যান্য অনেক দেশের থেকেই উন্নত। তা সত্বেও এরকম পরিস্থিতি কেন তৈরি হল? জানা যায়, জ্বর, শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা নিয়ে একাধিক রোগী হাসপাতালে গেলেও স্বাস্থ্য প্রশাসন সে নিয়ে বাড়তি উদ্বেগ দেখায়নি। ততদিনে কিন্তু বিশ্বের কাছে চিনের করোনা আক্রমণের খবর পৌঁছে গিয়েছে। ইতালি ও চিনের যোগসূত্র বেশ মজবুত। চিন থেকে বহু শ্রমিক ইতালির বস্ত্র কারখানায় কাজের জন্য যাতায়াত করেন। তবুও উন্নত দেশের স্বাস্থ্য প্রশাসন তথ্যের সঠিক বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়নি। যার মাশুল গুনছে কয়েক লক্ষ প্রাণ।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের বিরুদ্ধেও তথ্য গোপনের অভিযোগ উঠছে। সম্প্রতি সে দেশের প্রথম সারির একাধিক পত্রিকায় এই অভিযোগ তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, করোনা সংক্রমণের প্রথম ধাপ থেকে সরকার আক্রান্তের তালিকা সঠিকভাবে প্রকাশ করেনি। আবার অনেকের প্রশ্ন, ব্রিটেনে স্বাস্থ্য প্রশাসনের কাছে সঠিক তথ্য আদৌও ছিল কি? আমেরিকার প্রশাসনের বিরুদ্ধে আবার অভিযোগ মৃত্যু সংখ্যা বিভিন্ন প্রদেশে কম করে বলা হচ্ছে। যেমন, একটি আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র অভিযোগ তুলেছে, ওয়াশিংটনের মৃত্যু হার কমিয়ে প্রকাশ করা হচ্ছে। আবার কিংসের মোট মৃত্যু সংখ্যার হিসেব মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন প্রশাসনের বড়বাবু।
সুদূর আমেরিকার ‘সাদা’ বাড়ি হোক কিংবা হাওড়ার ‘নীল-সাদা’ বাড়ি তথ্য গোপনের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। যে কোনো বিপর্যয়ে ভুক্তভোগীর সংখ্যা সরকার কমিয়ে বলবে, এটাই যেন দস্তুর। ইতিহাসে সে উদাহরণ একাধিক রয়েছে। তাই ভারতের সিপাহী বিদ্রোহ হোক কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তর পর্বের পারমাণবিক হামলা, যে কোনও ঘটনায় সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি তথ্যসূত্র পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে খুব জরুরি। বিশেষত অতিমারির মোকাবিলায় মূল অস্ত্র কিন্তু তথ্য।
কোথায় কত জন আক্রান্ত হচ্ছেন কিংবা কতজন জন মারা যাচ্ছেন, সরকারের কাছে এই হিসেব থাকাই যথেষ্ট নয়। অতিমারির সংক্রমণ রুখতে নাগরিকদের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক তথ্য জানতে না পারলে, নাগরিক কিন্তু পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝবে না। তখন তার উপযুক্ত আচরণও আশা করা যাবে না।
কোনো রাজ্যে করোনায় মৃত্যু সংখ্যা যদি সত্যিই ৩-৪ জনের মধ্যে আটকে থাকে, তাহলে কি সত্যিই দিনের পর দিন লকডাউন করে বাড়িতে আটকে থাকার প্রয়োজন রয়েছে?! কেন নাগরিকেরা স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ বদলাতে রাজি হবে? সত্যিই প্রকোপ বাড়লে তবেই জনগণ ফি-দিনের অভ্যস্ত জীবন যাপন বদলে রাজি হবে। তাই জনগণের সামনে সঠিক তথ্য তুলে ধরা জরুরি।
এ রাজ্যে ডেঙ্গু জ্বরের তথ্য প্রকাশের জন্য চিকিৎসকের ঘাড়ে শাস্তির কোপ পড়েছিলো। আদালতের দ্বারস্থ হয়ে জনস্বার্থ মামলা করতে হয়েছিল। এবার করোনার তথ্য জানার জন্য চিকিৎসক, স্বাস্থ্য কর্মী থেকে সাংবাদিক, সকলকেই রণসজ্জায় ভূষিত হতে হচ্ছে। যে তথ্যের অধিকার সাধারণ মানুষ থেকে স্বাস্থ্য পরিষেবায় যুক্ত বিশেষজ্ঞ প্রত্যেকের রয়েছে, তার জন্য এত লড়াই কেন করতে হবে?
রাজনীতিবিদেরা ভোট-রাজনীতির কথা ভাববেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আগে তো ভোটারদের বাঁচাতে হবে। প্রথম বিশ্বের দেশনায়কেরাই তাদের ভোটারদের সুস্থ রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। তাই ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দের ১ শতাংশ ঠিকমতো ব্যবহার হয় কিনা সে নিয়ে সংশয় থাকে, সেখানে করোনা মোকাবিলায় ‘সব আন্ডার কন্ট্রোল’ বড্ড সোনার পাথর বাটি মনে হয়।
বর্তমানের এই বিপর্যয়ের দায় কোনো ব্যক্তি মানুষ বা রাজনৈতিক দলের নয়। তাহলে কি গোপনের চেষ্টা চলছে! ফাইলের গোপন কথাটি গোপন থাকলে কিন্তু শুধু প্রজার নয়, রাজারও সমান বিপদ। করোনা কিন্তু সিংহাসন বোঝে না। তাই বিশ্বাসযোগ্য তথ্য প্রকাশের দায়িত্ব সরকার এড়াতে পারে না। আর যদি সরকারের দেওয়া তথ্য সত্য হয়, তাহলে সরকারকেই পর্যালোচনা করতে হবে, কেন সরকারি তথ্যের উপর সাধারণের বিশ্বাস হারাচ্ছে।
কোরোনা সংক্রান্ত তথ্য গোপনে চীন এক নম্বরে। অথচ অবাক হচ্ছি চীনের কোথাও নাম দেখলাম না লেখাটিতে। অন্য অংশের সাথে অবশ্য সহমত প্রকাশ করছি।
চীন যে এক নম্বরে তাই নিয়ে তো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু দুই তিনে যারা আছে তাদের কথা কাউকে তো লিখতে হবে।
চীনের তথ্য নিয়ে বরাবর প্রশ্ন ওঠে। তার পিছনে অনেকেই চীনের ‘একনায়কতন্ত্রী সরকার’-র ভূমিকার কথাও বারবার উঠে আসে। কিন্তু যে দেশগুলোকে গনতন্ত্রের মাতৃভূমি বলে উপাধি দেওয়া হয়, সেই দেশেও যখন সরকারের তথ্যের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তখন সেই আলোচনা আরো জরুরি বলে আমি মনে করি।
আর শুধু চীন কেনো কিউবা, গ্রীস এরা যে করোনা আটকাতে সক্ষম তা নিয়েও কেউ কথা বলছে না একমাত্র এই পোর্টাল ছারা