সকাল বেলা। একজন বৃদ্ধ একটা আরামকেদারায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। একটা গোল ঘরের মতো, ঠিক ঘরও নয়, বারান্দাও নয়। লাল নিট সিমেন্টের সহস্র ফাটা দাগের এলোমেলো আল্পনা আঁকা মেঝে। একপাশে একটা তক্তাপোশ, মাঝখান দিয়ে কোলাপ্সিবল গেটের পরে লাল রোয়াকওয়ালা সিঁড়ি নেমে গেছে। বাইরে এক কোনায় একটা সবুজ টিউবওয়েল। এখন জং ধরে জায়গায় জায়গায় লালচে হয়ে গেছে। তার পাশে কিরণমাসি মাছ কুটছে- তিনটে বেড়াল বসে বসে গোঁফ আর থাবা চাটছে।
ঐ তক্তাপোশে বৃদ্ধের নাতিবাবু বসে আছেন। “দোদো ও দোদো?”
নাতিবাবুর বয়স প্রায় আট, এলোমেলো চুল, একটু ভালোমানুষ ভালোমানুষ চোখ। উনি মাতামহকে আহ্লাদে দোদো বলে ডাকেন।
“বলো দোদো”
“আচ্ছা কালকে যে লাল লাল মিষ্টি মিষ্টি তরকারিটা খেলাম না? ওটা কিসের তরকারি?”
দোদো কাগজ থেকে মুখ তুলে ভাবতে থাকেন। রাষ্ট্রদ্রোহ আইন আর সুপ্রিম কোর্ট এখন কাগজের মধ্যেই থেকে যায়। “ওঃহোঃ….”উনি মুখ কুঁচকে হাসেন “দোদো ওটা তো কুমড়ো ভাজা! তুমি আগে খাও নি?”
“পাপা তো আনে না… তাই”
“হুঁ আমি আগামীকাল অনেকটা কিনে আনবো….” দোদো আবার কাগজে মনোনিবেশ করেন।
“দোদো ওটা কিসের আওয়াজ?”
দোদো আবার কাগজ থেকে মুখ তুলে শব্দটি শোনেন। তারপর বলেন “কাঠঠোকরা”
“উডপেকার”
দোদো আবার কাগজ পড়ার চেষ্টা করেন।
“দোদো এখানে পাখির ডাকে আর আলোয় আমার ঘুম ভেঙে গেছে”
দোদো কাগজ সরিয়ে রাখেন। “তোঁয়ার ফাইখানা হঁইয়ে না?”
“পটি? হ্যাঁ হয়েছে।”
“বেয়াইন্না ক্যাঁন লাগের?”
“এ্যাঁ?” নাতি দোদোর চাঁটগাঁইয়া ভাষাটা বোঝে নি।
দোদো হেসে বলেন “সকালটা কেমন লাগছে?”
“এক্সেল্লেন্ট, তবে রাতের বেলা গরম লাগছিলো বাট ঘুমিয়ে গেছি।”
কিরণমাসি মাছ কুটে জালতি লাগানো বারান্দা পার হয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। বেড়ালগুলো নিঃশব্দে মাছের কাঁটা নিয়ে বসে থাকে।
“দোদো?”
“বলো দোদো”
“আজ কিন্তু আমি স্টেটসম্যান পড়ে শোনাবো না।”
দোদো হাসেন। ওনার চোখের কোনায় চামড়া কুঁচকে ওঠে। মোটা কাচের চশমা চকচক করে ওঠে।
“দোদো ও দোদো”
দোদো এই শহুরে সরল নাতিটিকে বড়ো ভালবাসেন। “বলো”
“আচ্ছা তুমি তো অনেক টাকা পেনশন পাও?”
বুড়ো বুঝতে পারছেন না এবার কথাটা কোনদিকে গড়াবে।
“হুঁ”
“তাহলে তুমি এসি লাগাও নি ক্যানো?”
ইতিমধ্যে দোদোর মেয়ে অর্থাৎ নাতিবাবুর মা ভেতর থেকে তাঁর বাবাকে প্রশ্ন করেন- “বাবা তুঁই চা (স আর চায়ের মাঝামাঝি একটা শব্দ, প্রথম শুনলে স্শা বলে মনে হয়) খাঁইয়ন নি?”
দোদো একটু উচ্চ কন্ঠে মতামত জানিয়ে নাতিকে প্রশ্ন করেন “দোদো, তোমার আম খেতে ভালো লাগে?”
নাতিবাবু কিঞ্চিৎ হতভম্ব। প্রশ্নটা ছিলো এসি নিয়ে। প্রতিপ্রশ্ন এলো আম নিয়ে। অথচ দোদো জানেন নাতি আম্রপ্রিয়। গত রাতেও খাওয়া হয়েছে।
“ভালো। ক্যানো?”
“সারা রাত গরমের পর সকালের এই হাওয়াটা কেমন লাগছে?”
উচ্ছ্বসিত নাতিবাবু বললেন “ফ্যান্টা”
দোদো হাসলেন। “দোদো গরমকাল না হলে আম কোথায় পাবে?”
নাতিবাবু ভাবেন কথাটা সত্য বটে।
“আর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ফুটবল খেলতে?”
“কিন্তু মাম্মি তো দ্যায় না,বলে জ্বর হবে” সুরে অনুযোগ।
“তোমার মা কিন্তু তোমার বয়সে বৃষ্টি হলেই ভিজে ভিজে ইশকুলে যেতো। ইচ্ছে করে। ছাতা খুলতো না। আমরা তো কাদা ভেঙে, নৌকায় নদী পেরিয়ে তবে ইশকুল। ফেরার সময় সব অন্ধকার হয়ে আসতো, মেঘ-নদী-আকাশ সব নীলচে কালো… তোমার মা’ও মেঘ করলে, ঝড় হলে, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হলে- সামনে যে মাঠটা দেখছো-ওখানে গিয়ে ভিজে ঝুপসিয়ে ফিরতো। জ্বর তো হতো না…..”
নাতি ভাবতে থাকে।
“আচ্ছা বলোতো ঠান্ডা আর গরম জিনিসদুটো কী?”
“এ্যাঁ?….ইয়ে এ দুটো….. ইয়ে ফিলিং”
“তুমি যদি কাল সারা রাত এসি চালিয়ে শুয়ে থাকতে আজ বাইরে বেরোলেই তোমার গরম লাগতো…. তাই না?”
“হ্যাঁ তা হয়তো ঠিক”
“হ্যাঁ। ঠিক। কেননা এসির হাওয়া ভোরের হাওয়ার চেয়ে অনেক বেশী ঠান্ডা। তাই না?”
নাতি ভেবে চিন্তে সহমত হয়। “দোদো! তাহলে আমরা এই সব ব্যবহার করবো না? তাহলে সায়েন্স এগোবে কী করে?”
নাতিবাবুর মা তাঁর বাবার জন্য চা নিয়ে আসেন। দোদো সিগারেট খান না তবে ধূমপান করেন। দ্বিপ্রহরে। গড়গড়ায় করে অম্বুরি তামাক। তখন নাতিবাবুর চোখ লেগে আসে। তারপর তিনি সামনের কালীমন্দিরের আড্ডায় যান পাশা খেলতে- অনেকটা লুডোর মতোই ছক্কা পাঞ্জা আছে, তবে ক্রশ চিহ্নের মতো বোর্ডটা।
মেয়ের করে আনা চায়ে চুমুক দিয়ে দোদো বলতে থাকেন “বিজ্ঞান এগোবে দোদো-মানুষের ক্ষিধে দূর করতে, জরা, মৃত্যু আর অসুখ দূর করতে…. প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়ে.. .. প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্ব করে আরও সুস্থ, সুন্দর একটা জীবন তৈরি করতে…”
নাতিবাবু বাধা দ্যায় “দ্দুর, তুমি না…. কী যে বলো বুঝতেই পারি না”
“দোদো আমরা ছোটবেলায় একটা গল্প পড়েছিলাম….. বোধহয় হিতোপদেশে…. কী জানি ঠিক মনে পড়ছে না”
“দরকার নেই। তুমি গল্পটা বলো”
“একটা রাজা ছিলো। সে ভারী ভুগতো…..”
“ও সুকুমার রায়ের রাজার অসুখ আমি জানি…. একটা লোককে খুঁজতে হবে”
“আঃ দোদো তুমি চুপটি করে শোনো। এটা অন্য গল্প”
“আচ্ছা আচ্ছা বলো”
“একদিন অঝোর বৃষ্টি পড়ছে আর রাজামশাই ঘরের ভেতরে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন…”
“কাঁথামুড়ি… হিহিহি”
“শোনো দেখি গোল না করে। জানালার ফাঁক দিয়ে রাজা দ্যাখেন একটা বাচ্চা ছেলে বৃষ্টিতে ভিজে একটা মোষের পিঠে চড়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে গরু চরাচ্ছে। রাজা তক্ষুণি মন্ত্রীকে ডেকে বললেন ঐ বাচ্চাটা বৃষ্টিতে ভিজছে আর আমার বৃষ্টি দেখলেই হাঁচি আর কাশি হয় কেন?
মন্ত্রী বললেন মহারাজ জানতে হলে একটা বছর সময় দিতে হবে।
রাজা বললেন তথাস্তু।.…”
“ও দোদো তথাস্তু মানে কী?”
“তথা মানে সেই রকম আর অস্তু মানে হোক। অর্থাৎ তাই হোক। বুঝেছো? এবার শোনো। পরের এক বছর সেই রাখাল ছেলে রাজার বাড়িতে থাকলো। তুলোর লেপে মুড়ে। গরম কালে এক ডজন চাকর পাখার বাতাস করে। যা চায়, যতটা চায় ততটা খাবার পায়। কোনও খাটা খাটনি নেই। রাখাল মোটা সোটা গোলগাল হয়ে গেল। খাবার দেখলে মুখ ঘুরিয়ে ন্যায়। এক বছর পরে সেই রকম এক বর্ষার দিনে রাখালকে খালি গায়ে আবার মোষের পিঠে চাপিয়ে মাঠে ছেড়ে দেওয়া হলো।”
“তারপর কী হলো?”
“রাখাল ফিরে এলো কাঁপতে কাঁপতে। তারপর তার ধুম জ্বর। কতো বদ্যি, কবিরাজ, ভীষক, জলপড়া, ওঝা, গুণিন… কিন্তু সেই রাখাল শেষমেষ মরেই গেলো”
“বাবা গল্প ভালা নঁয়” নাতিবাবুর মা মন্তব্য করলেন।
“তাহলে আমি ভিজবো বৃষ্টিতে? ও মাঁ শুনলে…”
দোদো কিছু বলেন না। হাসেন। “দোদো আজ দুপুরে আমি যখন কালীমন্দিরের দাওয়ায় বসে পাশা খেলবো, তখন তুমি আমার সঙ্গে যাবে? ভাদ্রের চড়া রোদে পুড়ে গরম হাওয়া বয়ে আসবে…. সদ্য গজানো কাশফুলের ঝোপ দুলে উঠবে, মাঠের গর্ত থেকে ভুঁড়ো শেয়ালের ছানারা উঁকি দেবে….”
“দোদো আমি দেখতে পাবো? কামড়ে দেবে না?”
দোদো হাসেন। “চলো তোমাকে একটা ছিপ বানিয়ে দিই, মাটির গর্ত থেকে কেঁচো ধরে দিই, বঁড়শিতে লাগিয়ে দেবো, মাঠের পাশে ভরা খালপাড়ে বসে মাছ ধরবে…. খলসে কই, সরপুঁটি…”
দোদোর পেছনে পেছনে লাফাতে লাফাতে নাতি চললো ছিপ বানাতে।