ডাক্তারের সাথে জনগণের সম্পর্ক বহু আলোচিত বিষয়। এই বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে নর্মান বেথুন বলেছিলেন যে, আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা হল ব্যক্তি পুঁজি ব্যবহার করে মুনাফা নির্ভর ব্যবসা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্কট তাই চিকিৎসা ব্যবসারও সঙ্কট ডেকে আনে। প্রাচুর্যের মধ্যে দারিদ্র যেমন ভয়ঙ্কর মারণ ব্যাধির মতো সমাজে ঘুন ধরিয়ে দেয়, তেমনি ডাক্তারের সংখ্যা বাড়লেও গরিবের কোন লাভ হয় না। একজন ডাক্তারের ব্যক্তি জীবন এই ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তিনি এই ব্যবস্থার নিয়ামক নন, বরং তিনি একদিকে যেমন এই ব্যবস্থার একটি ছোট ঘুঁটি তেমনি তার শিকারও বটে।
বেথুন বিশ্বাস করতেন যে, চিকিৎসক ইচ্ছা করলে সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারেন। অর্থবিত্ত ও সুনামের জীবনের চেয়ে শ্রেয়তর মানুষের পাশে থেকে তাদের জীবনে পরিবর্তন আনা। সেই পরিবর্তন মানুষের জীবনকে যেমন সুন্দর করে তোলে তেমনি চিকিৎসকের জীবনও ভরে ওঠে সফলতা, যশ ও মাধুর্যে। বেথুন তার বিশ্বাস কার্যে পরিণত করতে কানাডা থেকে স্পেন ও চীনে যাত্রা করেছেন। ডাঃ দ্বারকানাথ কোটনিশ, ডাঃ বিজয় কুমার বসু ও ডাঃ দেবেশ মুখার্জি তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো চিকিৎসকদের অগ্রগণ্য তাঁরা।
আজকে যখন পুঁজিবাদের সঙ্কট ঘনীভূত হয়ে উঠছে ও বৃহৎ পুঁজি তিমিঙ্গিলের মতো সবকিছু আত্মসাৎ করে চলেছে ও তার সাথে সাথে সমাজের ভিত নড়িয়ে দিয়ে মানুষে মানুষে বিভেদের প্রাচীর তৈরী করে চলেছে, তখন বেথুন ও কোটনিশের আদর্শ আরো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। একজন মানুষের জীবনের কানাকড়ি দাম নেই। কিন্তু, সেই মানুষ যখন নিজের ব্যক্তি স্বার্থ সামান্য হলেও ক্ষুন্ন করে সবার কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারে তখন জীবন সার্থক হয়ে ওঠে।
ফাদার ডামিয়েন, ঊইলফ্রেড গ্রীনফেল, কোটনিশ, বেথুনের মতো চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী, স্বামীজির মতো সর্বত্যাগী বা নেতাজীর মতো বিপ্লবী না হয়েও সমাজের কাজে আত্মনিয়োগ সম্ভব। ব্যক্তিগত চাহিদার উর্ধ্বে উঠে সবার চাহিদার সাথে নিজেকে একাত্ম করতে পারলেও অনেকটা কাজ হয়ে যায়। “আমি ডাক্তার, আমি ইঞ্জিনিয়ার, আমি কপোতের মতো উচ্চ বৃক্ষ চূড়ে বসে নীচে থাকা মানুষকে শান্তিবারি বর্ষণ করে চলবো আর পুওর ইন্ডিয়া, হাংরি ইন্ডিয়া আমার সেবাদাস হয়ে থাকবে” শুধু এই চিন্তা বিসর্জন দিতে পারলেও সমাজ অনেক পাল্টে যাবে। উচ্চকোটির স্বপ্নবিধুর, মায়াময় জীবনের হাতছানি থাকবে। অল্পবয়সের সে ধারণা বদলে যায় বৃহত্তর চেতনার রঙে। তার জন্য অনুশীলন করতে হয়, যেমন করে চিকিৎসা বিদ্যার অনুশীলন করতে হয়।
মনে হতেই পারে কেন রে বাবা এই সব ভূতের বেগার খাটবো! হাসব, খেলব, জীবনের রঙ-রস-গন্ধে মজে থাকবো, কি দরকার ভেবে পরের কথা। কার চুল এলোমেলো কিবা তাতে এলো গেলো, কার চোখে কত জল কেবা তা মাপে? এর উত্তর খোঁজার জন্য গালভরা, নামকরা জ্ঞানীগুণীর কেতাবে কি লেখা আছে না জানলেও চলবে। শুধু নিজের দিকে দুদণ্ড তাকালেই চলবে। মানুষ কেন বংশ বৃদ্ধি করে, কেন এক সূক্ষ্ম অবচেতন তাকে তার জীন ছড়িয়ে রাখতে প্ররোচিত করে? মানুষের অবচেতন ও চেতনার পরতে পরতে রয়েছে এক স্বার্থপর অভ্যাস। সে নিজের নাম অক্ষয়, অজর ও অমর করে রাখতে চায়। নিজের শারীরিক অক্ষমতা তাকে হাজার লক্ষ বছর না বাঁচতে দিলেও তার নিজের প্রতিরূপ পৃথিবীর প্রান্তে রেখে দিতে চায়, বস্তুত সে অমরত্ব চায়।
নিজের জীনের প্রতিরূপ ছাড়াও অমর হওয়া যায়। যেমন করে মহাপুরুষরা কীর্তির মাধ্যমে জীবিত আছেন সেভাবেও জীবিত থাকা যায়। শুধু দেখার দৃষ্টিভঙ্গি একটু পাল্টাতে হবে। আলোর গভীরে সাতটা রঙ খেলা করছে, শুধু নিজের রঙটি খুঁজে নিতে হবে।