ওপরের লেখাটা দেখেই ঘাবড়ে গেলেন তো!
আমিও গেসলাম।
সেইদিন বিরিঞ্চির সঙ্গে দেখা হয়ে অবধি নিজের ওপর কনফিডেন্স কেমন যেন কমে গেছে আমার। মাঝে মধ্যেই মনে হচ্ছে হয় তো পার্কের বেঞ্চিতে বসে ঝিমোতে ঝিমোতে ওই দিবাস্বপ্নটি দেখেছিলাম। আসলেই ঘটেনি কিছু এ’রকম।
কিন্তু বিরিঞ্চির সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল। এ’বার আগের জায়গায় না। দুপুরে দিবানিদ্রা দেবার প্ল্যান করছি, এমন সময় গিন্নি বলল, – কেমন মেঘ করেছে, আঁধার করে। বিষ্টি নামলে ছাদে মেলে দেওয়া কাপড়চোপড় ভিজে একসা হবে। একটু নামিয়ে নিয়ে এসো তো।
নিজেও যেতে পারত। কিন্তু এখন টিভিতে তার সাধের সিরিয়াল শুরু হয়েছে। তা’ছাড়া হাঁটু ব্যথা। কিন্তু সে তো আমারও।
হুকুম তামিল করতে ছাদে উঠেছি, এমন সময় দেখি কার্নিশে দাঁড়িয়ে রয়েছে মূর্তিমান। আমাকে দেখেই ছাদের পাঁচিল ডিঙি মেরে ভেতরে এলো।
– কখন থেকে দাঁড়িয়ে। এতক্ষণে এলি?
বিশুদ্ধ ভৌতিক অভিমান!
সে কী? আমার তো আসার কথাই ছিল না এখানে এখন! আমার মনের কথা আন্দাজ করতে পেরে বিরু বলল,
– আমরা মানে ভূতেরা, কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পারি। ওই যে, পণ্ডিতেরা যাকে বলে ইএসপি।
শব্দটা চেনা চেনা লাগছে। ওই যে আগেই বলেছিলাম না বড্ড ভুলে যাই আজকাল। ডাক্তারের দেওয়া কিউটিপিন না কী যেন ট্যাবলেট গিলে আর পাড়ার দোকানের ব্রেনোলিয়া বোতল বোতল সাবড়েও, কোনও কিছুতেই উন্নতি হচ্ছে না। ইএসপিটা কী যেন?
আমার মুখে ফুটে ওঠা সংশয়টুকু পড়তে পারল বিরু। বুঝিয়ে বলল, – ইএসপি হল গে এক্সট্রা সেন্সরি পারসেপশন। কঠিন ব্যাপার। ও তুই বুঝবি না। ছাড়!
ব্যাপক হিংসে হল। এ ব্যাটা তো দেখি মরার পরেও বেশ আপ টু ডেট! আর আমি এই সংসারের চক্রে পড়ে, নতুন কিছু তো শিখলামই না বরঞ্চ পুরোনো জ্ঞানও ভুলে মেরে দিয়েছি।
আমি চুপ করে আছি দেখে বিরুই আবার মুখ খুলল – কী রে ভেবলে গেলি নাকি?
– না, মানে ইয়ে…
ইয়ে শুনেই বিরু ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমাকে শেষ করতে দিল না কথা।- হ্যাঁরে, ওই ইয়ের কথাটাই। সেদিন শুধোলি। বুঝিয়ে বলতে বলতেই আমার ইয়ে বেড়ে গেল আর আমিও উধাও হয়ে গেলাম বাধ্য হয়ে। বলা হল না।
– ওঃ তোর সেই সেদিনের লীন ইয়ে! বোঝাবি? তা বোঝা! যত্ত রাজ্যের গুলপট্টি। তুই মরে গিয়েও বদলালি না বিরু। সেই ইস্কুল বেলা থেকেই গুল মেরে মেরে…
মনে পড়ে গেল। এই বিরুর দেওয়া গুলের প্ররোচনায় হেড স্যারের মেয়েকে চিঠি লিখে রাম ক্যালানি খেয়েছিলাম হেডুর কাছে, ক্লাস সেভেনে। সে ছিল ডাইরেক্ট অ্যাকশনের যুগ। তখনকার দিনে এত গার্জিয়ান কলটল ছিল না।
বিরু খুব আহত হল। – গুল? ইয়ে ব্যাপারটা গুল? পুরোটাই ফিজিক্স, সলিল।
– আবার ফিজিক্সকে টানছিস? ফের যদি ফিজিক্স কথাটা উচ্চারণ করেছিস টেনে এক থাপ্পড় দেব। জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব। যত রাজ্যের ভৌতিক যত জ্ঞান, ফিজিক্সের মত একটা বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের নামে চালাবার চেষ্টা!
আমি ঝাঁঝিয়ে উঠলাম।
শ্রীমান বিরিঞ্চি কিন্তু আমার কথা শুনেই কেমন যেন… যাকে বলে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। – এই তো, তুই ও স্বীকার করলি। সাধে কী আর হিন্দি ভাষাটাকে শক্তিশালী বলে সবাই!
– যাব্বাবা! হচ্ছিল তো ফিজিক্স। এর মধ্যে আবার হিন্দি এলো কোত্থেকে?
চুক চুক আওয়াজ করল বিরু। – আহা ওই যে ভৌতিক জ্ঞান বললি না! জ্ঞান হবে না কথাটা। বলতে হত বিজ্ঞান। ফিজিক্সের হিন্দি তো ওইটেই। ইন্টারনেট ব্যাপারটাও ভালো করে শিখলি না। শিখলে জানতি। গুগলএ গিয়ে ফিজিক্সকে হিন্দিতে ট্র্যানস্লেট করলেই পেয়ে যাবি। ভৌতিক বিজ্ঞান।
– সত্যি? আমি হতবাক! হতভাগার ভৌতিক জ্ঞানের সীমা দেখে। এ দেখি ইনটারনেট, গুগল সব জানে।
আবার লেকচার শুরু করল মহাজ্ঞানী বিরিঞ্চি, – হ্যাঁ, তোকে যা বলছিলাম, ওই ইয়ের কথা। ইংরেজি অ্যাব্রিভিয়েশন বুইলি। আই ওয়াই ই। উইকিতে অবশ্যি আই ওয়াই ই তে অন্য ইয়ে পাবি। গুগলেও। কিন্তু সেই সব না। এ আমাদের নিজস্ব ভৌতিক ইয়ে। ইনটেনসিভ ইয়ারন এক্সপেরিয়েন্স।
বলেই পকেট থেকে পেন কাগজ বার করে, খসখস করে লিখে দেখালো। দেখি লিখেছে, Intense Yearn Experience. লিখে বলল – তুই তো আবার ইংরেজিতে ধনুর্ধর। মানে বুঝলি কথাটার?
ওর কথা মতন মোবাইলের গুগলে ফেলে ট্র্যান্সলেট করে দেখি লেখা আছে ‘তীব্র আকুল অভিজ্ঞতা।’
ভুরু নাচাল বিরিঞ্চি। – কী বুজলি! গুগল সব জানে। এই যে শরীর ধারণ করে আচিস, ধর গে, এটা হল তোর বরফ দশা। তারপরে ঝড় যাচ্চে, ঝাপ্টা যাচ্চে, করোনা যাচ্চে। বাপ মা মরে যাচ্চে। ভাই ঠকাচ্চে। বন্ধু জক দিচ্চে। আপিসে চাকরি চলে যাচ্চে। খুব কাচের কিন্তু মোটে চিনতে পারিসনি ভালোবাসার তোড়ে, এমন কেউ ছেড়ে যাচ্চে। এই সবই হল গে ওই উনুনের আঁচের মত। ওই ‘তীব্র আকুল অভিজ্ঞতা।’ আস্তে আস্তে তোর লীন ইয়ে বাড়চে। ভেতরে ভেতরে। ওই ধর গে তোর গলনাঙ্কেরই মত। একেক জনের গলনাঙ্ক একেক রকম। বরফ শরীর টেরও পাচ্চে না। অথচ একদিন হুস করে গলে জল হয়ে যাবি। ওই যাকে তোরা ভূত বলিস।
– তাইলে, তুই আবার শরীর কী করে ফিরে পাস মাঝে মধ্যেই?
– এ শরীর, সে শরীর নয় রে সলিল। আস্তে আস্তে ভেতরের ইয়ে কমিয়ে একটু থিতু হই। তবেই ওই পুরোনো শরীর দ্যাকা দেয়। তবে এ’বারের এই পাওয়া শরীরটা অনেক আনস্টেবল, বুইলি তো।গলনাঙ্কের কাছেই তো! অল্পেই ইয়ে বেড়ে যায়। মানে সেইটাই ভৌতিক নিয়ম কি না!
মাথা ঝিমঝিম করছিল এই সদ্য পাওয়া অদ্ভুতুরে জ্ঞানে।
এর মধ্যেই বৃষ্টি নামল ঝেঁপে। কাপড়জামা তোলা হয়নি এখনও। ভয়ে ভয়ে তাড়াতাড়ি হাঁচোড়পাঁচোড় করে জড়ো করতে থাকি সে’গুলো। আমি আমার গিন্নিকে ভারি ভয় করি। রেগে গেলে হাত চালায়। দেরি করেছি টের পেলে বিপদ।
যৌবনকালে তো এমন রেগুলার পেটাত যে, একদিন মারতে দেরি করেছে বলে জিজ্ঞেসই করে ফেলেছিলাম,
– হ্যাঁ গো তুমি কি রাগ করেছ? আজ যে এখনও মারলে না!
বউ শুনলে বলে এই সবই নাকি আমার বানানো গল্প কথা। অন্যদের থেকে টুকে ঝাড়ছি।
হতে পারে। আমি বড্ডই ভুলে যাই আজকাল।
কিন্তু আমি জানি এই সবই প্রায় সত্যি। ভয়টুকু হাড়ে হাড়ে সত্যি।
কাপড় তুলতে তুলতে ভাবছিলাম, এই ভয়টাকে কি ওই ‘তীব্র আকুল অভিজ্ঞতা’ বলা যায়? আর এই যে পাড়ার দাদা থ্রেট করছে প্রোমোটারের হয়ে, ফেসবুকে কেউ খাপ বসাচ্ছে আমাকে নিয়ে, এই সবও কি বিরিঞ্চির সেই ইয়ে?
জিজ্ঞেস করতে যাবো, দেখি বৃষ্টি মুষলধারে শুরু হয়ে গেছে। বিরিঞ্চির শরীরটা গায়ে জল পড়তেই কেমন গলে গলে যাচ্ছে। যাঃ, উধাও হয়ে গেল। জল লাগলে কি ইয়ে বাড়ে?
ওর ইয়ে বাড়ার কারণটা বুঝলাম বউয়ের পাড়া জাগানো চিৎকারে। সিরিয়ালটা শেষ হতেই ওপরে উঠে এসেছে,
– কাজটা না করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাপড়গুলো ভেজালে? অকাজের ধাড়ি একটা!
বলেই সন্দেহপ্রবন খরচোখে চারপাশের ছাদগুলো জরিপ করল, কোথাও কোনও মহিলাকে দেখা যাচ্ছে কি না।
বুঝলাম বিরিঞ্চি ওর ইএসপিতে ঘটনা কী ঘটবে জানতে পেরেই ওর ইয়ে বাড়িয়ে ফেলেছিল। তাই ও’রম গলে গেল নিমেষে।
ভাগ্যিস গেল… নইলে আমারই আবার ইয়ে বাড়ত
খানিক।
আগের কথা জানতে হলে