সাদেক মিঞার পালঙ্কে
যেন সুখ পাতা আছে।
চৌকাঠে, শেষ বিকেলের
রাঙা রোদ্দুরের মতো
টাকার ওম লেগে থাকে —
তবু সুলেখার বুকের খাঁচায়,
পাখিটা কেবলই ডানা ঝাপটায়,
”রশিইইদ—- রশিইইইইদ—”
ডাকটা ফেরত আসে না আর।
এলোচুল ডাকিনীর মতো বয়ে চলে পদ্মা —
ধুধু জল,
শুধু জল,
দেখে বুক কাঁপে —
নদীকূলের দামী গঞ্জের নামী পাড়া ঘেঁষে,
দশ ঘর হিঁদু,
ভাঙনের পুত্রকন্যা,
জড়ামড়ি করে বাঁচে।
বাঁচে কি আদৌ?
কাঁটাতারের নিরাপদ পারে,
শোনে যারা,
ভাবে —
উফ, লোকগুলোর কি বুকের পাটা!
রুগ্ন, ভিতু মানুষগুলোর
বুকের পাটা না থাক,
ওদের ছোট তরফের মেয়ে সুলেখার
বুকের সৌষ্ঠব ছিল খুব।
মানী লোক সাদেক মিঞা,
দস্তুরমত নিকে করে আনলে তাকে,
কলমা পড়িয়ে —
দশ ঘর হিঁদু —
সুখ না হোক,
স্বস্তি কিনলে যেন!
নামাজি লোক মিঞা —
আজানের সুরে বিজাতীয় গন্ধ,
হাদিসের পাতায় অচেনা আঁকাবাঁকা আখরগুলি পরপুরুষের মতো নিলাজ চোখে তাকায় —
সুলেখা চুল বাঁধতে ভোলে,
সুর্মা আঁকতে ভোলে,
গান গাইতেও ভুলে যায় —
বেতমিজ বিবিকে
আদরের জুবান শেখাতে
নামে সাদেক মিঞার চাবুক —
কান্নায় ভিজে, বোবা ডাক
পদ্মার চর ভাসিয়ে দেয় তখন,
”রশিইইদ— রশিইইইদ—-”
উত্তর আসে না।
কাকজোছনায় ভিজতে ভিজতে,
পেয়ারাপাতা দুলিয়ে যাওয়া
বাতাস শুধোয় আনমনে —
”হেইডা-ও তো মোসলমানের পোলা,
হ্যার লেইগ্যা ক্যান অ্যাত্তো উথালপাথাল?”
সোনার পিঞ্জরায় মন বসে না,
সাদেক মিঞার আতরবিবির।
পাঁয়জোর আর সলমা জরির হিজাব খুলে,
একদিন হারিয়ে যাবে সুলেখা —
শরতের পেঁজা মেঘে,
নবান্নের ধানে,
রুপোলি ইলিশের ঝাঁকে,
ঠিক হারিয়ে যাবে।
ও-ই যেখানে রশিদ গেছে,
মুখে মায়ের দুধের গন্ধমাখা ভাষা নিয়ে,
ফাগবসন্তে পলাশরঙা কলিজা তার,
উপড়ে দিয়ে,
ওই যেখানে রশিদ গেছে —
সে-ও একদিন হারাবে ঠিক।
ভাঙা হাটে ধুলোর ঘূর্ণি,
ডুবসাঁতারে কলার ভেলা,
নারকেল পাতায় ঝলসানো রোদ —
সবাই যেন হৃদয় ছিঁড়ে
ডাকবে সেদিন,
”রশিইইদ– রশিইইইদ—-”
জবাব খুঁজবে সারা পৃথিবী।