ডাক্তারের কথা ভাবলেই যে দুটি যন্ত্রের কথা মনের মধ্যে ভেসে ওঠে তা হ’ল স্টেথোস্কোপ এবং স্ফিগমোম্যানোমিটার। ‘স্ফিগমোম্যানোমিটার’ নাম-টা একটু খটোমটো লাগছে নিশ্চয়ই। রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেশার (সংক্ষেপে বিপি) মাপার যন্ত্র বললে ব্যাপারটা সহজ হবে। একটা হাওয়া ভর্তি রাবারের ফাঁপা-বল ‘ফুস, ফুস’ করে চেপে ডাক্তার প্রেশার মাপছেন, এটা খুব পরিচিত দৃশ্য। আগে শুধু পারদ-যন্ত্র পাওয়া যেত। পরে ঘড়ির ডায়ালের মতো অ্যানেরয়েড এবং স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বাজারে এসেছে। অন্যান্য আর পাঁচটা বিষয়ের মতোই বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে বহুদিন ঘষা খেয়ে খেয়ে স্ফিগমোম্যানোমিটার আজকের রূপ পেয়েছে।
প্রাচীন ভারতীয় এবং চৈনিক চিকিৎসকরা শরীরে রক্ত সঞ্চালনের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিলেন। নাড়ি টিপে চিকিৎসা সুপ্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত ছিল। যদিও তার প্রথম বিজ্ঞানসম্মত ধারণা দেন উইলিয়াম হার্ভে। সময়টা ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধ। ১৬২৮ সালে তাঁর প্রকাশিত বইতে তিনি হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত সঞ্চালনের ব্যাখ্যা দেন। তাঁর বইকে আধুনিক চিকিৎসা-বিদ্যার অন্যতম মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়।
রক্ত সঞ্চালন বোঝার সাথে সাথে এটাও বোঝা গেল রক্তবাহের মধ্যে রক্ত নির্দিষ্ট চাপে সঞ্চালিত হয়। তবে সেটা মাপার উপায় জানা ছিল না। সমস্যার সমাধান করলেন বিজ্ঞানী রেভারেন্ড স্টিফেন হেলস্। খুব সম্ভবত ১৭১০ সালের ডিসেম্বর মাসে ১৪ বছরের একটি সুস্থ স্বাভাবিক ঘোড়ার পেটের কাছে তিন ইঞ্চি কেটে কুঁচকির মোটা ধমনীতে তিনি ৯ ফুট লম্বা কাচের নল ঢুকিয়ে দিলেন। সাথে সাথে প্রায় ৮ ফুট ৩ ইঞ্চি রক্তস্তম্ভ তৈরি হ’ল। তবে সেটি স্থির ছিল না। হৃৎস্পন্দনের সাথে রক্তস্তম্ভ ২-৪ ফুট ওঠানামা করছিল। পরে ১৮৪৭ সালে কার্ল লুডউইগ কাইমোগ্রাফ যন্ত্রে আবিষ্কারের মাধ্যমে হৃৎস্পন্দনের সাথে রক্তচাপ বাড়া-কমার বিষয়টি গ্রাফের সাহায্যে নথিবদ্ধ করেন। রক্তচাপ বাড়া-কমার সাথে সাথে পারদস্তম্ভ ওঠানামা করছিল এবং পারদস্তম্ভের সাথে লাগানো একটি পেন্সিল ঘুর্নায়মান ড্রামে লাগানো গ্রাফ-কাগজে রক্তচাপ বাড়া-কমার একটি ছবি তৈরি করছিল। যদিও এভাবে রক্তচাপ মাপতে গেলে রক্তবাহ ফুটো করতে হ’ত। বলাই বাহুল্য, জীবিত মানুষের রক্তচাপ এভাবে মাপা অসম্ভব ছিল।
প্রথম শরীরের বাইরে থেকে রক্তচাপ মাপার যন্ত্র বানালেন যে বিজ্ঞানী তাঁর পুরো নাম শুনবেন? দুর্বল দাঁতের অধিকারী হ’লে ভুলেও চেষ্টা করবেন না। স্যামুয়েল সিগফ্রেড কার্ল রিটার ভন ব্যাশ। একটি রাবারের ফাঁপা টিউব জল দিয়ে ভর্তি করে হাতের ধমনীর ওপর চাপ প্রয়োগ করে যে চাপে ধমনীর রক্ত-সঞ্চালন বন্ধ হয় সেটাই রক্তচাপ।
ভন ব্যাশের পদ্ধতিতে সরাসরি ধমনীর ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হ’ত। ব্যবহারিক দিক দিয়ে এই পদ্ধতির স্বাচ্ছন্দ্য কম। আধুনিক পদ্ধতিতে বাহুর চারদিকে রাবারের কাফ জড়িয়ে রক্তচাপ মাপার যে পদ্ধতি তার আবিষ্কার ১৮৯৬ সালে সিপিওন রিভা রোসি-র হাত ধরে। প্রথমে কাফের মধ্যে জল ব্যবহার হ’ত। পরে হাওয়া দিয়ে কাফ ফোলানোর পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়।
১৯০৫ সালে বিজ্ঞানী নিকোলাই কোরটকফ সিস্টোলিক-ডায়াস্টোলিক (রক্তচাপের ওপর এবং নিচের সংখ্যা) প্রেশার আলাদাভাবে মাপার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। প্রথমে রক্তবাহের ওপর চাপ বাড়িয়ে রক্ত-সঞ্চালন বন্ধ করা হয়। রক্ত-সঞ্চালন শুরু হ’লে রক্তবাহের মধ্যে রক্ত চলাচলের শব্দ শুরু হয়। সেই শব্দের শুরু এবং শেষ দিয়ে সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টোলিক (যা যথাক্রমে হৃৎপিণ্ডের সংকোচন ও প্রসারণ নির্দেশক) প্রেশার বোঝা যায়। এই পদ্ধতিতেই এখনও রক্তচাপ মাপা হয়। বিজ্ঞানীর নাম অনুসারে, স্টেথোস্কোপ দিয়ে শোনা রক্ত-চলাচলের শব্দকে ‘কোরটকফ সাউন্ড’ বলা হয়।
যদিও স্বয়ংক্রিয় রক্তচাপ মাপার যন্ত্রে এসব কিছুই জানার দরকার হয়না কিন্তু সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপার জন্য নাড়ি-টিপে কিংবা কানে শুনে ম্যানুয়ালি রক্তচাপ মাপা-ই অনেক বেশি নিখুঁত। যতোই হোক, শিক্ষার কোনও শর্টকাট রাস্তা হয়না- এ তো জানা কথাই।
দারুণ …দাদা.
পরবর্তী নতুন লেখার অপেক্ষায় রইলাম৷