আজ ২০২৪এর নভেম্বর মাসের ২৫ তারিখ । আজ আমার নিজের ঘরে ফিরে যাবার দিন। মাত্র ৫৬ দিনের ভিসা নিয়ে তোমাদের কাছে আসা, চাঁদ মামার সঙ্গে থেকে একরকম শিক্ষানবিশের ভূমিকা পালন করা, আর আজ ফিরে যাওয়া স্বস্থানে। নীরবে এসেছিলাম, আবার নীরবেই বিদায় নেবো তোমাদের সকলের কাছ থেকে। আমার পুরনো আস্তানায় ফিরে গিয়ে আমার এই ৫৬ দিনের ধরিত্রী পরিক্রমার গপ্পো করবো আমার সহযোগী বন্ধু বান্ধবদের কাছে। ও মা! এই দেখো ! তোমাদের আমার নামটাই তো বলা হয়নি। বলছি বাপু, বলছি। একটু সবুর করো। তবে কি জানো! আমার নামের কিন্তু মোটেই বাহার নেই। এই যে তোমাদের চাঁদ দাদা, ও কী বললে? দাদা নয় মামা? তা বেশ, তা বেশ। দাদা নয়,মামাই সই ; তাঁর তো কত নাম! চন্দ্র,চন্দ্রমা,ইন্দু,নিশাকর, সুধাংশু,শশী, রজনীকান্ত,রজনীনাথ,সোম,বিধু……. বাপরে বাপ! এত্তো নাম ! মনে রাখাই সমস্যা। আমার নামের বাপু এতোশত ঝঞ্ঝাট নেই। সবাই আমাকে চেনে 2024 PT 5 নামে। পছন্দ হলো না তো নামটা? জানতাম, বিলকুল জানতাম। কিন্তু কী করবো বলো ? মহাকাশের যে পাড়ায় আমি পাকাপাকি ভাবে থাকি , সেই আর্জুনা গ্রহাণুবলয়ে, আরও ১ থেকে ১.৯ মিলিয়ন অনুগ্রহ বা গ্রহাণুর সঙ্গে সেখানকার বন্ধুরাও সব মুখিয়ে আছে আমার মুখে তোমাদের কথা শোনার জন্য। এমনিতেই দেখলাম তোমাদের ধরিত্রীর বুকে ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই অবস্থা । সবখানেই কেমন যেন আকচা আকচির পর্ব চলছে। আমাদের সূর্য মামার সংসার অবশ্য ঠিক তেমন নয়, প্রত্যেকেই তার জন্য নির্দিষ্ট পথে সমানে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমাদের কলোনিটা রয়েছে ঠিক মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মাঝের জায়গাটাতে। ওখানেই ফিরে যেতে হবে আমাকে।
আমার আসা নিয়ে তোমাদের মধ্যে যেমন কোনো হৈচৈ দেখিনি, চলে যাওয়া নিয়েও তেমন কোনো আলোড়ন হবে বলে মনে হয়না। তাতে আমার অবশ্য বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। রাত আকাশে আমাকে দেখতে পাওনি তোমরা,মানে আম জনতারা। ফলে তোমাদের হৃদয় উদ্বেলিত হবে কী করে? তাছাড়া আমার চেহারাও তো তেমন নজরকাড়া নয় , লম্বায় আমি মাত্র ১১ মিটার। তোমাদের রাস্তায় প্রতিদিন যে নীল রঙের বাসগুলো ছুটোছুটি করে প্রায় তাদের সমান। এতো সামান্য চেহারা নিয়ে কি আর জনতা জনার্দনের মন কাড়া যায়? তবে আমি একজনের কাছে সত্যিই কৃতজ্ঞ । তিনি হলেন আমেরিকার মিয়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার বিশিষ্ট অধ্যাপক ও গবেষক ডঃ নিকো ক্যাপ্পেল্লুটি। ভাবছো কেন? বলছি।
আগস্ট মাসে সর্বপ্রথম আমার মতো এক সামান্য গ্রহাণুর, চাঁদ মামার সহযোগী হিসেবে কাজ করতে আসার খবর কানে আসতেই তিনি যে ভাবে আমাকে নিয়ে মেতে রইলেন বিগত পঞ্চান্ন দিন তার তুলনা মেলা ভার।বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে ঢাউস সাইজের এক দূরবীনের আরশিতে চোখ রেখে এতোগুলো দিন নাওয়া খাওয়া ভুলে কাটিয়ে দিলেন মানুষটি। আর দেবেন নাই বা কেন? আমি তো আর হর বছর পৃথিবীর এতো কাছে আসছি না। অথচ আমার শরীরে ছড়িয়ে আছে সৌর জগতের সৃষ্টির অপার রহস্য। সেইসব না জানা রহস্যের সমাধান খুঁজে বের করতেই তো গবেষণায় মেতে ছিলেন ঐ ক্যাপ্পেল্লুটি সাহেব। তাঁর কাছেই শুনলাম আমার শরীরের ভেতর রয়েছে কতনা মূল্যবান খনিজ সম্পদ – সোনা, রূপা, নিকেল, কোবাল্ট … আরও কতো কি! সব কি আর মনে থাকে?
আর তাছাড়া আমার বা আমাদের তো ওসবে কোনোই আগ্রহ নেই। সোনা রূপা নিকেল নিয়ে আমরা কি করবো? ওসব তোমাদের দরকার – একজনের অন্যজনেদের ছাপিয়ে যাবার জন্য। আরো উঁচুতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। এই মানসিকতার জন্যই সারা দুনিয়া জুড়ে কেবল হানাহানি আর দ্বন্দ্ব, সংঘাতের বাতাবরণ কায়েম করেছো তোমরা। একবারের জন্য কি ভেবেছো এই দুনিয়াদারির শেষ কোথায়? কী এর পরিণতি? নিকো ক্যাপ্পেল্লুটি সাহেবের এক বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। তাঁর নাম ডঃ বার্ট্রান্ড ডানো। তিনিও অধ্যাপক ঐ মিয়ামিতে। তিনি জানান, এখন চেষ্টা চলছে গ্রহাণুপুঞ্জ থেকে কিছু বড়সড় চেহারার গ্রহাণুকে পাকড়াও করে পৃথিবীতে নিয়ে আসার। কেননা ধরিত্রীর বুকে জমে থাকা সম্পদের ভাণ্ডার ক্রমশই নিঃশেষ হয়ে আসছে। মানুষের সভ্যতা সংস্কৃতি উন্নয়নের জন্য নাকি আরও আরও সম্পদের প্রয়োজন। তাই এমন গ্রহাণু লুটের পরিকল্পনা!! সাবাস! কেমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত!
আজ এই বিদায় বেলায় যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো এই পঞ্চান্ন+ একদিন ধরে চাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর পাশে পাশে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা কেমন হলো? তাহলে বলবো মিশ্র অনুভূতি হয়েছে। তোমরা হলে পৃথিবীর আবাসিক, পৃথিবীই তোমাদের ঘর ; অথচ দেখো নিজেদের ঘরের কি হতশ্রী অবস্থা করেছো তোমরা? তোমাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে সমস্ত মহার্ঘ্য উপকরণ সাজিয়ে রেখেছেন ধরিত্রী – ক্ষিতি,অপ,তেজ,মরুৎ আর ব্যোম – সেসব বিলকুল বিশৃঙ্খলায় ভরে উঠেছে তোমাদের হাতে পড়ে। আর হয়তো তাই আর্কটিক আর আন্টার্কটিকা আজ প্রায় বরফ শূন্য, পৃথিবীর উঁচু পর্বতের শরীর জুড়ে লেপ্টে থাকা সুবিশাল হিমবাহগুলো আজ অদৃশ্য প্রায় ,প্রবল খরার কারণে শুকিয়ে যায় আমাজন, ইয়াংসিকিয়াঙের মতো সুদীর্ঘ নদী, উষ্ণায়নের দাপটে হাঁসফাঁস করে অগণিত সংখ্যক মানুষ আর প্রাণির জীবন , ঝড়ের দাপটে ছাড়খার হয়ে যায় কতো জনপদ , ডানার মতো ভয়ঙ্কর ঝড়ের দাপটে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া সহ অন্যান্য এলাকা , সাহারা মরুভূমির বুকে জমে বৃষ্টির জল , আর আরবের ধূসর মরুভূমি ঢেকে যায় সাদা বরফের চাদরে ….. । আর কতো বলবো? বলতে বলতে গলা বুজে আসে। সত্যি বলতে কি এমন সব দৃশ্য দেখার জন্য কিন্তু মোটেই আমি এখানে আসিনি। তোমাদের নিজেদের মধ্যেই কত কত লড়াই, দলাদলি,দীর্ণতা!আবার তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবো । কবে? আজ থেকে ঠিক ৫৫ বছর পর মানেএএএএ ২০৭৯ – ২০৮০ সালে। অনেকটা লম্বা সময় জানি। তবে এখানে আসাটা কিন্তু মোটেই আমার হাতে নেই, সবটাই এই ধরিত্রী দিদির মর্জি । আজ আসি। অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। ভালো থেকো তোমরা, ধরিত্রীর যত্ন কোরো, তাঁকে ভালো রেখো। সায়োনারা, আলবিদা।
কৃতজ্ঞতা
এই লেখায় পরিবেশিত তথ্য সমূহ গুরুচন্ডালি পত্রিকায় পূর্ব প্রকাশিত দুটি নিবন্ধ –
১. শশাঙ্ক ও এক ক্ষণিকের অতিথি -সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৪
২. নতুন চাঁদ ও ডঃ নিকো ক্যাপ্পেল্লুটি -অক্টোবর ১৭ ,২০২৪
থেকে নেওয়া হয়েছে। আগ্রহী পাঠকেরা ঐ নিবন্ধ দুটি পড়ে দেখতে পারেন। ছবিগুলো বিভিন্ন প্রচলিত উৎস থেকে নেওয়া হয়েছে। এঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
নভেম্বর ২৩, ২০২৪.
রাত ১০-২০.
সায়োনারা 2024PT5। 2055এ ফিরে আসবে বলছো? তখন গায়ে গতরে একটু মাস লাগিয়ে এসো। এমন হালকা পাতলা চেহারা নিয়ে আমাদের চাঁদ মামার পাশে পাশে ঘোরাঘুরি করবে কী করে?
একদম নতুন ভাবনার লেখা। লেখককে অনেক ধন্যবাদ।
২০৫৫ নয় ,৫৫ বছর পর। মানে ২০৭৯ – ২০৮০ সালে। ততদিন প্রতীক্ষা জারি রাখতে হবে।
মিষ্টি কথায় কান মুলে দিয়ে গেল গ্রহাণু!🙏
আমাদের কান এখনও স্বস্থানে আছে?
খুব সুন্দর লেখা। এমন লেখা সত্যিই দুর্লভ। একটা কথা। সৃষ্টিতত্বের ইতিহাসে গ্রহাণু যেমন এক অনন্য উপাদান তেমনি সৃষ্টিতত্ববিদেরা গ্রহাণু কলোনিতে উঁকিঝুঁকি দিয়ে সবচেয়ে বেশি পাজলড হয়েছেন। তবে আমরা আশা করতেই পারি। এমন আরও লেখার জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই এমন মতামতের জন্য। প্রথম খবরটা দেখার পর থেকেই পিটি র পেছনে পড়েছিলাম। ভাবলাম ওর যাবার বেলাটাকেও একটু রাঙিয়ে দিই। পঞ্চান্ন বছর পর যখন আসবে তখন আমি কোথায়!!!!