টরন্টো জেনারল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও থম্পসনের অভিভাবক উভয়ই ‘ম্যাক্লাউডের সেরাম’ দিয়ে থম্পসনের চিকিৎসা করতে রাজি হলেন। সেই সম্মতিক্রমে, ১১ই জানুয়ারি ১৯২২, সকাল ১১টা, ডায়াবিটিস আক্রান্ত কিশোর থম্পসনের দুই পাছায় সাড়ে সাত সিসি করে মোট ১৫ সিসি ‘ম্যাক্লাউডের সেরাম’ ইঞ্জেকশন দেওয়া হলো। ডা. ক্যাম্বলের অধীনস্থ জনৈক ‘হাউস ফিজিশিয়ন’ ডা. এডোয়ার্ড জেফরি ইঞ্জেকশনটা দেন থম্পসনকে। লিওনার্ড থম্পসনই হলেন পৃথিবীর প্রথম মানুষ যাঁকে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছিল। আর ডা. জেফরিই হলেন পৃথিবীর প্রথম চিকিৎসক যিনি কোনও মানুষের দেহে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন দেন। ডায়াবিটিস বিশেষজ্ঞ হিসেবে কোনও অভিজ্ঞতা না থাকায় এবং টরন্টো হাসপাতালের চিকিৎসক না হওয়ার কারণে, থম্পসনকে ইঞ্জেকশন দেওয়ার সময় ওয়ার্ডে উপস্থিত থাকার অনুমতি দেওয়া হয়নি বান্টিঙকে।
থম্পসনের রিপোর্ট কার্ড। নীচের থেকে ৫ নম্বর লাইনে (অস্পষ্ট হয়ে গেছে) লেখা আছে ‘Jan 11th 15 cc. Mcleod’s serum 7½ cc into Each buttock’ |
বান্টিঙ-বেস্টের তৈরি করা এই প্যানক্রিয়াস নির্যাস প্রয়োগ করে, কিশোর থম্পসনের শারীরিক অবস্থার বিশেষ কোনও উন্নতি পরিলক্ষিত হলো না। থম্পসনের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা ডা:ক্যাম্বলের ঊর্ধ্বতন, ডা: ডানকান গ্রাহাম পুনরায় থম্পসনকে ‘সেরাম’ প্রয়োগ করতে অস্বীকার করেন। বান্টিঙের নির্যাসের উপর এমনিতেই বিশেষ আস্থা ছিল না ডা:গ্রাহামের। প্রথম থেকেই এই ‘সেরাম’ প্রয়োগের বিরোধিতাই করে এসেছিলেন তিনি। নেহাৎ অন্য সবাই রাজি ছিল বলে তখনকার মতো চুপ করে যান তিনি। কিন্তু আর নয়, আর চুপ করে থাকবেন না তিনি। দ্বিতীয়বার এই সেরাম প্রয়োগ করতে সরাসরি অস্বীকার করেন ডা:গ্রাহাম।
সমস্ত ঘটনার পরিণতিতে বেশ হতাশ হয়ে পড়লেন বান্টিঙ। একেই তাঁর নির্যাস প্রয়োগে আশানুরূপ কোনও ফল পাওয়া যায় নি, তার উপরে আবার তাঁর প্রস্তুত করা নির্যাসকে ‘ম্যাক্লাউডের সেরাম’ নামে অভিহিত করছেন সবাই। তাঁর স্বপ্নের আবিষ্কার থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর নামটাই বাদ! আরও বড় বিপদ হলো, দ্বিতীয়বার এই ইঞ্জেকশন দিতে অস্বীকার করলো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সহসাই চারিদিকে যেন আঁধার ঘনিয়ে এল বান্টিঙের জীবনে। তাঁদের পরিশোধিত নির্যাস বিফলে যাওয়া মানেই, কলিপের তৈরি করা ইনসুলিন প্রয়োগের পথ প্রশস্ত হয়ে যাওয়া। আর বান্টিঙ বিলক্ষণ জানেন, কলিপ পরিশোধিত ইনসুলিন প্রয়োগ করবেনই ম্যাক্লাউড। কলিপের সেরাম যদি ফলপ্রসূ হয়, আর সেই সম্ভাবনা যথেষ্টই বেশি বলে মনে করেন বান্টিঙ, তাহলে তো তাঁর স্বপ্নের সমাধি ঘটবে। অজানা আশঙ্কায় মানসিক ভাবে ভেঙে পড়লেন বান্টিঙ। পরবর্তী কালে এই প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, “এটা ছিল আমার চূড়ান্ত এক প্রস্তুতির সময়। ম্যাক্লাউড ও অন্যান্য স্টাফদের সাথে এখনও যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ বেস্ট। কোনও চিত্রের মধ্যেই আমি আর নেই। [আমার] সমস্ত ফিজিওলজিক্যাল পর্যবেক্ষণ ম্যাক্লাউডের [জানা]। বায়োকেমিস্ট্রির [দায়িত্ব] কলিপ নিয়ে নিয়েছে। … ওদের কেউই আর আমার সাথে কিছু [কাজ] করতে চায় না”।
আজ এতটাই হতাশ হয়ে পড়লেন বান্টিঙ যে স্বাভাবিক যুক্তিবোধও বুঝি হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। না হলে তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগী বেস্টকেও সন্দেহ করেন তিনি! তিনি মনে করছেন তাঁর দুর্দিন দেখে বেস্টও বুঝি কলিপের দলে ভিড়ে গেছেন। নিতান্তই অমূলক ছিল বান্টিঙের এই সন্দেহ। তবে এটা ঠিকই অনুমান করেছিলেন তিনি যে ম্যাক্লাউড এবার কলিপ পরিশোধিত ইনসুলিন প্রয়োগ করবেন। সেই রকম প্রস্তুতিও নিচ্ছেন ম্যাক্লাউড। কিন্তু বান্টিঙকে সে সব খবর জানাচ্ছেন না কেউ। বেশ চিন্তায় আছেন তাই তিনি। ভুগতে শুরু করেছেন মানসিক অবসাদে। সাত পাঁচ ভাবছেন, আর মনে মনে ফুঁসে উঠছেন। ভাবছেন, আমরা ঠিক মতো ইনসুলিন পরিশোধন করতে পারলাম না, অথচ কলিপ ঠিক পারলেন! কি ভাবে পারলেন কলিপ?
এদিকে প্যানক্রিয়াস নির্যাস পরিশোধন প্রক্রিয়ায় রোজই কিছু না কিছু ছোটোখাট পরিবর্তন আনছেন কলিপ। পরীক্ষারগারে পরিশোধিত নির্যাস প্রয়োগ করে দারুণ সফল হলেন কলিপ। এমনই একদিন, পরিশোধনে সফল হয়ে, খুশিতে উদ্বেল হয়ে দ্রুত বান্টিঙের গবেষণা কক্ষে এসে হাজির হলেন কলিপ। দরজা ঠেলে ঢুকেই বললেন, “পেয়ে গেছি”। হতচকিত বান্টিঙের এটা বুঝতে অসুবিধা হয় নি যে, কি পাওয়ার কথা বলতে চাইছেন কলিপ। শুষ্ক কন্ঠে বান্টিঙ বললেন, “বাহ্, এতো ভালো কথা”। ঠিক কি পদ্ধতিতে নির্যাস পরিশোধন করে সফল হলেন কলিপ তা জানতে ভীষণই উৎসুক বান্টিঙ। তাই জিজ্ঞাসা করলেন, “কিভাবে পেলে এটা”। সতর্ক কলিপের সটান জবাব, “সে কথা আপনাকে জানাতে বাধ্য নই আমি”।
ইনসুলিনের চার মহারথী |
ব্যস, আর যায় কোথায়! এমনিতেই মেজাজ খিঁচিয়ে ছিল বান্টিঙের, তার উপরে এভাবে সরাসরি প্রত্যাখ্যান! মুখের উপর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা! ক্ষিপ্ত বান্টিঙ চড়াও হলেন কলিপের উপর, তাঁর কোর্টের কলার চেপে ধরে ঝাঁকাতে থাকেন বান্টিঙ। চিৎকার করে ধমকাতে থাকেন কলিপকে। এবার হাতাহাতি হবার উপক্রম। ঘটনাক্রমে সেই সময়ে সেই ঘরে উপস্থিত ছিলেন বেস্ট। দ্রুত গিয়ে বান্টিঙকে চেপে ধরে টানতে লাগলেন বেস্ট। বেস্টের তৎপরতায়, লজ্জাজনক হাতাহাতি থেকে সে যাত্রায় রক্ষা পেলেন দুই সম্মানীয় বিজ্ঞানী। পরবর্তী কালে এই প্রসঙ্গে বেস্ট লিখেছেন, “ভাগ্য ভালো জখম হন নি কলিপ। আমার মনে আছে, আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে বান্টিঙকে নিরত করেছিলাম [আমি]। … হয়তো লক্ষাধিক ডায়াবিটিস রোগীর জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছিলাম আমি, কিন্তু একটা জীবন আমি নিশ্চিত ভাবে বাঁচিয়ে ছিলাম- বার্ট কলিপ”।
পরবর্তীকালে কলিপের সাথে মারামারির কথা স্বীকার করেছেন বান্টিঙ। তাঁর নিজের ভাষায়, “… বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আমাদের ছোট্ট ঘরটায় এলেন তিনি [কলিপ]। দরজা দিয়ে ঢুকে বললেন, ‘ওহে, ভায়া, আমি পেয়ে গেছি।’ [তাঁর দিকে] ফিরে বললাম, ‘বাহ্, অভিনন্দন। কিভাবে পেলে তুমি?’ কলিপের জবাব, ‘আমি ভেবেছি তোমাকে তা বলবো না’। … সে চলে যাবার উপক্রম করছিল। এক হাতে তাঁর ওভারকোটের সামনের দিকটা খামচে ধরে প্রায় শূন্যে তুলে সজোরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলাম [কলিপকে]। তখন ঠিক কি বলেছিলাম মনে করতে পারছি না তবে [এটা] মনে যে আছে আমি বলেছিলাম, সামান্য হলেও ভালো কাজ করেছো তুমি, নয়তো মেরে তোমাকে নরকে পাঠাতাম”।
এই ঘটনা প্রসঙ্গে অন্যত্র বান্টিঙ লিখেছেন, “ডা: কলিপ, মিঃ বেস্ট ও আমার মধ্যে হওয়া ভদ্রলোকের চুক্তির খেলাপ হয়েছিল [সেদিন], আমাদের [পরীক্ষার] সমস্ত ফলাফল নিজেদের মধ্যে জানাতে সম্মত হয়েছিলাম আমরা। এই নতুন নির্যাস নিয়ে [কেবলমাত্র] প্রফেসর ম্যাক্লাউডের সাথে আলোচনা করতেন ডা: কলিপ এবং এই পদ্ধতি গোপন রাখার জন্য প্রফেসর ম্যাক্লাউডের সম্মতি আদায় করতেন [তিনি]। আমার ধারণা এই সময়ে ডা: কলিপ এই পদ্ধতিটা [নিজের নামে] পেটেন্ট করাবার চেষ্টায় ছিলেন এবং একমাত্র প্রফেসর ম্যাক্লাউড, হান্টার এবং হেন্ডারসন এই কাজ থেকে তাঁকে নিরত করেছিলেন”।
(বাঁদিকে) মায়ের কোলে লিওনার্ড থম্পসন। (ডানদিকে) ইনসুলিন নেওয়ার ৬ মাসে পরে থম্পসনের ছবি। |
এই অংশে এক নতুন আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেছেন বান্টিঙ- পেটেন্ট। ইনসুলিন হোক বা আইলেটিন, বান্টিঙের আবিষ্কার কিন্তু পেটেন্ট করানো হয় নি তখনও। উপরন্তু, তাঁর আবিষ্কারকে ডাকা হচ্ছে ম্যাক্লাউডের সেরাম নামে! মনে মনে একটা বিপদ আঁচ করছিলেন তিনি। আর সেই বিপদ হলো- পেটেন্ট। কলিপ যদি পেটেন্টের আবেদন করে থাকেন, তাহলে কলিপই হবেন ইনসুলিনের আবিষ্কারক। তাঁর সমস্ত পরিশ্রম মাঠে মারা যাবে সে ক্ষেত্রে। বস্তুত সেই কারণেই কলিপের উপর আগেই থেকেই চটে ছিলেন বান্টিঙ। কলিপ প্রসঙ্গে তাঁর মনে জমে ছিল বারুদের স্তুপ। আর বান্টিঙকে পরিশোধন পদ্ধতি জানাতে সরাসরি অস্বীকার করাটা স্ফূলিঙ্গের কাজ করেছিল মাত্র। ফল বশত ঘটে ছিল সেদিনের বিস্ফোরণ।
বান্টিঙ-কলিপ সংঘাতের খবর পৌঁছল ম্যাক্লাউডের কানে। ম্যাক্লাউড বিচক্ষণ ব্যক্তি। বান্টিঙ, বেস্ট ও কলিপকে তলব করলেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, যদি কাজ করতে হয় তাহলে সবাইকে মিলে মিশে একসাথে কাজ করতে হবে আর যদি একক কৃতিত্ব নিতে চাও, তাহলে নিজের পথ দেখে নাও। ম্যাক্লাউডের কথায় আপত্তি করল না কেউই। বিচক্ষণ ম্যাক্লাউড জানেন, ঝগড়ার পর সবার মাথাই কিছুটা হলেও ঠান্ডা এই মুহূর্তে। তাই এখনই তাঁর কথায় আপত্তি করছেন না কেউই। কিন্তু কাল যে সবাই এই ‘ভদ্রলোকের চুক্তি’ মেনে কাজ করবেন তার নিশ্চয়তা কোথায়? তার চেয়ে বরং কাগজ কলমে লেখা পড়া হয়ে যাক একটা। সেই ভেবে, এক চুক্তিপত্রের প্রস্তাব দিলেন ম্যাক্লাউড। এবিষয়ে সবার মতামত জানতে চাইলেন তিনি। তাঁর প্রস্তাবে আপত্তি করলো না কেউই। সবাই চান, হয়ে যাক একটা লেখাপড়া। ঠিক হলো, একটা চুক্তিপত্র প্রস্তুত করা হবে। তাতে বিধি নিষেধ লেখা থাকবে। কি করা যাবে আর কি করা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি বিস্তারিত ভাবে লেখা থাকবে সেই পত্রে। সে চুক্তিপত্র পড়ে, তাতে সই করতে হবে সবাইকে। ম্যাক্লাউডের প্রস্তাবে বাধ্য ছাত্রের মতো ঘাড় নাড়লেন সাবাই।
কয়েক দিনের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল চুক্তিপত্র। নিজেদের বোঝাপড়ায় যাতে সমস্যা না হয়, সেইদিকে নজর রেখেই তৈরি হলো নিয়ম। অন্যান্য নিয়মের পাশাপাশি চুক্তিপত্রে উল্লেখযোগ্য ভাবে লেখা হলো, কোনও প্রবন্ধ প্রকাশের ক্ষেত্রে, বা অন্য কোনও ক্ষেত্রে বর্ণানুক্রমে ব্যবহৃত হবে তাঁদের নাম। ইংরাজি বর্ণানুসারে প্রথম নাম আসবে বান্টিঙের, তারপর বেস্ট ও কলিপের আর সব শেষে আসবে ম্যাক্লাউডের নাম।
জানুয়ারি ১৯২২। বান্টিঙ, বেস্ট, কলিপ, ম্যাক্লাউড- চারজন বিজ্ঞানী একসাথে কাজ করবেন বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে সই করলেন সেই চুক্তিপত্রে। আপাতভাবে মিটল সমস্ত বিবাদ। তৈরি হলো এক শান্তির পরিবেশ। খুশি মনে সবাই ফিরলেন যে যাঁর কাজে।
থম্পসনের রিপোর্ট কার্ডে কলিপের সেরামের উল্লেখ। বাঁদিকে Date এর নীচে লেখা Jan 23, পাশে কালো ও লাল কালি দিয়ে আন্ডারলাইন করা প্রথম দুটো দাগের মাঝ লেখা আছে ‘5 cc of Colip serum – abdomen’ |
চুক্তিপত্রের পাশাপাশি আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেন ম্যাক্লাউড। একটা টিম তৈরি করলেন তিনি। ইনসুলিন নিয়ে তাঁর অধীনে এখনও পর্যন্ত যাঁরা যাঁরা কাজ করেছেন বা ভবিষ্যতেও কাজ করবেন তাঁদের নিয়ে এক অলিখিত টিম তৈরি করলেন ম্যাক্লাউড। ম্যাক্লাউড, বান্টিঙ, বেস্ট, কলিপ ছাড়াও সেই টিমে এলেন ক্যাম্বল, ফ্লেচার, (টস খ্যাত) নোবেল এবং আরও দু’এক জন। কনট মেডিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিসে ইনসুলিন আবিষ্কারের পিছনে কিছু না কিছু ভূমিকা আছেই এই টরন্টো টিমের সদস্যদের। ইনসুলিন সংক্রান্ত গবেষণার অগ্রগতি ও ফলাফল নিয়ে এই টিমের সদস্যদের লেখা প্রবন্ধ, প্রায়ই প্রকাশিত হতে লাগল বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। এই সমস্ত নিবন্ধ পড়েই, সারা বিশ্বের মানুষ ক্রমেই ওয়াকিবহাল হতে থাকলেন ইনসুলিনের সাফল্য সম্পর্কে।
পারস্পরিক চুক্তি হলো। অলিখিত টিমও হলো। কিন্তু আসল কাজটার কি হবে? মানুষের উপর ইনসুলিন প্রয়োগের কি হবে? এবারও হাল ধরলেন ম্যাক্লাউড। ক্যাম্বলের সাথে কথা বলে, টরন্টো জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে রাজি করিয়ে থম্পসনের চিকিৎসায় আরেকবার ‘সেরাম’ প্রয়োগের অনুমতি পাওয়া গেল। তবে এবার আর বান্টিঙ-বেস্টের প্রস্তুত করা ‘ম্যাক্লাউডের সেরাম’ প্রয়োগ করা হবে না। এবার প্রয়োগ করা হবে ‘কলিপের সেরাম’। ২৩শে জানুয়ারি ১৯২২, সকাল ১১টা, প্রস্তুত রাখা হলো থম্পসনকে। থম্পসনের ব্লাড সুগার তখন ৫.২ মিলিগ্রাম/সিসি (বর্তমান প্রচলিত এককে ৫২০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার)। থম্পসনের পেটে দেওয়া হলো ১৫ সিসি ‘কলিপের সেরাম’। বেলা ৪টে নাগাদ মাপা হলো থম্পসনের ব্লাড সুগার। ফল দাঁড়ালো ৩.৮৫ মিলিগ্রাম/সিসি (বর্তমান এককে, ৩৮৫ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার)। কমেছে, উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে থম্পসনের ব্লাড সুগার। এটাই প্রত্যাশা করছিলেন সবাই। প্রত্যাশা পূরণের জন্য খুশি, ভীষণ খুশি সবাই। সন্ধ্যা ৬টায় আরও ১০ সিসি ইঞ্জেকশন দেওয়া হলো থম্পসনকে। রাত ১১টার সময় ফের মাপা হলো থম্পসনের ব্লাড সুগার। এবার ফল দাঁড়ালো ৩ মিলিগ্রাম/সিসি (৩০০ মিলিগ্রাম/ডেসি লিটার)। রাত ১১টায় থম্পসনকে দেওয়া হলো আরও ১০ সিসি ইঞ্জেকশন।
পরদিন থেকেই অনেকটাই সুস্থ বোধ করতে থাকেন থম্পসন[৩১]। কমতে থাকে তাঁর ব্লাড সুগারের পরিমাণ। মূত্রে সুগারের পরিমাণ ৭১ গ্রাম থেকে কমে দাঁড়াল ৯ গ্রামে। থম্পসনের শারীরিক অবস্থার উন্নতিতে উদ্বেল হয়ে উঠলো গোটা টরন্টো টিম। এটাই ছিল মানুষের উপর সফল ইনসুলিন প্রয়োগের প্রথম ঘটনা। এই ঘটনার মধ্যে দিয়েই জয়ী হলো দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ডায়াবিটিসের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম। মানব সভ্যতা প্রবেশ করলো এক নতুন যুগে- ইনসুলিন যুগ।
(চলবে)
[৩১] ২রা ডিসেম্বর ১৯২১, টরন্টো হাসপাতালে ভর্তি হন লিওনার্ড থম্পসন (১৯০৮-১৯৩৫)। ২৩শে জানুয়ারি ১৯২২, ৩ বার ইনসুলিন দেওয়া হয়েছিল থম্পসনকে। ২৪ তারিখ তাঁকে ২ বার ইনসুলিন দেওয়া হয়। ২৫ ও ২৬ তারিখে কোনও ইঞ্জেকশন দেওয়া হয় নি থম্পসনকে। ২৭শে জনুয়ারি থেকে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রোজ ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। এরপর কিছুদিন ইঞ্জেকশন দেওয়া বন্ধ রেখে আবার ইঞ্জেকশন চালু করা হয়। এইভাবেই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া হয় থম্পসনের। এই ইনসুলিন ইঞ্জেকশন নিয়ে আরও ১৩ বছর বেঁচেছিলেন থম্পসন। শেষ পর্যন্ত ব্রঙ্কোনিমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০শে এপ্রিল ১৯৩৫ সালে মারা যান থম্পসন।