একটা ভিডিও দেখলাম। অনেকেই দেখেছেন। মাস্ক না পরার জন্য একজন জেলা শাসক কান ধরে ওঠবোস করাচ্ছেন। এমন ছবিও দেখলাম, পুলিশ রাস্তায় মাস্ক উপহার দিচ্ছে বাইক আরোহীকে। সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে মাস্ক পরা না পরা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। সরকার লিখিত নির্দেশ জারি করেছেন মাস্ক পরার অনুরোধ জানিয়ে। এই পটভূমিকায় মাস্ক নিয়ে দু’চারটি কথা বলা প্রয়োজন।
করোনা সংক্রমণ বিস্তাররোধে মাস্ক ব্যবহার কতটা ভূমিকা নিতে পারে অর্থাৎ তার কার্যকারিতা নিয়ে উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণের অভাবে অনেক বিতর্ক আছে। তাই যে সব তথ্য-প্রমাণ সন্দেহাতীত ভাবে আজ পর্যন্ত প্রমাণিত সে নিয়ে কথা বলাটাই যুক্তিযুক্ত হবে।
এটা প্রমাণিত যে মেডিক্যাল বা সার্জিক্যাল মাস্কের ফিল্টার করার সক্ষমতা যেখানে ৩ মাইক্রোমিটার ডায়ামেটারের ড্রপলেট, সেখানে “ফিল্টারিং ফেসপিস রেসপিরেটর” (বা এফএফআর সংক্ষেপে রেসপিরেটর) এর ফিল্টার করার সক্ষমতা ০.০৭৫ মাইক্রোমিটার সলিড পার্টিকেলের।
ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড ইএন ১৪৯ অনুযায়ী এফএফপি টু মাস্কগুলি ৯৪% সলিড NaCl ও অয়েল ড্রপলেট পার্টিকেল ফিল্টার করতে পারে অথবা মার্কিন স্ট্যান্ডার্ড এনআইওএসএইচ ৪২ অনুযায়ী এন৯৫ মাস্কগুলি ৯৫% NaCl পার্টিকেল ফিল্টার করতে পারে।
খারাপ খবর একটাই। এই সব রেসপিরেটর মাস্কের দাম সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্কের চেয়ে অনেকটাই বেশি। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও তার অনুসরণ করে ভারতের ICMR স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য যে মাস্ক ব্যবহারবিধি বানিয়েছেন তাতে মাস্কের কার্যকারিতার চেয়ে দামের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁরা স্বাস্থ্যকর্মীদের “রিস্ক এসেসমেন্ট” ভিত্তিক নিদান দিয়েছেন, কাকে কখন কোন ধরণের মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। এক কথায় বিজ্ঞানকে কম্প্রোমাইজ হয়েছে দামের কথা ভেবে। বিজ্ঞানের আবিষ্কার এন৯৫ বা এফএফপি টু মাস্ক সব স্বাস্থ্যকর্মী পাচ্ছেন না সরকার থেকে।
এবার আসা যাক জনসাধারণের কথায়। গোড়াতেই একথা বলে রাখা ভালো যে এই স্বাস্থ্যকর্মী-জনসাধারণ বিভাগটাই কৃত্রিম, অবৈজ্ঞানিক। ধরুন একজন ব্যাঙ্ককর্মী বা সাধারণ প্রশাসন আধিকারিক বা পুলিশ, তারা স্বাস্থ্যকর্মী নন ঠিকই কিন্তু তাঁরা তো সাধারণ জনগণের চেয়ে অনেক বেশি এক্সপোসড হচ্ছেন পেশার খাতিরে। এই বিষয়টা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ICMR এর গাইডলাইনে একেবারেই অনুপস্থিত। স্বাস্থ্য কর্মীদের চেয়ে তাঁদের জীবনের দাম কম এটা কি প্রমাণিত ?
জনসাধারণের কথায় ফেরা যাক। WHO-এর নিদান অনুযায়ী যার উপসর্গ আছে তিনি মেডিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করবেন যাতে তার থেকে ছড়িয়ে না পরে রোগ। কোনো অসুবিধে নেই। কিন্তু আমরা সবাই জেনে ফেলেছি যে উপসর্গ দেখা দেওয়ার আগে (পরিভাষায় প্রি সিম্পটম্যাটিক) এবং উপসর্গবিহীন রুগীরাও (পরিভাষায় এসিম্পটম্যাটিক) রোগজীবাণু ছড়াতে পারেন। তাঁদের বেলায়?
জনসাধারণের জন্য ১২-১৬ লেয়ার কটন মাস্ক বা “নন-মেডিক্যাল” মাস্ক এই সংক্রমণ ছড়ানো রোধে কতটা কার্যকর সে নিয়ে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ হাতে না থাকা সত্ত্বেও ওইগুলি ব্যবহারের নিদান দিচ্ছে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ। পয়সার অভাবে জনসাধারণকে সার্জিক্যাল মাস্ক বা রেসপিরেটর ব্যবহারের কথা বলছেন না কেউ। ভাবখানা এমন, নেই মামার চেয়ে কানা মামা তো ভালো।
সরকার-রাষ্ট্র-সংস্থার এই আঁতাত একটা সহজ সরল সত্য আমাদের ভুলিয়ে দিতে চাইছে। তা হল এই যে, মানুষ আবিষ্কার করে ফেললেও তার সুবিধে সবাই পাবেন না। কারণ হল অর্থ বা অর্থের অভাব।
আমরা সবাই দয়ামায়াহীন বাজার অর্থনীতি নির্ভর একটা সমাজে বসবাস করছি যেখানে সবকিছুই পণ্য এটা মেনে নিন। আমার আপনার যথেষ্ট পয়সা নেই তাই অনেক কিছুই কিনতে পারবো না, এন৯৫ মুখোশও নয়। আর পারবো না বলেই নিজেকে স্তোকবাক্য দেবো, সান্ত্বনা দেবো, WHO তো বলেনি ওটা কিনতে।
ফুটপাথে ঢালাও বিক্রি হওয়া মাস্ক নামের ধাপ্পাবাজি কিনে বাড়ি ফিরবো। ডায়াবিটিস আক্রান্ত বৃদ্ধ বাবা, সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর হাতে গেঞ্জি কাপড়ের রিইউজেবল মাস্ক তুলে দিয়ে ভাববো কর্তব্যকর্ম করলাম।
এভাবেই আমরা বাঁচবো। ভুল বলেছিলাম। ফুটপাথ থেকে ধাপ্পা নয়, স্বপ্ন কিনে ফিরেছি। পরের জন্মে অন্ততঃ একপিস এন৯৫ কেনার সামর্থ্য নিয়ে যেন জন্মাই।
খুব ভালো লাগলো।
সাধারণ মানুষকেও এন ৯৫ মাস্ক পড়তে হবে জানতাম না।