সরকারী আর আধাসরকারী কর্মক্ষেত্রে নিয়মগুলো মোটামুটি এক। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বদলি হলে কয়েকদিনের ছুটি পাওয়া যায়। ফলে রাম্মাম থেকে জলঢাকা বদলি হতে বেশ কদিন ছুটি পাওয়া গেলো। একটা অবিবাহিত বাচ্চা ছেলে, সম্পত্তি বলতে গাদাগুচ্ছের ডাক্তারি বই আছে। এরমধ্যে যে এডিশনগুলো দাগানো, সেগুলো যকেরধনের মতো আগলে রাখে সে। তার আর ট্রান্সফার অর্ডার পেয়ে গোছানোর কি আছে? পড়ে পাওয়া ছুটিতে টুক করে কলকাতা ফেরা আর আরো কিছু বই কেনা। ট্রান্সফার হয়ে নতুন জায়গায় যাওয়ার সময় লোকে বেডিং, বাক্স, প্যাঁটরা নিয়ে যায়, আর ক্যাবলাকান্ত ছেলেটি প্রচুর বই নিয়ে শিলিগুড়ি স্টেশনে হাজির।
স্টেশনের পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে তার নাম ধরে ঘোষণা চলছে “কলকাতা থেকে আগত অমুক বাবু আপনার জন্য আপনার ড্রাইভার এত নম্বর গাড়ির সামনে অপেক্ষা করছে।” নিজেকে বেশ ভিআইপি লাগছিল তার।
দুখানা বইয়ের বস্তা কাঁধে বাচ্চা একটা ছেলেকে এগিয়ে আসতে দেখে ড্রাইভার প্রথমে মোটেই পাত্তা দেয়নি। আড়চোখে একটু মেপে নিয়ে প্রশ্ন “যাওয়া হবে কোথায়?” জলঢাকা শুনে একটু নড়েচড়ে বসে। “বেড়াতে?”
“ওই আর কি..” ছেলেমানুষি না যাওয়া ডাক্তারের জবাব।
“তাহলে পেছনে চেপে বসুন। এমনিতে ভাড়া এতো টাকা, আপনার কাছ থেকে অর্ধেক নেবো। সাহেব যদি জিজ্ঞেস করে বলবেন যে আমার বৌ সম্পর্কে আপনার দিদি হয়।”
তাকে তো আর বলা যায়না যে রঙটা একটু মাজা হলেও আমিই তার সাহেব। পেছনে চেপে বসি। তার সাহেব আসেনি দেখে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে দেয়। আর আগে আসবে জানিয়েও আসেনি বলে তার ডাক্তারসাহেবের উদ্দেশ্যে যেসব চোখাচোখা বিশেষ্য বিশেষণ উচ্চারিত হচ্ছিল সেসব শুনতে শুনতে শিহরিত হয়ে উঠছিলাম। আচার্য সুনীতিকুমার শুনতে পেলে ভাষার ওপর আরো একখানা মোটা বই লিখতে পারতেন। আমার উর্ধতন চোদ্দপুরুষ আরো একবার শ্রাদ্ধের স্বাদ গ্রহণ করলেন। মোটকথা, সেইসব অমৃতবাণী শোনার পর নিজের পরিচয় দিতে বেশ ভয় করছিল। “ঘুরতে আসা শালা” অনেক সম্মানজনক পরিচয়।
কিছুক্ষণ পরে ড্রাইভারসাহেবের হুকুম “সামনে এসে বসুন।” শিলিগুড়ির মূল শহরে ঢুকে আরো এক কঠিন অভিজ্ঞতা। যাকে পাচ্ছে তাকেই গাড়িতে তুলে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে ছোট্ট গাড়ি অফিস টাইমের বনগাঁ লোকাল। তারমধ্যে টিপটিপ বৃষ্টি। মালবাজার পেরিয়ে খুনিয়ামোড় থেকে বাঁদিকে একটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ। মালবাজার পেরনোর পর আরো দুজন লোক গাড়িতে উঠলো। এরপর ড্রাইভারসাহেবের হুকুম আপনার হাতের দুটো বস্তা গাড়ির মাথায় তুলে দিন। সর্বনাশের মাথায় পা! বই ভর্তি বস্তা দুটো যদি ভিজে যায় তো কেলেংকারী। সাধের দাগানো অংশ ধেবড়ে গেলে সব শেষ। আঁতকে উঠি আমি – বস্তা দুটো ভেতরে থাক, আমি গাড়ির মাথায় উঠতে রাজি আছি। আমি এবং আমার বইপত্র সে যাত্রায় রক্ষা পেলো এক অদ্ভুত ঘটনায়।
সেই ঘটনায় যাওয়ার আগে যেসব পাঠক পাঠিকারা ডাক্তার নন তাদের একটা করুণ তথ্য জানিয়ে রাখি। অনেক প্রফেশনেই সারা জীবন পড়তে হয়। তার মধ্যে একটি হ’ল ডাক্তারি। প্রতিদিন নতুন কিছু ওষুধ বেরোচ্ছে, রোগভোগও নিজের ইচ্ছে মতো ভোল পাল্টাচ্ছে। একেকটা রোগ যেন একেকটা রাজনৈতিক নেতা। আজ এই রঙ তো কাল অন্য। আজ যে ওষুধটা কোনো রোগের জন্য অব্যর্থ তো কাল সেটা লিখলে অন্য ডাক্তাররা নাক কুঁচকে বলে উঠবেন – “উঁহু, ছেলেটা একদম পড়াশোনা করে নাগো।” ফলে এক সংবাদ পত্রের ট্যাগ লাইনের মতো ডাক্তারবাবুরাও বলেন – “পড়তে হয়, নয়তো পিছিয়ে পড়তে হয়।” এরপর পড়তে পড়তে ডক্টরস’ ডায়েরির এই ডাক্তার পরের বছর আবার পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন এন্ট্রান্স পরীক্ষায় দূরবীন দিয়ে দেখার মতো একটা র্যাঙ্ক করবে। ডিপ্লোমা করতে অনিচ্ছুক ছেলেটি তার পরের দু’বছর তো কোনো র্যাঙ্কই করতে পারবেনা। তার পরের বছর রাতে মাত্র তিন-চার ঘন্টা ঘুমিয়ে একটা ভদ্রস্থ র্যাঙ্ক করে সার্জারি পড়তে কলকাতা আসবে।
সে-তো পরের কথা। আপাতত আমি আমার ড্রাইভারের পাশে বুকে দুটো বইয়ের বস্তা জড়িয়ে বসে আছি। হঠাৎ ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে গাড়িটি দাঁড়িয়ে যায়। সামনে কালো পাহাড়ের মতো কি একটা দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার তুরন্ত হেডলাইট অফ করে ভয়ার্ত গলায় বলে “দলছুট হাতি পাগলা হয়। সবাই চুপ করে বসে থাকবে।” আধঘন্টার মতো পথ অবরোধ করার পর তিনি তাঁর বিশাল শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আস্তে আস্তে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলেন। একেই বোধহয় গজেন্দ্র গমন বলে। আমাদের গাড়িটাও একইরকম ধীরগতিতে চলতে লাগলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি আমাদের পেছনেও অসংখ্য গাড়ি তাদের হেডলাইট নিভিয়ে একই গতিতে আসছে। কিছুক্ষণ বাদে হাতিটা বাঁদিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল।মনে মনে বললাম ‘বামপন্থী হাতি’ । সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
তারপর জলঢাকায় ঢুকে নিজের পরিচয় দেওয়ার পরে আরো এক নাটক। সে নাহয় পরে বলা যাবে। আপাতত এটুকুই থাক।
দারুণ দারুণ ডাক্তার বাবু । চালিয়ে যান। আপনার লেখার সাথেই আমি মালবাজার পৌঁছে গেলাম। ভালো থাকবেন।
ধন্যবাদ, আমরা একসাথে ঘুরবো। ☺
Khub misti aar sundor kore likhechis Anirban. Aaro onek likhe amader mon bhoriye de. Wish u all the best for always.
???
সুন্দর শুরু……বাকিটার অপেক্ষায় রইলাম
ধারাবাহিক ভাবে চলবে। ?
দারুন স্যার..???
পরের গল্পের অপেক্ষায় রইলাম আপনার পরিচয় জানার পর ড্রাইভার সাহেব যে কি করলেন, সেটা জানার ইচ্ছা রইলো..?
হা হা, সে এক মজার গল্প । বলবো, অবশ্যই।
অপেক্ষায় থাকলাম
ধন্যবাদ ???
Baaah….tor bhromon pather songi holm..
হুমম দিদি, তোমাদের তো জানা গল্প। ?
মিষ্টি মানুষের মিষ্টি লেখা। খুউব ভালো।
ধন্যবাদ শিশির ???
Lovely reading time………. Enjoyed a lot ??❤❤
Thanks, Amlan.❤
ভ্রমণের শুরু টা বেশ লাগলো……স্যার বাকিটার অপেক্ষা রইলাম….।
রাম্মাম থেকে শুরু করেছিলাম। আগের সংখ্যায় ( সংখ্যাই বলবো তো?) শুরুর অভিজ্ঞতা ছিল। পারলে পড়বেন প্লিজ।
It was really engaging ?
Thanks, Agnidhra.
Anirban da(senior dadai hobe,ami 2002 medical clg) darun likhecho..Poroborti porber jnyo ha pityesh kore bose roilam….
হ্যাঁ, জয়দীপ। কোন কলেজ? ?
খুব খুব ভালো হয়েছে লেখাটা ,আপনার জীবনের ঘটনা পড়তে খুব ভালো লাগে, মজা করে যেসব কথা বলেন সেগুলোও খুব ভালো লাগে পড়তে,আরও ঘটনা জানার অপেক্ষায় থাকলাম ।
ধন্যবাদ, স্বাতী। ☺
?
ডাক্তারভাই, খুব সুন্দর বর্ণনা। অপেক্ষা পরের পর্বের জন্য
thanks. Soutam.
ধন্যবাদ, দাদা। ☺
Darun lekha. Paroborti tar jonno opekhay roilam Sir.
thanks. Soutam.
অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি গল্পের পরের sequel র জন্য।
পনের দিন পরেই লেখাটা দেবো। ?
এতো বনের পথে কুড়িয়ে পাওয়া বনফুল । আর্নেস্টলি বলি হেমিংওয়ের মতো লেখনী ।
ধন্যবাদ ?
পরের লেখাটা তাড়াতাড়ি লিখুন, তর আর সইছে না যে
❤❤❤
Sesh tuku bolbe toh.ato suspence cheep rakha jai?
??অসাধারণ লাগল পড়তে Sir