(যুদ্ধ-পূর্ববর্তী এক প্যালেস্টিনিয়ান শিশু। বোমায় মৃত)
(ইজরায়েলের আক্রমণে ক্রমাগত বেড়ে চলা শিশুর মৃত্যু)
(গাজার গণহত্যার/গণকবরের চিত্র)
৩০ অক্টোবর, ২০২৩-এ হামাসের পাঠানো পণবন্দীদের একটি ভিডিও যেখানে দেখানো হয়েছে এক বন্দীর শরীরে কোন অত্যাচারের দাগ না থাকলেও চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ রয়েছে। এই ভিডিও দেখে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন – “নিষ্ঠুর মানসিক অত্যাচার।” কোন পাঠকের কাছে এটা নিষ্ঠুর পরিহাস মনে হতে পারে। কারো কাছে বড়ো বেদনার মতো বুকে বাজতে পারে। এখানে সিনেমার মতো একটু “রিইওয়াইন্ড” করে ইতিহাসকে দেখা যাক। তবে একটা কথা পরিষ্কার করে বলে নেওয়া দরকার যে আমি ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের দীর্ঘ সংঘর্ষের ইতিহাস এবং ভূমিখণ্ডের দখলদারি নিয়ে প্রায় ৮০ বছর ধরে চলা ক্রমাগত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আমি কোন আলোচনায় যাব না। এ বিষয়ে বাংলায় সংক্ষেপে এবং বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের উন্মোচনের জন্য আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত (১৬.১০.২০২৩) বরেণ্য ঐতিহাসিক এবং সমাজতত্ত্ববিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ “বিশ্বের বৃহত্তম কারাবিদ্রোহ” দ্রষ্টব্য – https://epaper.anandabazar.com/imageview_73178_24926428_4_71_16-10-2023_4_i_1_sf.html।
আমার আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে যেভাবে নিষ্ঠুর যুদ্ধের/আক্রমণের বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ (শিশু থেকে বৃদ্ধ, সুস্থ থেকে মানসিকভাবে অসমর্থ), চিকিৎসা পরিষেবা, বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদের জন্য আকুল হাহাকার এবং চিকিৎসাকেন্দ্র তথা হাসপাতাল ধ্বংস হয়ে যাওয়া – এ সমস্ত বিষয়গুলো।
পেছনে ফিরে ইতিহাসকে দেখা
গাজা থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার জন্য ভিটেহারা, খাদ্যহারা, পানীয় জলহীন, নিরাশ্রয় নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ-অশক্তদের ঢল নেমেছে গাজার রাস্তায়।
(শরণার্থীদের ঢল)
(ধ্বংসস্তূপে পরিণত গাজা)
এ ঘটনাগুলো বর্তমানের – গত ৭ অক্টোবর, ২০২৩-এ ইজরায়েলের ওপরে প্যালেস্তিনিয়ান হামাস বাহিনীর রকেট হামলার ‘প্রত্যুত্তরে’ ইজরায়েল বাহিনীর প্যালেস্তাইনের গাজা অঞ্চলের সাধারণ মানুষের ওপরে নির্মম, নির্দয়, নিরবচ্ছিন্ন আগ্রাসন এবং গোলা বৃষ্টির পরিণতি।
আমরা জানি ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় – ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ অব্দি – ইউরোপীয় ইহুদিদের ওপরে নৃশংসতম অত্যাচারগুলো হয়েছিল। সেদিনও শিশুরা মারা গিয়েছিল কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের গ্যাস চেম্বারে – অনেক অনেক শিশু, বৃদ্ধ, নারী, অশক্ত, সুস্থ মানুষ। সবমিলিয়ে সংখ্যাটা কমবেশি ৮০ লক্ষ। গাজায় ৭ অক্টোবরের পর থেকে কমবেশি ৩,৫০০,০০০ মানুষ ভূমিহারা, গৃহহারা। দলে দলে অন্যত্র পালিয়ে যাচ্ছে, যদি কোন তুলনায় নিরাপদ জায়গা পাওয়া যায়।
(আউশভিৎজ ক্যাম্পের শিশুরা)
(গ্যাস চেম্বারে ঢোকানোর আগে গাজার শরণার্থীদের মতো ইহুদিদের লাইন)
মন্ট্রিয়ল হলোকস্ট মিউজিয়ামের তরফে ২০১০ সালে প্রকাশিত হয় গ্যাস চেম্বারে মারা যাবার আগে ১৭টি চিঠির একটি সংকলন – স্কুলের বাচ্চাদের নৃশংসতা এবং অবান্তর হত্যার বিরুদ্ধে ‘sensitize’ করার জন্য। এ সংকলনের নাম – 17 LETTERS for the first time and forever. এ সংকলনের ৪ নম্বর চিঠিটি ছিল এরকম (পৃঃ ২১) –
নীচে ইংরেজি অনুবাদ দেওয়া হল।
“Dear children,
Today is Sept. 19, 1941. It’s impossible to continue to live after these horrible experiences. All Jews have been taken away and there is no place to hide. Close friends are afraid to hide us until better times come. And they are right.
I kiss you and hug you tight for the last time, and forever. There’s no one to blame.
Grandma was taken away by the car. I don’t know where Grandpa and Mother are.
Your father. Billich
হলোকস্টের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে বেঁচে ফিরেছিলেন ডিটা ক্রাউস। তাঁর ৮৯ বছর বয়সে তিনি “Holocaust survivor”-এর স্মৃতি নিয়ে লিখলেন A delayed life: the true story of the Librarian of Auschwitz বইটি (২০২০)। সে বইয়ের ৫২ নম্বর অধ্যায়ে তিনি জানাচ্ছেন, নতুন প্রজন্ম যারা এ অভিজ্ঞতার সাথে কোনভাবেই পরিচিত নয় তাদের কথা এবং তাদেরকে সে অভিজ্ঞতার সঙ্গে কিভাবে মানসিক সংযোগ তৈরি করা হবে সে বিষয়ে – “One of my activities is giving talks about my personal Holocaust to students in Israel and also abroad. After the lecture I usually answer questions from the audience. For the youngsters, it’s a harrowing experience, and often they ask with hope in their voice, “But after the war, was your life a happy one?” Can I disappoint them and say no? I make some funny comment to avoid a direct answer.”
আজ সেই মানুষগুলো কিংবা যারা তাদের কাছ থেকে ওরকম দুঃস্বপ্নের অতীতের কাহিনী শুনেছে তারাই তো গাজায় একই ঘটনা ঘটাচ্ছে। যদি মনস্তত্ত্বের দিক থেকে বিচার বা বিশ্লেষণ করি তাহলে ব্যাপারটা কি এরকম দাঁড়ায় – যারা একসময়ে অত্যাচারের শিকার হয়েছিল তারা কি জাতি হিসেবেই তাদের মানসিক গঠনে, মননের প্রতিটি স্তরে সমধর্মী প্রভুত্বকে প্রতিষ্ঠার জন্য বিরোধীদের ক্ষেত্রে ভিন্ন চরিত্রের হলোকস্টের রেপ্লিকা তৈরি করাকে লালন করছে? বিপরীত পথে (reversely) তারা (বর্তমান ইজরায়েল) ৮০ বছর আগেকার অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা, আগ্রাসন, মৃত্যুর দূত হয়ে আবির্ভূত হওয়া – এ সমস্ত কিছুকে আত্মীকরণ এবং “internalization” করেছে?
আমাদের এ বিষয়টি গভীরে ভাবতে হবে বৈকি! এখানে আরেকটি বিষয়ও পাঠকেরা স্মরণে রাখবেন আশা করি, জার্মানি যখন হলোকস্ট তথা ইউরোপ ব্যাপী ইহুদি নিধন শুরু করে তখন সে একক শক্তি ছিল। কিন্তু আজকের ইজরায়েল কাগজে-কলমে বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিশালী দেশ আমেরিকার প্রত্যক্ষ সামরিক সহযোগিতা, আন্তর্জাতিক মঞ্চে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। পাচ্ছে সমস্ত ধরনের ইন্ধন, মদত এবং লজিস্টিক সাপোর্ট। পরিণতিতে আগ্রাসী “জায়নিসম (Zionism)”-এর প্রবক্তা ইহুদি রাষ্ট্র জাতি হিসেবেই এ ধ্বংস, হত্যা ও তাণ্ডবের লীলায় মেতে উঠেছে – নিজেদের মেধা এবং উদ্ভাবনী শক্তির সমস্ত রকমের ঔৎকর্ষ থাকা সত্ত্বেও।
বর্তমান সময়
নিউ ইয়র্ক টাইমস সংবাদপত্রের (১.১১.২০২৩) একটি খবরের শিরোনাম “Israel Hits Dense Gaza Area, Killing Dozens; Says It Was Targeting Hamas”।
আল-জাজিরা সংবাদ মাধ্যমের (৩১.১০.২০২৩) খবর হল “Israel-Hamas war updates: Dozens killed in Jabalia camp, Gaza official says”। এই জাবালিয়া হল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত উদ্বাস্তুদের জন্য তৈরি করা একটি শিবির। এরকম শিবিরও প্রাণঘাতী বোমার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেনা – অন্তত ৫০ জন মানুষ নিহত হয়েছে। একই সংবাদমাধ্যমের ১.১১.২৩-এর সংবাদ “Jordan recalls envoy to Israel, Jabalia struck again”।
কিন্তু এগুলো তো সামরিক অভিযান, রাজনৈতিক প্যাঁচপয়জারের কথা, যেখানে সর্বস্তরের অগণিত সাধারণ মানুষের মৃত্যুকে আদুরে নামে “collateral damage” বলা হয়। এই ব্যাপারটি আমরা ভিয়েতনাম, ইরাক, আফগানিস্তান সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে দেখে আসছি। ইরাক আক্রমণের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের মুখনিঃসৃত মন্ত্রে এই আদুরে নামটি সংবাদমাধ্যমে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাধারণভাবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে পড়ে।
আমরা যারা চিকিৎসা পেশার সাথে যুক্ত তারা আপাতত এসব বিষয়গুলোকে মুলতুবি রেখে আজকের পৃথিবীর মেডিসিনের জগৎ এই হত্যা ও ধ্বংসকে কি চোখে দেখছে সেটা বোঝার চেষ্টা করি।
মেডিসিনের জগৎ এবং গাজার যুদ্ধ
বিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল ল্যান্সেট-এ (ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর ১৬৮.৯) একের পর এক রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে গাজা নিয়ে। এবং বিশ্বের এক বিরাটসংখ্যক চিকিৎসককুল সেসব পড়ছেনও। তারপর? নৈঃশব্দ এবং নিরুচ্চার থাকার যৌগপদ্য রচিত হচ্ছে।
১৮.১০.২০২৩-এ খামিস এলেসি ল্যান্সেট-এ স্বনামে একটি চিঠি লিখেছিলেন “Save Gaza residents from imminent catastrophe” শিরোনামে। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন – “I am a neurorehabilitation and pain medicine doctor from the Gaza Strip (or Gaza), a tiny enclave along the Mediterranean Sea. Gaza was once a vibrant and rich coastal region. Since its occupation by Israel in 1967, Gaza has been progressively and systematically de-developed. Today, Gaza holds the highest population density in the world—50 times the density of China—with an area of 365 km and more than 2·3 million residents. 75% of these residents are refugees.”
তিনি আরও জানালেন – “People who survive the bombing are being killed more slowly by a blockade on fuel, water, food, and essential medical supplies. There is no safe drinking water. Fuel shortages have led to the only power station in Gaza being switched off. More than 50% of essential drugs are at zero stock, meaning there is less than a month’s supply left.”
চিঠির শেষে তাঁর কাতর আবেদন – “আমি গাজায় কর্মরত একজন ডাক্তার এবং আমি আমার পরিবার ও রোগীদের বাঁচাতে চাই। এ সমস্ত নিষ্ঠুরতার জন্য এখনই হস্তক্ষেপ করা হোক এবং এটা জরুরি হবার চাইতেও বেশি।”
গাজার অবস্থা ঠিক কতটা ভয়াবহ? আমাদের পক্ষে কি আদৌ অনুমান করা সম্ভব? অন্তত ছবি এবং পরিসংখ্যান দেখে বোঝার একটা চেষ্টা করা যেতে পারে।
(বোমায় বিধ্বস্ত গাজার একমাত্র ক্যান্সার হাসপাতাল)
গাজার আল আহলি হাসপাতালে বোমাবর্ষণের আগে WHO-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ওপর বিভিন্ন সময়ে ৫৭ বার আক্রমণ হয়েছে। ১৬ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছে, ২৮ জন আহত। ২৬টি হাসপাতাল অন্যান্য স্বাস্থ্যপরিষেবা প্রদানকারী কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৩টি অ্যাম্বুলেন্স ভেঙ্গেচুরে গেছে। এক-তৃতীয়াংশ হাসপাতাল এবং দুই-তৃতীয়াংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে – ১.১১.২০২৩-এর হিসেব অনুযায়ী।
১১ অক্টোবর থেকে নভেম্বরের প্রথম দিন পর্যন্ত গাজায় বিদ্যুৎ নেই, জ্বালানি নেই, জলের সরবরাহ নেই, নেই খাদ্যের সরবরাহ। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন এগুলো গজায় বন্ধ করা হবে – কার্যত হাতে এবং ভাতে দুভাবেই মারা হবে প্যালেস্তাইনের অধিবসীদের। হাসপাতালে বিদ্যুৎ না থাকার জন্য স্টেরিলাইজেশন এবং ডায়ালিসিসের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেমে যেতে পারে। কারণ জেনারেটর চালানোর মতো জ্বালানিরও সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে ইজরায়েল।
২০,০০০ মানসিক রোগীর অবস্থা ভয়াবহ। এরা না পারছে পরিস্থিতি অনুধাবন করতে, না পাচ্ছে কোন ওষুধ বা মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা। আনুমানিক ৫০,০০০ গর্ভবতী মহিলা ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি। Pre-natal, post-natal এবং মাতৃত্বকালীন সমস্ত ধরনের যত্ন থেকে বঞ্চিত। এমনকি জীবনদায়ী ওষুধের সরবরাহও নেই। এখানে তথ্য হিসেবে উল্লেখ করা দরকার, ইজরায়েলি এয়ারফোর্সের নিজের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ৭ থেকে ১২ অক্টোবরের মধ্যে গাজার ওপরে ৬,০০০-এর বেশি বোমা ফেলেছে – “Israel has dropped the same number of bombs on Gaza in six days as during the entire 2014 conflict” (https://edition.cnn.com/middleeast/live-news/israel-news-hamas-war-10-13-23/h_631f3cd1af4dd4fd81b80f303b3fcfa6)।
তীব্রতম সংকট দেখা দিয়েছে জলের ক্ষেত্রে।
(ইউনিসেফের চিত্র)
গাজা মিউনিসিপ্যালিটি বোমাবর্ষণের আগে মাটির নীচ থেকে যে পরিমাণ জল দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য তুলতে পারত তার ৫%-এরও কম পরিমাণ জল এখন তোলা সম্ভব হচ্ছে – কোন বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই। সমুদ্রের জলকে লবণমুক্ত করে ব্যবহারের জন্য যে প্ল্যান্টগুলো ছিল সেগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা আক্রমণ-পূর্ববর্তী অবস্থার ৭%-এর চেয়েও কমে এসে ঠেকেছে। প্রতিদিন গাজার মানুষের জন্য বরাদ্দ মাথাপিছু ৩ লিটার জল – রান্না, খাওয়া, স্নান, প্রাতঃকৃত্য ইত্যাদি সমস্ত রকমের কাজ ধরে। এর ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে কৃষিকাজের জন্য ধু ধু মরুপ্রান্তরে যে কুয়ো খনন করে সেখান থেকে নোনা জল পান করছে। এই জলে মিশে আছে ইন্সেক্টিসাইড, পেস্টিসাইড এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ। এগুলো শরীরে গিয়ে মিশছে এবং অদূর ভবিষ্যতে মহামারি হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা, উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা ভারী ধাতুর সংক্রমণ-জনিত রোগের আশঙ্কা।
বর্জ্য পদার্থ পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহৃত পাম্পগুলোর (sewage pumping) ৬৫টি অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে জ্বালানি এবং বিদ্যুতের অভাবে। গাজার রাস্তায় উপচে পড়ছে সমস্ত রকমের বর্জ্য পদার্থ – হয়তো ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বহীন প্যালেস্তিনীয় মানুষদের সংক্রমিত হবার পথ সুগম করে তুলছে।
চিকিৎসক সমাজের প্রতিক্রিয়া
ল্যান্সেট-এ গাজার আল-আজহার ইউনিভার্সিটির মেডিসিনের অধ্যাপক Mohamed Reyad Zughbur-এর আবেদন প্রকাশিত হয় “Protect civilians’ lives and health care in Gaza” শিরোনামে (অক্টোবর ২৭, ২০২৩)। তাঁর আবেদনের শুরুতে বলছেন – “যখন নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রারম্ভে আল-আজহার ইউনিভার্সিটির শিক্ষক এবং ছাত্ররা সবাই টগবগ করছে নতুন পাঠারম্ভের চ্যালেঞ্জ নেবার আনন্দে, সে সময় আমাদের সবাইকে স্তম্ভিত করে শুরু হল যুদ্ধ। এ যুদ্ধে শুধু যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং ল্যাবরেটরি ধ্বংস হয়েছে তাই নয় সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চল ভয়ঙ্করভাবে চুরমার হয়ে গেছে … গাজার ২০ লক্ষের বেশি মানুষ তাদের মর্যাদা খুইয়েছে।”
তাঁর লেখার শেষ অনুচ্ছেদে বলছেন – “যে সমস্ত ঘটনা ঘটে চলছে সেগুলো আমার বোধগম্যতার বাইরে এবং এখনকার পরিস্থিতি যার মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি তার “gravity” আমার পক্ষে ব্যাখ্যা করাও সম্ভব নয়। বিশ্ববাসীর এখানে যা ঘটে চলেছে সেই ঘোরতর শোচনীয় অবস্থার কথা জানা উচিত। এবং all those with consciousness should act to protect civilian lives and health care in the Gaza Strip.”
আরেকটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিল ল্যান্সেট-এ (অক্টোবর ২৭, ২০২৩) – একজন প্যালেস্তিনীয় চিকিৎসক Lina Qassem-Hassan এবং একজন ইজরায়েলি চিকিৎসক Raphael Walden-এর স্বাক্ষরিত। শিরোনাম “A Palestinian and an Israeli physician speak out for medical ethics”। এই বিবৃতিতে তাঁরা বলেন – “এই মুহূর্তে মানবিক কারণে সংঘর্ষ-বিরতি করতে হবে, সবসময়ে যাতে খোলা থাকে এরকম একটি ‘humanitarian corridor to enable the delivery of medical aid, water, fuel, and electricity’-এর প্রতিষ্ঠা সুনিশ্চিত করতে হবে, ইজরায়েলি এবং বিদেশী পণবন্দীকে মুক্ত করতে হবে এবং এখানে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে অসুস্থ ও বৃদ্ধদের, এবং যতক্ষণ এগুলো নিশ্চিত না হচ্ছে ততক্ষণ যাদের বন্দী রাখা হয়ছে তাদেরকে যথোপযুক্ত মেডিক্যাল পরিষেবা দিতে হবে। যতক্ষণ অবধি হাসপাতালগুলোকে ফাঁকা করে দেওয়া যাচ্ছেনা ততক্ষণ ইজরায়েল must refrain from issuing evacuation orders.”
তাঁদের শেষ আবেদন ছিল – “যে সময়ে আমাদের খুব সামান্য সামর্থ্য আছে ঘটনাপ্রবাহকে প্রভাবিত করার, সে সময়ে আমরা এটুকু নিশ্চিত করতে পারি যে খুব ন্যূনতম হলেও আমাদের কণ্ঠস্বরে যেন আমাদের পেশার মূল্যবোধ প্রতিধ্বনিত হয়।”
এরকম আরও বহু বহু আবেদন এবং রিপোর্ট ক্রমাগত প্রকাশ করে চলেছে ল্যান্সেট। এ থেকে বোঝা যায় চিকিৎসক সমাজের একটি অংশ, ক্ষুদ্র হলেও, তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে বিশ্বের চিকিৎসককুলকে জানাচ্ছেন। তারপর? এখনও পর্যন্ত এক বিরাট শূন্যতা ছাড়া আর কিছু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।
এখানে একটু অতীতে ফিরে যাই। সাধারণ মানুষের যুদ্ধের বলি হওয়া অভিনব কিছু নয়। বরঞ্চ এটাই স্বাভাবিক বলে আন্তর্জাতিক মানসিকতার ক্ষেত্রে মান্যতা ও গ্রাহ্যতা পেয়েছে। ২১ নভেম্বর, ২০১৮-তে NEJM-এ প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের শিরোনাম – “Disease and Famine as Weapons of War in Yemen”। প্রবন্ধটি শুরু হচ্ছে এভাবে – How can the medical community take stock of the humanitarian disaster in Yemen? কিভাবে পৃথিবীর মেডিক্যাল সমাজ ইয়েমেনে যে মানবিক বিপর্যয় চলছে তার বিবেচনা করবে? কোথায় ইয়েমেন? মধ্য এশিয়ার একফালি দেশ – রেড সি, আরব সাগর এবং সৌদি আরব দিয়ে ঘেরা। ২০১৬ থেকে ইয়েমেনের মানুষ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, জীবনহানি, শিশুমৃত্যু, কলেরা, দুর্ভিক্ষ, কলেরার মতো মহামারী প্রত্যক্ষ করছে। ইয়েমেন গৃহযুদ্ধ চলছে।
NEJM-এর লেখাটিতে ফিরে আসি। লেখার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে আমরা জানছি ২০১৮-র অগাস্ট মাসে একটি স্কুল বাসের ওপরে সামরিক বিমান হানায় ৫০ জনেরও বেশি খুদে স্কুল ছাত্র মারা গিয়েছে। কিন্তু “woefully underreported relative to the magnitude of the ongoing crisis” – বর্তমানে যে পরিমাপের সংকট চলছে তার তুলনায় করুণভাবে এ নিয়ে প্রায় কোন রিপোর্ট নেই। এরপরে প্রবন্ধে একটি অমোঘ মন্তব্য রয়েছে – “এরকম অবহেলা আমাদের সামগ্রিক সংবেদনশীলতা যে বিবশ হয়ে পড়েছে (numbing of our collective sensitivity) তা বড়ো দগদগে করে দেখায়।” কোথায় রাখবো আমরা মানবাত্মার এবং আমাদের মরমী অস্তিত্ব ভুলুন্ঠিত হবার অপমান? একই ঘটনা কয়েক বছরের মধ্যে আমরা ইরাকে দেখেছি, দেখেছি সিরিয়াতে, দেখেছি আফগানিস্তানে। আমাদের যাপনে আর চৈতন্যে এভাবে হয়তো কষাঘাত করেনি – পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন!
৭ জানুয়ারি, ২০১৭-তে ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত “Malnutrition in Yemen: an invisible crisis” শিরোনামের প্রবন্ধ থেকে আমরা জানছি – ১ কোটি ৪৪ লক্ষ মানুষ মারাত্মকভাবে খিদের অসুখ অপুষ্টিতে ভুগছে, ৩৭০,০০০ ইয়েমেনি শিশু ভয়ঙ্কর অপুষ্টিতে আক্রান্ত। UNICEF-এর হিসেব অনুযায়ী প্রায় ১ কোটি (সঠিক হিসেব ৯৯০,০০০০) শিশুর কোন না কোনরকম “nutrition assistance” প্রয়োজন। ইয়েমেন খাদ্যের মূল্য বেড়েছে ৫৫%, জিডিপি-র সংকোচন হয়েছে ৩৩%। ৯ ডিসেম্বর, ২০১৭-এ ল্যান্সেটে প্রকাশিত আরেকটি প্রবন্ধ – “Millions in need of humanitarian assistance in Yemen” – খুব স্পষ্ট করে জানালো – “The Saudi-led coalition, which has received logistical and intelligence support from the UK, the USA, and France, closed air, land, and sea access on Nov 6”।
একটি ক্ষুদ্র দেশকে সমস্ত দিক থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে কেবলমাত্র উচিৎ শিক্ষা দেবার জন্য। সমস্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা, রোগ-মোকাবিলার প্রক্রিয়া এবং মাধ্যম, জলের ও বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হবার ফলে প্রতি ১০ মিনিটে একজন করে শিশু মারা যাচ্ছে। বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সরবরাহ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হবার আরো কিছু ধারাবাহিক ফলাফল আছে – (১) হাসপাতালে জেনেরাটর চালানো যাচ্ছেনা, (২) কোন আইসিইউ বা ইমার্জেন্সি ব্যবস্থা চালানো যাচ্ছেনা, (৩) ভ্যাক্সিন এবং ওষুধ সরবারাহের জন্য যে cold chain দরকার তা রক্ষা করা যাচ্ছেনা। এর দরুণ কোন প্রতিষেধক টীকা দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
ফলাফল? যেখানে ২০১৫-তে কোন ডিপথেরিয়া রোগী ছিলনা সেখানে ২০১৮-তে ৪৮ জন ডিপথেরিয়া রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে, ৩০০০-এর বেশি হামের রোগী (মৃত্যুর সংখ্যা ২০-র বেশি), নিউমোনিয়া এবং পোলিও সংক্রমণের আশঙ্কা গভীরভাবে দানা বাঁধছে। বোধহয় নিয়তির পরিহাস! ৮ জানুয়ারি, ২০১৯-এর আনন্দবাজার পত্রিকার খবর অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে হামে মৃত্যুর সংখ্যা ১৮। এবং স্বাভাবিকভাবেই সেটা গভীর উদ্বেগের বিষয়। এবার সংখ্যাতাত্ত্বিক তুলনায় আসা যাক – পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ১০ কোটি জনসংখ্যায় ১৮ জনের মৃত্যু, আর যুদ্ধবিক্ষত ইয়েমেনে ৩ কোটি মানুষের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা ২০-র বেশি।
খুব সম্ভবত গাজাতেও আমরা এরকম ঘটনার সম্মুখীন হতে যাচ্ছি। ল্যান্সেট-এ (১.১১.২০২৩) দু’জন ইজরায়েলি চিকিৎসকের (Shelley A Sternberg এবং Edward Breuer) লেখা প্রতিবেদনের শিরোনাম “The conflict in Gaza: a view from Israel”। এ লেখায় তাঁদের বক্তব্য – “we sincerely pray for the protection of innocent lives on both sides of the border, but … concern for the lives of Gazans (which we most emphatically share) must begin with the terrorist organisation that currently governs Gaza.”
(গাজায় নিহত নারী – এ দৃশ্য যেন বিশ্ববাসীকে ক্রমাগত দেখে যেতে না হয়)
এখানে একটি চিঠির উল্লেখ করি। চিঠিটি লিখেছেন Volker Turk, High Commissioner for Human Rights, ২৮.১০.২০২৩-এ ইউনাইটেড নেশনশ (UN)-এর হাই কমশনারকে। চিঠিটির কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি – “Dear High Commissioner,
This will be my last official communication to you as Director of the New York Office of the High Commissioner for Human Rights.
I write at a moment of great anguish for the world, including for many of our colleagues. Once again, we are seeing a genocide unfolding before our eyes, and the Organization that we serve appears powerless to stop it. As someone who has investigated human rights in Palestine since the 1980s, lived in Gaza as a UN human rights advisor in the 1990s, and carried out several human rights missions to the country before and since, this is deeply personal to me …
High Commissioner, we are failing again …
This is a text-book case of genocide. The European, ethno-nationalist, settler colonial project in Palestine has entered its final phase, toward the expedited destruction of the last remnants of indigenous Palestinian life in Palestine. What’s more, the governments of the United States, the United Kingdom, and much of Europe, are wholly complicit in the horrific assault. Not only are these governments refusing to meet their treaty obligations “to ensure respect” for the Geneva Conventions, but they are in fact actively arming the assault, providing economic and intelligence support, and giving political and diplomatic cover for Israel’s atrocities.”
আমাদের তরফে এরপরে আর বলার কথা সামান্যই থাকতে পারে!
খুব ভালো লেখা
খুব প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণাত্মক লেখা।
অসাধারন সময়োপযোগী লেখা , সঠিক তথ্য সমৃদ্ধ
Lancet is doing its job
You have done yours too
আমি আর পড়তে পারছি নাআমার বোধ বিবশ।
এভাবে দলবদ্ধ মৃত্যু সহ্য করা যায় না।আর খবর দেখছি না।
তবু মনে হয় রাজা লিওপোল্ড কঙ্গোতে যে অত্যাচার করেছিলো সেটার অভিঘাতও কিছু কম নয়।
আমি দুঃখিত যে আমি মানুষ হয়ে জন্মেছি।
বুঝতে পারছি না কিভাবে এই দুঃসহ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা যায়। বিভিন্ন জায়গায় অন্তত কিছু মানুষ প্রতিবাদে মুখর হচ্ছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে আমেরিকান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে বা হচ্ছে। আমেরিকাতে অনেক মানুষ, এমন কি Jews রাও প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু শেষ কোথায়??!!
খুব ভালো লেখা স্যার
ভয়ঙ্কর। মোড়ক যাই দেওয়া হোক না কেন, হচ্ছে নির্বিচারে নরহত্যা। এই খুন চলছে, চলবে। সভ্যতার অগ্রগতির চিহ্ণ এটা।
অসাধারণ লিখেছেন ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য।
Very informative article. Deeply saddened!