ঠাকুর্দাকে আমি চোখে দেখিনি। তিনি নাকি গ্রামে গঞ্জে ঘোড়ায় চড়ে রোগী দেখে বেড়াতেন। বাবাকে দেখেছি সাইকেলে রোগীর বাড়ি যেতে। সেখানে আমি স্কুটারে খুপরি থেকে খুপরিতে রোগী দেখে বেড়াই। রীতিমতো উন্নতিই বলা চলে। তাতেও অনেকের আপত্তি। ‘ডাক্তারবাবু, আপনি চারচাকায় আসেন না কেন? জম্পেশ একটা গাড়ি চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। দেখে ভক্তি হবে।’
আমি মনে মনে গাল দি। এই ভদ্রলোকই একটু আগে বলতে চেষ্টা করেছেন, আমি একজন সত্যিকারের চিকিৎসক। বাকি সবাই কসাই। মাঝপথে ধমক দিয়ে থামিয়েছি। তাতে এনার ইগো আহত হয়েছে। তাই খুঁত খুঁজে বার করার চেষ্টা করছেন। এই পবননন্দনের মকরের ক্রন্দন বন্ধ করে বিদায় করা দরকার। বললাম, ‘তিনদিন আগে যে ডাক্তারবাবুকে দেখিয়েছেন, উনি যা ওষুধ লিখেছেন, সেই ওষুধ খান। না কমলে ওনার কাছে সাতদিন বাদে আর একবার যান। আমি নতুন কিছু দেব না। এবার আপনি আসুন.’
পরের রোগী নড়বড়ে একজন বৃদ্ধা। তাঁকে সঙ্গে করে এনেছে যে দুজন তাঁদেরও বৃদ্ধাই বলা চলে। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, ‘অনেক দিন বাদে এলেন। কেমন আছেন আপনারা?’
বৃদ্ধা হাসলেন। বললেন, ‘হারাধনের পাঁচটি মেয়ে, রইল বাকি তিন।’
সাথে সাথে পিছিয়ে গেলাম সাতটা বছর। এম ডি পাশ করে সরকারি চাকরির সাথে সাথে প্রাইভেট প্র্যাকটিসও শুরু করেছি। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত হাসপাতালে কাটে। রাতে বাড়িতে রোগী দেখি। রোগী দেখি কথাটা অবশ্য বলা উচিৎ নয়। রোগী আসলে তো দেখব। সাধ করে সেগুন কাঠের একটা নাম, ডিগ্রী লেখা ফলক বানিয়েছিলাম। একমাসেও সেটা বানানোর খরচ ওঠেনি।
আমি তখন খুপরিতে বসে বসে কবিতা লিখতাম। মাসে একটা কবিতা পত্রিকা বার করতাম। দুয়েকজন আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশী মাঝে মাঝে দেখাতে আসতেন, তাঁদের পত্রিকা দিতাম।
এরকম এক রাতে সবে ভাবছি এবার খুপরিতে তালা দিয়ে মেয়ের সাথে খেলা করি। তখনও একটাই মেয়ে- ছোটোটা হয়নি। হঠাৎ একটা ভ্যানের প্যাঁ পোঁ। ‘ডাক্তারবাবু, আছেন নাকি?’
আহা, রোগী এসেছে। একেবারে অপরিচিত রোগী।
এক বয়স্ক মহিলা ভ্যানে শুয়ে। সাথে আরও দুজন বয়স্ক মহিলা। তাঁদের একজন বললেন, ‘আমার মেজদি। দুপুর থেকে বমি করছে। মাথাই তুলতে পারছে না। কেমন ঝিমিয়ে যাচ্ছে। ও আবার একগাদা নার্ভের ওষুধ খায়। মেডিফিল্ডে গেছিলুম। কিন্তু ওখানে এখন কোনো ডাক্তার নেই। ওখানেই একজন বলল, এসময় আপনাকে পাওয়া যেতে পারে।’
সবাই মিলে ধরাধরি করে ওনাকে খুপরিতে ঢোকানো হল। টেবিলে শুইয়ে প্রেশার দেখলাম। অনেক বেশি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘প্রেশারের ওষুধ খান?’
আগের মহিলাই উত্তর দিলেন। ‘খায়তো, একগাদা ওষুধ খায়। আমিই খাওয়াই। তবে ওষুধ খেতে বড়ো জ্বালাতন করে। মেজদির আসলে ছোটো থেকেই মাথার ডিফেক্ট আছে।’
তিনটে ইংজেকশন দিলাম। বললাম, ‘কুড়ি পঁচিশ মিনিট দেখুন। উন্নতি হলে বাড়ি নিয়ে যাবেন। আমি তখন ওষুধপত্র লিখে দেব।’
আমি দোতলায় গেলাম। রূপালী জিজ্ঞেস করল, ‘সব বন্ধ করে এসেছো? গেটে তালা দিয়েছো?’
গর্বিত ভাবে বললাম, ‘তালা দেব কী! চেম্বারে রোগী আছে। ইংজেকশন দিয়ে অবজারভেশনে রেখে এসেছি।’
নিজেই বেশি করে গুঁড়ো দুধ আর চিনি দিয়ে এক কাপ চা বানালাম। তারপর তাড়াহুড়ো করে খেতে গিয়ে জিভ পুড়িয়ে ফেললাম। চা শেষ করে নিচে গিয়ে দেখি মেজদি উঠে বসেছেন। অন্যদুজন মহিলার মুখেও হাসি। ওষুধপত্র লিখে দিলাম। যাওয়ার আগে ওন্য দুই মহিলাই আমার মাথায় হাতটাত বুলিয়ে ‘বাবা ভালো থেকো, অনেক বড়ো ডাক্তার হও’ এইসব বলে গেলেন।
তারপর থেকেই ওনারা মাঝে মাঝেই আসতেন। ওনারা পাঁচ বোন। ছোটো বোনের বয়স বাহান্ন, বড় জনের সাতষট্টি। আমিও ওনাদের বড়দি, মেজদি, সেজদি, ন’দি, ছোড়দি বলে ডাকতাম। ছোড়দি ছাড়া সকলেই নানারকম রোগাক্রান্ত। ন’দির রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস আছে। বাকিদের প্রেশার, হাঁটু ব্যথা। আর আগেই বলেছি মেজদির মানসিক রোগ আছে।
ছোড়দিই কারও কিছু সমস্যা হলে নিয়ে আসতেন। সেসময় এমন ঘাড় গুঁজে রোগী দেখতে হতো না। রোগীদের সাথে গল্প করার বেশ সুযোগ পেতাম। শুধু রোগ আর রোগের চিকিৎসাই নয়, অনেক কিছু নিয়েই গল্প হতো।
মেজদি বাদে বাকি চারদিদিই বেশ হাসিখুশি। বেশ রসিক। ছোড়দি বলতেন, ‘আমি এই চার দিদিকে নিয়ে জ্বলে পুড়ে মরছি। একেকজন একেক অবতার। কেউ নিজের ওষুধটুকুও ঠিক করে খেতে পারে না। আমি না হাতে তুলে দিলে ওষুধ বন্ধ।’ তিনি রাগ দেখাতেন বটে, কিন্তু দিব্যি বুঝতাম পাঁচজনেই বেশ আনন্দে আছেন, নিজেদের মতো আছেন।
যতো দিন যেতে লাগলো, তত তাঁদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়লো। ছোড়দি মাঝে মাঝেই ঠাকুরের প্রসাদ, গাছের বেল, নারকেল, আম দিয়ে যেতেন। বছরে একবার সবাই মিলে পুরী যেতেন। ফেরার দিনই খুপরিতে এসে আমাকে প্রসাদ, পুরীর খাজা, টুকটাক উপহার দিয়ে যেতেন। আমি রাগ করতাম। বলতাম, ‘এসব আনার কী দরকার।’
ছোড়দি বলতেন, ‘দরকারটা আপনার নয়, দরকারটা আমাদের। পাঁচ বোনে পরিবারের থেকে আলাদা হয়ে থাকি। আমাদের ভালোবাসার লোকের বড়ো অভাব।’
এক সন্ধ্যায় সেজদির ফোন পেলাম, ‘ডাক্তারবাবু, আপনি কী আজ একবার আমাদের বাড়ি আসতে পারবেন? বড়দির শরীরটা খুব খারাপ। নিয়ে যাওয়া মুশকিল।’
স্কুটার নিয়ে চলে গেলাম। বড়দিকে দেখে বুঝলাম স্ট্রোক হয়েছে। ডানদিকটা দূর্বল। ভাগ্য ভালো খুব বড়সড় কিছু হয়নি। বললাম, ‘একটা সিটি স্ক্যান করতে হবে আর কিছু টুকটাক পরীক্ষা। আর কাল থেকেই ফিজিওথেরাপি শুরু করে দিন। রোজ ফিজিওথেরাপি করলে হাত পায়ের জোর চলে আসবে।’
ওনাদের বাড়িটা বেশ। সামনে বড়ো বাগান। আম, জাম, বেল ইত্যাদি অনেক ফলের গাছ আছে। গাছগুলিকে আগে না দেখলেও এদের ফলের সাথে আমার অনেকদিন আগেই পরিচয় হয়ে গেছে। ন’দি আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখালেন। বললেন, ‘বাবা এটুকুই আমাদের জন্য রেখে যেতে পেরেছিলেন। তাই শেষ জীবনটা বৃদ্ধাশ্রমের বদলে পাঁচ বোনে একসাথে থাকতে পারছি।’
পাঁচজনের পরিবার পরিজনের কী হলো, তারা কোথায় থাকেন- এসব জিজ্ঞেস করতে রুচিতে বাধলো। তাছাড়া জেনে করবই বা কী? নিজের চোখেই তো দেখছি ওনারা বেশ আনন্দে আছেন। ঘরদোরের অবস্থা দেখে অর্থনৈতিক সমস্যা আছে বলেও মনে হচ্ছে না।
মাসখানেক বাদেই সেজদি, ন’দি আর ছোড়দি এসে হাজির। জানালেন বড়দি ভালো আছেন। ওয়াকার নিয়ে দিব্যি হাঁটতে পারছেন। তাঁরা একদিন দুপুরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করতে এসেছেন।
অনেক না না করলাম। কিন্তু ভালোবাসার আবদার কাটানো মুশকিল। এক শনিবার দুপুরে গেলাম। এলাহি খাওয়াদাওয়া। চিংড়ি, ইলিশ, খাসীর মাংস সব একসাথে। খেতে বসেছি, মেজদি কোথা থেকে একটা হাতপাখা এনে হাওয়া শুরু করলেন। অন্য চার বোন হেসে কুটো পাটি। ছোড়দি বললেন, ‘তোর মাথাটা সত্যিই গেছে। ওরে পাখা চলছে তো।’
মেজদি কিছু বললেন না। শুধু হাতপাখার গতিবেগ আরো বাড়িয়ে দিল।
বড়দি বললেন, ‘মেজোর কান্ডকারখানা দেখতে দেখতে দিব্যি আমাদের দিন কেটে যায়। তবে ও খুব ভালো ক্যারাম খেলে। ওকে ক্যারামে আমরা কেউ হারাতে পারি না।’
বললাম, ‘আপনারা তো বেশ মজাতেই আছেন। আমি কতোদিন ক্যারাম খেলি না।’
‘শুধু ক্যারাম, কী খেলতে চান বলুন। লুডো, দাবা, বাগাডুলি, চাইনিজ চেকার- সব আছে। একটাই শুধু সমস্যা প্রায় সব খেলাই সর্বাধিক চারজন মিলে খেলা যায়। আর আমরা পাঁচ জন। তাই নিয়ে মাঝে মাঝে একটু আধটু ঝামেলা হয়। খাওয়ার পর মেজোর সাথে একদান ক্যারাম খেলে যাবেন।’
আমার বড্ড ভালো লাগছিল। এই স্নেহ, এই মমতা, এই খুনসুটি এটুকুর জন্যই তো আমাদের বেঁচে থাকাটা এতো সুন্দর। ক্যারাম খেলার সময় বড়দি বললেন, ‘আমাদের বাবার নাম ছিল হারাধন চক্রবর্তী। সকলে বলতো হারাধনের পাঁচটি মেয়ে।’
যত দিন কাটতে লাগলো, আমার ব্যস্ততা বাড়তে থাকল। তার মধ্যে হাসপাতালে ঝামেলা শুরু হল। এক অতিপ্রিয় সিনিয়র দাদা আমাকে চাকরি জীবনের শুরুতেই বুঝিয়েছিল, ‘হাসপাতালে আসবি, রোগী দেখবি আর পালিয়ে যাবি। এর বেশি আর কিছু করতে গেলেই বিপদে পড়বি। দাদার কথা শুনিনি, তাই বিপদে পড়লাম। বড়কর্তাদের ব্যাডবুকে নাম উঠে গেল। প্রায় প্রতিদিনই হায়ার অথোরিটির একটা করে প্রেম পত্তর পেতাম। পকেটে গোছা গোছা প্রেম পত্তর নিয়ে ঘুরতাম। প্রথম দুচারটের জবাব দিয়েছিলাম। তারপর আর জবাব দিতাম না। অবশেষে দুত্তোর বলে চাকরি ছেড়ে দিলাম।
তার কিছুদিনের মধ্যে চলে এলো কোভিড মহামারী। হঠাৎ করে চারপাশটা বদলে গেল। অনেকদিন পাঁচ বোনের কেউই আসেন না। লকডাউন চলছে। বয়স্করা বাড়ির বাইরে বেরোতে ভয় পেতেন। ছোড়দি আবার এলেন আমফানের পরের দিন। সঙ্গে প্রায় একবস্তা আম। বললেন, ‘মনটা বড় খারাপ হয়ে গেছে। কাল ঝড়ে আম গাছটা পরে গেছে। ঐ আম গাছ আমার জন্মেরও আগেকার। কত স্মৃতি… ওই আমগাছে ওঠার জন্য একবার মার কাছে রাম ধোলাই খেয়েছিলাম। আপনারা সবাই মিলে খাবেন। আর তো গাছের আম খাওয়াতে পারবো না।’
বললাম, ‘আপনারা আছেন কেমন? অনেকদিন আসেন না?’
ছোড়দি বললেন, ‘ভয়ে বাড়ি থেকে বেরোই না। আমি একদিন বাজার করে আনি। পাঁচজনে মিলে সাতদিন ধরে খাই। টিভিতে যা সব দেখাচ্ছে। করোনার আগেই না আতঙ্কে মরে যাই।’
২০২০র ডিসেম্বর থেকে করোনা বেশ কমে গেল। পাঁচ বোন আবার ডাক্তার দেখাতে আসা শুরু করলেন। অনেকদিন কোনো পরীক্ষানিরীক্ষা করানো হয় না। পাঁচ জনেই বিভিন্ন রক্ত পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেখালেন। সেজদি বললেন, ‘এবছর আর পুরী যাওয়া হলো না। মনটা খারাপ। আর ক’বছরই বা সবাই মিলে যেতে পারব। বড়দি ভালো থাকলে আর পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে সামনের বছর জুলাই মাসে পুরী যাবই।’
আর পুরী যাওয়া। চির বঞ্চিত প্রথম লকডাউনেই আধমরা বাঙালি ভোট ভোট করে করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে একেবারে ঘরে এনে ঢোকালো। ব্রিগেডের আড়াই তিন লাখের বি গ্রেড রাজনীতি হাজার হাজার প্রিয় মানুষের জীবন কাড়তে শুরু করল। এবং ভোট মেটার সাথে সাথেই আবার লকডাউন শুরু হলো।
মে মাসের মাঝামাঝি এক সন্ধ্যায় ফোন পেলাম। ‘ডাক্তারবাবু, আমি পাঁচ বোনের সেজদি বলছি। বড্ড মুশকিলে পড়েছি। ছোটোর করোনা হয়েছিল। একটা নার্সিংহোমে ভর্তি গত চারদিন। ওর অবস্থা ভালো নয়। আপনাকে ফোনে পাচ্ছিলাম না বলে জানানো হয়নি। ওদিকে প্রচুর টাকা বিল হচ্ছে। চারদিনেই এক লাখ ছাড়িয়েছে। আপনি কী সরকারি কোনো ভালো হাসপাতালে একটা বেডের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন।’
আর বেড… এরকম ফোন তখন দিনে অন্তত দশটা পাচ্ছি। সকলকেই বলছি সরাসরি স্বাস্থ্যভবনের হেল্প লাইন নাম্বারে ফোন করতে। সেসময় হাসপাতালে বেডের যা অবস্থা নিজে অসুস্থ হলেও সম্ভবত বেড জোগাড় করতে পারতাম না। সেকথাই জানালাম।
দু’দিন বাদে আবার সেজদির ফোন। ‘ডাক্তারবাবু, শিগগিরি আমাদের এখানে একবার আসতে পারেন। মেজদির অবস্থা খুব খারাপ।’
বলললাম, ‘আমি তো একটা চেম্বারে রোগী দেখছি। শেষ করতে করতে ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। তারপর যেতে পারি।’
একটু থেমে সেজদি বললেন, ‘তাই আসুন তাহলে। মনে হচ্ছে দিদি আর নেই।’
রোগী দেখা শেষ করেই স্কুটার নিয়ে ছুটলাম। গিয়ে দেখি সত্যিই মেজদি মারা গেছেন। তিনদিদি খাটের পাশে বসে আছেন। বড়দি বললেন, ‘ছোটো্ হাসপাতালে। মেজোর এই সময়েই যেতে হলো।’
‘আপনারা আত্মীয় স্বজনদের খবর দিয়েছেন?’
‘আর কাকে খবর দেব? খবর দিলেই বা কি কেউ আসবে? এমনি সময়য়েই কেউ খোঁজ খবর নেয় না, আর এই লোক ডাউনের সময় তো আরোও আসবে না। সেজোর এক ছেলে কাছাকাছিই থাকে। ফোন করায় স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে মহামারীর মধ্যে মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানে যেতে পারবে না। আমাদেরই যা করার করতে হবে।’
আমি আর কথা বাড়ালাম না। এরপর মনোরমায় চেম্বার আছে। ডেথ সার্টিফিকেট লিখে চলে এলাম।
এর ঠিক চারদিন বাদে এক রোগীর মুখে আরও খারাপ খবর পেলাম। ছোটোবোন, যিনি করোনা হয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলেন, তিনি নাকি মারা গেছেন।
অন্যসময় হলে কী হতো জানিনা, সে সময় রোজই এতো মৃত্যু সংবাদ পাচ্ছি যে খারাপ লাগলেও মেনে নিচ্ছিলাম। শুধু মনে হচ্ছিল, বাকি তিন বোন কী করছেন? কেমন আছেন? খবর নেওয়ার মত মানসিক জোর পাচ্ছিলাম না।
তার মাস দেড়েক বাদে করনার তাণ্ডব তখন বেশ কমেছে, একদিন তিন বোন এসে হাজির। বড়দিও অসুস্থ শরীর নিয়ে এসেছেন।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, ‘অনেক দিন বাদে এলেন। কেমন আছেন আপনারা?’
বড়দি হাসলেন। বললেন, ‘হারাধনের পাঁচটি মেয়ে, রইল বাকি তিন। শেষবার আপনার সাথে দেখা করতে এলাম।’
অবাক হয়ে বললাম, ‘শেষবার কেন?’
‘আমরা আর এখানে থাকছি না। বাড়ি বিক্রি করে ব্যারাকপুরের এক বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাচ্ছি। ছোটো বোনই আমাদের আগলে রেখেছিল। সেই যখন থাকলো না। আমাদের সন্তানরাও দূরে দূরে থাকে। তারাও এটাই চায়। প্রতিবাদ করবো যে তেমন জোর কই?’
যাওয়ার সময় আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘ভালো থেকো বাবা, সুস্থ্য থেকো। ভাগ্যে থাকলে আবার দেখা হবে।’
ছবিঃ © শ্রীময় ভট্টাচার্য