সময়টা ১৯২০ সালের মাঝামাঝি হবে, বান্টিঙ তখন লন্ডন শহরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেছেন সবে। পসার বেশ মন্দা যাচ্ছে তাঁর। দুশ্চিন্তা আর অবসাদে দিন কাটছে তখন বান্টিঙের। এমনই এক দিনে, তাঁর এক বন্ধু তাঁকে বললেন, মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার সেরা উপায় হলো ছবি আঁকা। মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তির প্রশ্নে ছবি আঁকার জুড়ি মেলা ভার বলেই মনে করেন তিনি। সবার অজান্তে কথাটা যেন অন্তরের অন্তস্তলে গিয়ে বেঁধে বান্টিঙের। একদিন, শহরের এক বড় বিপণিতে, একটা পেইন্টিং দেখে মুদ্ধ হয়ে যান বান্টিঙ। ছবিটা কিনেই ফেললেন তিনি। এই ছবিটা কেনার পরই বান্টিঙের মনেও ছবি আঁকার বাসনা জেগে ওঠে। কস্মিনকালেও কারও কাছে আঁকা শেখেন নি বান্টিঙ, কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে মাঝে মাঝেই আঁক কাটতে শুরু করেন তিনি। লন্ড্রি থেকে একটা কার্ডবোর্ডের বাক্সে মুড়ে পাঠানো হয়েছিল একটা কাচা শার্ট। সেই বোর্ডের পিছনে শুরু করলেন আঁক কাটা। এটাই ছিল বান্টিঙের প্রথম উল্লেখযোগ্য আঁকা। এরপর প্রায়ই আঁক কাটতে দেখা যেত বান্টিঙকে। লন্ডনের দিনগুলোতে সময় পেলেই কিছু না কিছু আঁকতেন তিনি। পেনসিল স্কেচ ছেড়ে ধীরে ধীরে জলরঙের ব্যবহারও শুরু করলেন বান্টিঙ।
ইনসুলিন নিয়ে গবেষণার চাপে আঁকা নিয়ে তেমন আর কিছু করে উঠতে পারেন নি বান্টিঙ। নোবেল পুরস্কার জেতার পর, ১৯২৫ সালের এপ্রিল মাসে ‘আর্ট অ্যান্ড লেটারস্ ক্লাব অব টরন্টো’র সদস্য হন বান্টিঙ। ইতিপূর্বে ১৯২১ সালে থেকেই এই ক্লাবের সদস্য ম্যাক্লাউডও। শহরের বিশিষ্ট গায়ক, কবি, চিত্রশিল্পী প্রভৃতি কলাপ্রেমীদের আনাগোনা লেগেই থাকতো এই ক্লাবে। বান্টিঙও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন এই ক্লাবের সদস্যদের সাথে। বেশ কিছুকাল ক্লাবের এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্যও ছিলেন তিনি। এই ক্লাবেই তাঁর সাথে আলাপ হয় কানাডিয় চিত্রশিল্পী জ্যাকসনের[৫১] সাথে। জ্যাকসনের আঁকা একটা যুদ্ধের ছবি দেখে মুগ্ধ হন বান্টিঙ। জ্যাকসনের আঁকা সেই ছবিটা কিনে নেন তিনি (বলা প্রয়োজন, ম্যাক্লাউডও ছিলেন জ্যাকসনের শিল্পকর্মের গুণগ্রাহী এবং পৃষ্ঠপোষক)। সেই শুরু, তারপর থেকেই এক প্রগাঢ় বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয় বান্টিঙ এবং জ্যাকসনের মধ্যে। জ্যাকসন আবার ‘গ্রুপ অব সেভেন’ নামে আরেকটা দলের সদস্য ছিলেন। এই ‘গ্রুপ’টা শুধুমাত্র চিত্রশিল্পীদের গ্রুপ। জ্যাকসনের হাত ধরে গ্রুপ অব সেভেনেও যাতায়াত বাড়ল বান্টিঙের। তাঁদের সংসর্গ ভালো লাগতো বান্টিঙের। এই সমস্ত শিল্পীদের সংস্পর্শেই বান্টিঙের মনে জেগে উঠল আঁকার সেই পুরানো নেশাটা। দেখতে দেখতে বান্টিঙও রঙতুলি তুলে নিলেন হাতে। এঁকে চললেন প্রাকৃতিক দৃশ্য। বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণার বাইরে বাঁধনহীন এই জীবন দারুণ ভাবে আকর্ষণ করলো বান্টিঙকে। প্রকৃতির কোলে শিল্পীদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে ভালো লাগতো তাঁর। যেখানে খুশি যাও, যতক্ষণ খুশি থাকো, প্রাণ ভরে দেখো জগতের বাহার। নেই কোনও পিছু টান, নেই কোন ভাবনা। শুধু সময়ের স্রোতে ভেসে যাওয়া, শুধু প্রকৃতিকে ক্যানভাসে রাঙিয়ে তোলা। ক্রমেই আঁকার নেশায় নিমজ্জিত হলেন বান্টিঙ।
১৯২৭ সালে আঁকা বান্টিঙের ছবি। |
মার্চ ১৯২৭, জ্যাকসন জানালেন, প্রকৃতির ছবি আঁকতে কুইবেক প্রদেশে যাবেন তিনি। বান্টিঙ চাইলে যেতে পারেন তাঁর সাথে। ‘যেতে পারেন’ মানে? ‘যেতে পারেন’ আবার কি কথা? যাবেন, যাবেন বান্টিঙ, নিশ্চয় যাবেন জ্যাকসনের সাথে কুইবেকে। শিল্পীর সাথে প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানোর সুযোগ হাতছাড়া করবেন না তিনি। মার্চ মাসেই জ্যাকসনের সাথে বেড়িয়ে পড়লেন বান্টিঙ, গন্তব্য- সেন্ট লরেন্স নদীর মোহনার নিকটবর্তী সেন্ট জঁ পোর্ট জলি। কুইবেক শহর থেকে সেন্ট লরেন্স নদী পথ ধরে শুরু হলো যাত্রা। এই অঞ্চলের তাপমাত্রা তখন শূন্য ডিগ্রীর নীচে। সমস্ত প্রান্তর বরফাচ্ছাদিত তখন। শহুরে জীবনের বাইরে, এ এক ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা। তবে, এতটা ঠান্ডার সম্মুখীন হতে হবে তা বোধহয় অনুমান করতে পারেন নি বান্টিঙ। প্রচন্ড ঠান্ডায় তখন প্রায় ঠক্ঠক্ করে কাঁপছেন তিনি। পরে জ্যাকসন লিখেছেন, ঠান্ডায় কাবু বান্টিঙ তাঁকে বলেছিলেন, “আমি ভেবেছিলাম এটা [শীতকালে কুইবেক ভ্রমণ] মেয়েলি ব্যাপার”।
সেই প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে, যাত্রাপথের বরফাচ্ছাদিত নিসর্গের ছবি এঁকে চললেন বান্টিঙ এবং জ্যাকসন। বিজ্ঞান গবেষণা ছেড়ে আঁকার প্রতি বান্টিঙের এই ঝোঁক দেখে ঠাট্টা করে জ্যাকসন বললেন, “আরে মশাই আপনি তো দেখছি বিজ্ঞান ছেড়ে একেবারে কলার প্রেমে পড়ে গেলেন”। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বান্টিঙ বললেন, “[এখন] আমার পঞ্চাশ বছর বয়স হলে আমি শুধু এই কাজটাই করতাম”।
গ্রুপ অব সেভেনের শিল্পীরা শুধুমাত্র পেশাদার শিল্পীই ছিলেন না, আঁকার নেশা ছিল তাঁদের মজ্জায় মজ্জায়। যখনই সময় পান, এদিক ওদিক গিয়ে ছবি আঁকতে বসে পড়েন তাঁরা। তাছাড়া বছরে দু’তিনটে লম্বা ট্রিপ তো বাঁধাই থাকতো তাঁদের। এই মার্চ মাসে কুইবেক থেকে ঘুরে এসে ফের কুইবেক যাত্রার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন জ্যাকসন। এবার বেশ বড় জাহাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। খবর শুনে পিছু নিলেন বান্টিঙও। জ্যাকসনের থেকে আঁকার নেশা এখন যে কিছুমাত্র কম নয় বান্টিঙের। ১৬ই জুলাই ১৯২৭, ‘এসএস বিয়োথিক’[৫২] জাহাজের সওয়ারি হলেন জ্যাকসন আর বান্টিঙ। আবারও সেন্ট লরেন্স নদীর উপর দিয়ে ছবি আঁকতে আঁকতে চললেন জ্যাকসন এবং বান্টিঙ। এখন গরমের সময়। এই গ্রীষ্মকালে আরেক ভিন্নরূপে তাঁদের কাছে ধরা দিয়েছে কুইবেক। প্রকৃতির সেই রূপে বিভোর বান্টিঙ একান্তে রাঙিয়ে চললেন তাঁর ক্যানভাস।
জ্যাকসন (বামে) ও বান্টিঙ। বিয়োথিক জাহাজের ডেকে। |
কর্মসূত্রে উত্তর কানাডার দুর্গম স্থানে প্রায়ই যেতে হতো জ্যাকসনের বিশিষ্ট বন্ধু ভূবিজ্ঞানী জেমস এবট ম্যাকিন্টস বেলকে। জ্যাকসন যে দুর্গম অঞ্চলের নিসর্গ আঁকতে পছন্দ করতেন তা বিলক্ষণ জানা ছিল বেলের। জ্যাকসনের সঙ্গী, ডা. ফ্রেডরিক বান্টিঙের আঁকার উৎসাহের খবরও রাখতেন তিনি। জুন ১৯২৮, এবার বেলের গন্তব্য উত্তর কানাডার গ্রেট স্লেভ লেকের পূর্ব পাড়ের ফোর্ট রেসলিউশান। বেশ দুর্গম স্থান ফোর্ট রেসলিউশান। সেই যাত্রায় তাঁর আতিথ্য গ্রহণের জন্য জ্যাকসন আর বান্টিঙকে বার্তা পাঠালেন বেল। জ্যাকসনের সাথে সমান উৎসাহে বেলের সফর সঙ্গী হলেন বান্টিঙও। সে এক রোমাঞ্চকর যাত্রাপথ। জুন মাসের শেষের দিকে, রেলপথে এলবের্টা প্রদেশের ফোর্ট ম্যাকমুরে পর্যন্ত এলেন যাত্রীরা। এরপর পুরোটাই জলপথে যাত্রা, প্রথমে এথাবস্কা নদী, পরে স্লেভ নদী পথ ধরে প্রায় ১৫০০ কিমি জলপথ পেড়িয়ে, ৯ই জুলাই, গ্রেট স্লেভ লেকের পাড়ে ফোর্ট রেসলিউশান পৌঁছন অভিযাত্রীরা। শহুরে জীবনের বাইরে ভিন্ন এক জগতের আরাধনায় মগ্ন তখন বান্টিঙ। ফোর্ট রেসলিউশান পৌঁছনোর ক’দিন পর, সেখান থেকে আরও উত্তরের পথ ধরলেন জ্যাকসন এবং বান্টিঙ। এবার গন্তব্য ইয়েলোনাইফ শহরের উত্তরে অবস্থিত লেক প্রসপরাস। এই সমস্ত দুর্গম অঞ্চলে থাকাকালীন অনেকগুলো ছবি আঁকেন বান্টিঙ এবং জ্যাকসন। এই পর্যায়ে তাঁদের আঁকা অনেকগুলো ছবি এখনও সংরক্ষিত আছে মিউজিয়মে। পরবর্তীকালে, তাঁদের এই রোমাঞ্চকর যাত্রার সম্মানে, প্রসপরাস লেকের সন্নিহিত দুটো লেকের নাম রাখা হয় বান্টিঙ লেক এবং জ্যাকসন লেক।
প্রসপরাস লেকে যাত্রার পথে দুটো ভিন্ন ধরণের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন বান্টিঙ। তাঁর প্রথম অভিজ্ঞতা হলো পশু চামড়া বা ফার সংক্রান্ত। তিনি লক্ষ্য করেন, এস্কিমোদের কাছ থেকে নামমাত্র অর্থে বিপুল পরিমাণ চামড়া কিনে কিভাবে বিরাট অঙ্কের মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা। প্রসপরাস লেক থেকে ফেরার পথে মন্ট্রিয়লে এসে, গল্পছলে নিজের এই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ছিলেন টরন্টো স্টার পত্রিকার সাংবাদিক গ্রিনওয়েকে। নতুন সূত্র পেয়ে, বিষয়টাকে খবর হিসেবে টরন্টো স্টারে ছাপিয়ে দেন গ্রিনওয়ে। তাতে বান্টিঙের নামও উল্লেখ করেন তিনি। সংবাদটা প্রকাশিত হবার পরই বিষয়টা নিয়ে শোরগোল পড়ে যায় আমেরিকা, ইওরোপ, অস্ট্রেলিয়ায়। বিশেষত, বান্টিঙ যখন এমন অভিযোগ করেছেন তখন জনমানসে তাঁর গুরুত্ব অনেকটাই বেড়ে গেছে। এই সমস্ত ব্যবসায়ীদের ঘিরে প্রশ্ন, সমালোচনা, নিন্দার আবহ গড়ে ওঠে কানাডা জুড়ে। রাজ্য সরকারের তরফে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু হয়। ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তলব পড়ে বান্টিঙের। বান্টিঙ জানান, ব্যক্তিগত মতামত হিসেবে তিনি এটা সাংবাদিককে জানিয়ে ছিলেন। ঘটনার সত্যতা তলিয়ে যাচাই করেন নি তিনি। বলা বাহুল্য, এই সমস্ত কর্মকান্ডের জন্য সাংবাদিক গ্রিনওয়ের উপর মহাখাপ্পা বান্টিঙ। বান্টিঙের বক্তব্য, অভিজ্ঞতার দু’টো কথা গল্প ছলে বলেছি তোমায়। তাই বলে খবর বানিয়ে চাউর করতে হবে তাকে!
প্রসপরাস লেকে যাত্রার পথে বান্টিঙের দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল ফ্লু বিষয়ক। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন বাইরে থেকে আসা ব্যবসায়ীরা গ্রাম থেকে গ্রামে যাওয়ার পথে আদিবাসীদের মধ্যে কিভাবে ফ্লু ভাইরাস ছড়াচ্ছেন। বান্টিঙের এই অভিজ্ঞতা সরকারি দপ্তরের নজরে এসেছিল এবং তাঁরা গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে থাকেন ঘটনাটাকে।
টরন্টো পরিমন্ডলে চিত্রশিল্পী হিসেবে ক্রমেই পরিচিত হয়ে উঠেছেন বান্টিঙ। বান্টিঙ তখন কানাডার নামকরা অপেশাদার চিত্রশিল্পীদের একজন। তাঁরা আঁকা বহু চিত্রই সমালোচকদের প্রশংসা আদায় করে নিয়েছে। আঁকায় তাঁর এই উৎসাহের পিছনে জ্যাকসনের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। দীর্ঘকাল ধরে আঁকার জগতে বান্টিঙ-জ্যাকসন যুগলবন্দী অটুট ছিল। সময় পেলেই, গড়ে বছরে একবার জ্যাকসন-বান্টিঙ সফর ছিল নিয়মে বাঁধা। সেই নিয়ম মেনেই, ১৯৩০ সালে জ্যাকসনের সাথে আবার বেরিয়ে পড়লেন বান্টিঙ। এবার সেন্ট লরেন্স নদী বেয়ে মোহনার কাছে সেন্ট ফিডেলে গ্রামে এলেন তাঁরা। এই যাত্রা প্রসঙ্গে জ্যাকসন পরে বলেছেন, ছবি আঁকার পর অবধারিত ভাবে বান্টিঙ তাঁকে জিজ্ঞাসা করতেন, “এটাতে কি ভুল আছে?”
১৯৩৭ সালে ফের জ্যাকসনের সাথে সেন্ট লরেন্স নদীর মোহনার কাছে সেন্ট টেট গ্রামে যান বান্টিঙ। এই পর্যায়ে যে কটা ছবি আঁকেন বান্টিঙ, তার মধ্যে ‘সেন্ট-টেট-ডেস-ক্যাপ’ শীর্ষক ছবিটা উল্লেখযোগ্য। আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়ে, বান্টিঙের আঁকা এই ছবিটা গত শতকের নয়ের দশকে নিলাম করেন বান্টিঙ রিসার্চ ফাউন্ডেশন। ৩০,০০০ কানাডিয়ন ডলারে বিক্রি হয় বান্টিঙের আঁকা এই ছবিটা।
বান্টিঙের আঁকা ‘সেন্ট-টেট-ডেস-ক্যাপ’। |
এরপরও জ্যাকসনের সাথে দক্ষিণ কানাডার জর্জিয়ান বে থেকে ফ্রেঞ্চ নদীপথ ধরে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে ভ্রমন করেন বান্টিঙ। এখানেও তাঁরা প্রকৃতির বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি আঁকতে থাকেন। পেশাদার শিল্পী না হয়েও আঁকার প্রতি বান্টিঙের এই আগ্রহ সবাইকে বিস্মিত করে। ইনসুলিন গবেষণার জন্য যেখানে তিনি ২-৩ বছর সময় অতিবাহিত করেছিলেন, আঁকার জন্য সেখানে দীর্ঘ ১০-১২ বছর সময় ব্যয় করেছেন বান্টিঙ। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, একজন বিজ্ঞানী হয়ে আঁকার জন্য এতটা সময় কেন ব্যয় করলেন তিনি? যেখানে তাঁর জীবদ্দশায়, তাঁর আঁকা একটাই ছবি বিক্রি হয়েছিল মাত্র ১৩.৭৭ কানাডিয়ন ডলারে।
বান্টিঙকে যাঁরা গভীর থেকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন তাঁদের মতে, বান্টিঙ বরাবরই মুখচোরা শান্ত গ্রাম্য মানুষই ছিলেন। শহরের এই জাঁক জমক, খ্যাতি, হল্লা, মানসিক ভাবে বিব্রতই করতো তাঁকে। এই শহুরে জীবন একটা দম বন্ধ করা পরিবেশ বলেই প্রতীয়মান হতো তাঁর কাছে। এই পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতেই নির্দ্ধিধায় তিনি ছুটে যেতেন দুর্গম কোনও অঞ্চলে। আর সেই সূত্রেই তিনি পরিচিত হয়েছেন কানাডার প্রকৃতি, কানাডার মানুষদের সাথে। যে ভাবে তিনি উপলব্ধি করেছেন কানাডাকে, কানাডার মানুষকে, কানাডার প্রকৃতিকে, এক কথায় তা অনন্য। একজন বিজ্ঞানী হয়ে দেশ ও মানুষের সাথে যে ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি, তা সত্যিই অতুলনীয়। তাই তিনি পারেন দেশের মানুষের স্বার্থে, মাত্র ১ ডলার দিয়ে কয়েক লক্ষ ডলারের ইনসুলিন সত্ত্ব বিক্রি করতে।
(চলবে)
[৫১] অত্যন্ত দুঃস্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আলেকজান্দার ইয়ং জ্যাকসন (১৮৮২-১৯৭৪)। আর্থিক অনটনের জেরে পরিবারকে ফেলে রেখে চলে যান জ্যাকসনের বাবা। পাঁচ ভাই বোনকে সামলাতে, মাত্র ১২ বছর বয়স থেকে ছাপাখানায় কাজ শুরু করেন জ্যাকসন। আঁকার প্রতি একটা জন্মগত ঝোঁক ছিল তাঁর। সেই ঝোঁকেই, ১৯০৫ সালে দারিদ্র মাথায় নিয়ে ইওরোপে যান আঁকা শিখতে। প্যারিসে ‘একাদেমি জুলিয়ন’-এ আঁকা শেখেন তিনি। ১৯১২ সালে কানাডা প্রত্যাবর্তন করেন জ্যাকসন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, কানাডিয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। জুন ১৯১৬, বান্টিঙের মতোই, ‘সেনচুয়ারি উড’ যুদ্ধে আহত হন তিনিও। সেনাবাহিনীর তরফে এরপর আর সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয় নি তাঁকে। যুদ্ধক্ষেত্রের বিভিন্ন মহূর্তের ছবি, তথ্যচিত্র হিসেবে ধরে রাখার দ্বায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। যুদ্ধ থেকে ফিরে পেশাগত শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন জ্যাকসন।
[৫২] ১৯১৮ সালে ইউএসএর ওহিও প্রদেশের লোরেইন শহরে নির্মিত হয় এসএস বিয়োথিক (এসএস কথাটার অর্থ ‘স্টিম শিপ’)। ১৯২৭ সাল থেকে উত্তর কানাডার আর্টিক অঞ্চলের সাথে যোগাযোগের জন্য ‘রয়েল কানাডা মাউন্টেন্ড পুলিশ’ ভাড়া করে বিয়োথিককে। এই বছরই বান্টিঙ ও জ্যাকসন এই জাহাজের সওয়ারি হন। যাত্রাকালীন বিনা পারিশ্রমিকে মাউন্টেন্ড পুলিশের চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বান্টিঙ। ৮ই ডিসেম্বর ১৯৪০, নিউফাউনল্যান্ডের গ্রেট বৃহট অঞ্চলে বিয়োথিককে শেষ বার দেখা গেছিল। তারপর থেকে বিয়োথিকের আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায় নি।