গৌরহরিবাবুর সন্দেহটা কেমন গেঁড়ে বসলো মরে যাবার পর। ছেলেটা বিশ্ববখাটে, গাঁজা দিয়ে ব্রেকফাস্ট শুরু করে আর মদ গিলে ডিনার সারে। ছোটবেলায় পড়াশোনা করার জন্য চাপ দিতো গৌরহরি। ছেলে আঠারো পেরোবার পর বুঝলো এর দ্বারা পড়াশোনা হবেনা। কি কুক্ষণেই না বলেছিল “একটু খেলাধুলা করলে তো পারিস।” ছেলে তার পরপরই জুয়া খেলা ধরেছিল। পিতৃ আজ্ঞা পালনের জন্য রামচন্দ্রও এতো তৎপর হয়নি।
সে যাই হোক, মদের বঙ্গীয় সংস্করণ আছে -তার খরচ গৌরহরিবাবুর পকেটের ওপর ছোটখাটো শিল্পকর্মে উঠিয়ে ফেলছিল মদনা। কিন্তু জুয়া খেলায় মদনকুমার পুরো মেসি-মারাদোনা হয়ে উঠলো। প্রতিদিনই কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পর ঘরটা একটু বেশি পরিষ্কার লাগতো গৌরহরির। মদনের মা ধৃতরাষ্ট্রের মহিলা মডেল। ঘর থেকে জিনিসপত্র চুরি যাবার কথা কানেই তুলতো না। যেদিন শখ করে কেনা কালার টিভিটা গায়েব হলো সেদিন আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারেনি গৌরহরি। হচ্ছেটা কি? গৌরহরি মরে গেলে সবকিছুই তো মদনের। কথাটা বেশ জোর দিয়ে মদনের মাকে শুনিয়েছিল।
কথাটা শোনাবার পর গৌরহরির কেমন যেন আদর যত্ন বেড়ে গিয়েছিল। বাড়িতে দুশ্চিন্তাহীন শান্তির পরিবেশ থাকলে গৃহকর্তার শরীরে মিষ্টির আধিক্য থাকবে, রক্তের চাপ সমস্ত গন্ডি ছাড়িয়ে আনন্দে ঊর্ধমুখি হবে, হৃদয় উত্তেজনায় দু’চারটে স্পন্দন লাফিয়ে পেরিয়ে যাবে -এগুলো তো হবার কথা। সেগুলো বাগে রাখার জন্য গৌরহরিকে সারাদিন ধরে ওষুধ গিলতে হয়। তারপর থেকে মদনের মা ওষুধগুলো হাতের কাছে এগিয়ে দিচ্ছিল। সেদিন সকালে মদনের মায়ের বদলে মদনই ওষুধটা এগিয়ে দেয় ওকে। অফিস যাওয়ার তাড়া ছিল বলে খুব একটা খেয়াল না করে ওষুধটা খেয়ে নিয়েছিল গৌরহরি। পাঁচমিনিট পরে কিরকম যেন বুকে ব্যথা শুরু হয়। এখান থেকে গল্পটা অদ্ভুত একটা মোচড় নেয়। গ্যাস ভেবে দুটো অ্যান্টাসিড খেয়েও যখন বুকের ব্যাথার আরাম পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন কাছাকাছির স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাবার কথা ভাবে গৌরহরি। মদন যেন আজ একটু অন্যরকম। সেই একটা রিকশা ডেকে আনে। দুজনে মিলে রিকশা করে যাবার সময় গৌরহরি বলেও বসে -“তুইও একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিস।” সকালবেলা গাঁজা না খেয়ে বাবাকে নিয়ে ডাক্তারখানা যাচ্ছে – এটা তো সুস্থ মদনের লক্ষণ নয়।
কিন্তু এইসব চিন্তাভাবনা বেশিক্ষণ চললো না। কমার্শিয়াল ব্রেকের মতো চিন্তাভাবনা বন্ধ করে অজ্ঞান হয়ে গেল গৌরহরি। জ্ঞান ফিরলো বুকের ওপর দাপাদাপিতে। একটা ডাক্তার প্রায় তার বুকের ওপর উঠে নাচানাচি করছে। গৌরহরি চোখ খুলতে ভদ্রলোক বেজায় খুশি। “বেঁচে আছে, বেঁচে আছে -এক্ষুনি পাঠিয়ে দাও” বলে নৃত্যনাট্য জুড়ে দিলো। মাঝখান থেকে নাটক দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয়। গৌরহরি বুঝে উঠতে পারছিল না যে বেঁচে থাকার সঙ্গে পাঠিয়ে দেবার সম্বন্ধটা কোথায়। যে সময়টায় গৌরহরি অজ্ঞান ছিল সেই সময়টায় বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। যাঁরা এখনো পর্যন্ত লেখাটা পড়ে আসছেন তাঁদের উদ্দেশ্যে জানানো যাক যে অজ্ঞান অবস্থায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে আসা হয় গৌরহরিকে। সেখানে সঙ্গে সঙ্গে একটা ইসিজি করানো হয়। ইসিজি করার সময় হঠাৎ করে গৌরহরির হার্ট কাজ করবে না বলে বেঁকে বসে। ইসিজির স্ট্রেট লাইন দেখার পর মদন “ডাক্তার বাবাকে মেরে ফেললো গো” বলে একটা হুংকার ছাড়ে। আর ডাক্তার ইসিজির সমস্ত লিড খুলে ফেলে কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দিতে শুরু করে।
একটা ছোটো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগী মৃত্যু এবং তার পরবর্তী শিহরণ জাগানো থ্রিলার আগেও দেখেছে এই ডাক্তারবাবু। বিশেষ করে মদনের মতো পার্টি রাজনৈতিক পার্টির মতো বিপজ্জনক। সুতরাং গৌরহরি বেঁচে উঠতে তাকে পত্রপাঠ জেলা হাসপাতালে রেফার করা হয়।
এরপরে সজ্ঞানে দুটো কথা গৌরহরির কানে আসে। রেফার করার সময় ডাক্তার আনমনে বলছিল যে ভুল ওষুধে এরকম হতে পারে, আর বেশিক্ষণ বাঁচবে না। একেবারে ধন্বন্তরি ডাক্তার। অ্যাম্বুলেন্সে ওঠার সাথে সাথে গৌরহরি বুঝতে পারে যে সে মরেছে। আরও নিশ্চিত হয় অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার ওর দিকে তাকিয়ে মুখে চুকচুক আওয়াজ করায়। মদন ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসে। বেশ নিশ্চিন্ত দেখায় ওকে। তবে কি মদনাই মারলো ওকে? মৃত গৌরহরি ছটপট করছিল। দুবার মদনকে প্রশ্ন করার পর বুঝতে পারে ওর কথা কেউ শুনতে পাচ্ছে না। কিন্তু এই সন্দেহ নিয়ে মরেও সুখ নেই। তাই সুখ বিহীন ভাবে নিজের মৃতদেহের পাশে বসে বায়বীয় গালে হাত দিয়ে মদন ও ড্রাইভার মুহিদুলের কথাবার্তা শুনছিল গৌরহরি। মুহিদুল বলে ‘ডেডবডি নিয়ে গেলে ওখানে পোস্টমর্টেম করাবে।’
মদন পোস্টমর্টেম মানে জানতো না। মুহিদুল ওর মতো করে বোঝায়- ‘ঝপ করে পেট কাটবে, আর পেট কাটলেই মরার কারণটা বোঝা যাবে। আসলে মানুষের পেটে পেটেই তো শয়তানি লুকিয়ে থাকে।”
গৌরহরি একটু আতঙ্কিত হয়। সত্যিই পেট কাটলে সব গোপন কথা বেরিয়ে পড়ে নাকি? বেশ কিছু আপত্তিকর ঘটনা গৌরহরিরও করা আছে। সেইসব কথা কাউকে জানানো যায় নাকি? এখন গৌরহরির চিন্তাভাবনার মধ্যে ঢুকলে আরেকটা বটতলা মার্কা চটি বইয়ের গল্পে উঁকি মারতে হবে। সেটা ভালো বাজারচলতি লেখকদের জন্য তুলে রাখা থাক। আমরা বরং মুহিদুলের কথাগুলো বিশ্লেষণ করি। স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে জেলা হাসপাতালে আসতে আধঘন্টা লাগে। এই সময়টুকুর মধ্যে মুহিদুল মদন এবং পেছনে বসা মদনের বাপের আত্মাকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে পোস্টমর্টেম করলে ঠিক কি কারণে মরেছে সেটাই শুধু বোঝা যায়।
গৌরহরি বেশ আশান্বিত হয়। তাহলে মাকড়াটা ওকে মেরেছে কিনা বোঝা যাবে। যদি তাই হয় তাহলে একটা ফুটো কড়িও মদনাকে ঠেকাবে না ও। পোস্টমর্টেমের জন্য মুখিয়ে বসে থাকে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর।
কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে ঢোকার পর আরেক হাঙ্গামা। গেটের সিকিউরিটি গার্ড একটা মেয়ে ছিল। গেটের সামনে ট্রলি নেই কেন এই অযুহাতে মদন তাকে ধাক্কা মারে। সিকিউরিটির আরও দুটো ছেলে মেয়েটার এই অবস্থা দেখে মদনের সঙ্গে প্রথমে তর্কাতর্কি এবং পরে অনিবার্য ভাবে ফ্রিস্টাইল কুস্তিতে নেমে পড়ে। গৌরহরির আত্মা পেছনে দাঁড়িয়েছিল। মদনের ধান্দা বুঝতে পেরে তর্কাতর্কির সময়ই বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল। গৌরহরি জীবদ্দশাতেই মদনকে সামলাতে পারেনি আর এখন তো মরে ভূত হয়ে গেছে। এরমধ্যে দুটি বাইরের ছেলে ঢুকে পড়ে। মদনের পক্ষ নিয়ে তারাও হম্বিতম্বি জুড়ে দেয়। এখন একা মদন নয়, রীতিমত যুযুধান দুই পক্ষে গন্ডগোল লেগে যায়। হাওয়ায় কান পেতে গৌরহরি বুঝতে পারে যে এরা দুজন সাংবাদিক। হাসপাতালের গেটের সামনে ট্রলি থাকবেনা কেন এই নিয়ে খবর রান্না করছে। এরমধ্যে একজন মোবাইলে ঘটনার ভিডিও রেকর্ডিং করতে শুরু করে।
গৌরহরি হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অ্যাম্বুলেন্সে ফিরে যায়। তার ডেডবডির পাশের বেডটাই তো ট্রলি। কি সর্বনাশ! অ্যাম্বুলেন্সে তো স্ট্রেচার থাকে! মুহিদুলকে সেই কথা বলার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখে যে সে তখন সাংবাদিক ছেলেটার সঙ্গে কথা বলছে। পরিস্কার গলায় মুহিদুলকে জানিয়ে দিচ্ছে রোগীকে যেন ওখান থেকে বার না করা হয়।
ঘন্টাদুয়েক গৌরহরির ভীষণ টেনশনে কাটে। একবার হাসপাতালের এমারজেন্সিতে ঢুকে দেখে একজন ডাক্তার পেশেন্ট দেখছে। রবিবার। ভিড়ভাট্টা কিন্তু কম নয়। তার মধ্যেই গৌরহরির দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বলে “বাইরের গন্ডগোলটা কমলো?” গৌরহরি আহ্লাদে আটখানা। ডাক্তার তাহলে তার আত্মাকে দেখতে পাচ্ছে। গদগদ হয়ে বলে “বাইরে একবার চলুন স্যার। আমার পেট কাটলেই বিষটা পেয়ে যাবেন।” গৌরহরির ভেতর থেকে একটা মেয়ে বলে “একদম বেরোবেন না ডাক্তারবাবু। এর মধ্যে মিডিয়া ঢুকে গেছে। মিডিয়া ছুঁলে আঠারো ঘা।” গৌরহরি খেয়াল করে দেখে যে সে এতোক্ষণ একটা মেয়ের গায়ের ওপর দাঁড়িয়েছিল। ‘সরি’ বলে দুপা পিছিয়ে দাঁড়ায় ও।
দু’ঘন্টার মাথায় ডাক্তার নার্সকে বলে “ঠিক পাঁচমিনিটের মধ্যে আমি ফিরে আসবো। এরমধ্যে খারাপ রোগী ঢুকলে একটা ফোন করবেন সিস্টার।” গৌরহরি ডাক্তারের পেছন পেছন অ্যাম্বুলেন্সে যায়। ডাক্তার গৌরহরির দেহের পালসে হাত রাখে। বুকেও স্টেথোস্কোপ ছুঁইয়ে বলে যে সে মারা গেছে। “পোস্টমর্টেম করলে জানা যাবে কতক্ষণ আগে মারা গেছে। মৃত্যুর কারণটাও বোঝা যাবে। আর ব্রট ডেড যখন নিয়ম অনুযায়ী আমরা পোস্টমর্টেম করতে বাধ্য।”
ঘিরে থাকা জনগণের মধ্য থেকে একটা গুঞ্জন ওঠে। গৌরহরি চিৎকার করে বলে “পোস্টমর্টেম করান ডাক্তারবাবু। এরা পোস্টমর্টেম করতে দেবে না। কারণ কখন আমি মরেছি সেটা জানা গেলে সাংবাদিকদের খবর কেঁচে যাবে। আর কেন আমি মরেছি সেটা নির্ঘাত মদন জানতে দেবে না।”
মদন ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে। “না, আমরা পোস্টমর্টেম করবোনা। ওনাদের একজন চেনা ডাক্তার আছে, সে সার্টিফিকেট দিয়ে দেবে।”
ভিড়টা আস্তে আস্তে হালকা হয়ে আসে। এখন সামনে থেকে পেছনে এসে বসেছে মদন। পাশে একজন সাংবাদিক। তার চেনাজানা একজন আয়ুর্বেদিক ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট দেবে। কথা হয়ে গেছে। ছেলেটি মোবাইল খুলে মদনকে একটা খবরের চ্যানেল দেখাচ্ছে। “আবার সরকারি হাসপাতালে অমানবিকতা। ট্রলির অভাবে অ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যু রোগীর। রোগীর আত্মীয়কে মারধর।”
অ্যাম্বুলেন্স গড়াতে শুরু করে। গৌরহরি নিজের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলে।
সাংবাদিকটি মদনকে বলে “ইসস্, তোমার বাবার চোখে এখনো জল লেগে রয়েছে। মারা যাবার সময় বেশ কষ্ট পেয়েছিলেন ভদ্রলোক।”
এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এগিয়ে চলে।
সময় মতো post mortem হয় না বলে অনেক সত্যিই জানা যায় না
Ha😊
খুব ভালো লাগলো
❤️😊🙏
দারুণ হয়েছে।👍
😊😊😊❤️❤️❤️
রোজনামচা
😁😁😁❤️❤️❤️❤️
সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে কথার জাদু সম্বলিত একটি লেখা।
দারুণ, দারুণ লাগল, অনির্বাণ।
🙏🙏🙏❤️❤️❤️