ফি ফি আইল্যান্ড থেকে যখন দুপুরের খাওয়ার খেয়ে বেরিয়ে আসছি, তখনই ঘটলো বিপত্তি। সফরসঙ্গী বাংলাদেশী ভদ্রলোক হঠাৎই যন্ত্রণায় পা ধরে বসে পড়লেন ফি ফি ডনের বিস্তীর্ণ ধবধবে সাদা বালির ওপর। একই স্পীড বোটে এসেছি। তার উপর এই দূরদেশে বাংলা ভাষায় কথা বলে এই বিদেশী ভদ্রলোক তখন আমাদের কাছে অতি পরম আত্মীয় হয়ে উঠেছেন। তাই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই দৌড়ে গেলাম। কি হয়েছে? ভদ্রলোক ডান পায়ের বুড়ো আঙুল থেকে হাত খানা সরাতেই দেখলাম, বেশ লাল হয়ে ফুলে আছে জায়গাটা। প্রথম মেটাটারসোফ্যালাঞ্জিয়াল জয়েন্টে একটু চাপ দিতেই যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। আমি পায়ের পাতা দেখার জন্য চেষ্টা করতেই উনি বললেন– না না পায়ে কিছু ফোটে নি। গতকাল থেকেই ব্যথাটা শুরু হয়েছে। আজ সকালেও খানিক ছিলো কিন্তু এখন দেখছি বড্ড বাড়াবাডি। কোনো রকম আঘাত লাগেনি। শুনতে শুনতেই উনার হাত গুলো টেনে নিয়ে কবজি ও আঙ্গুলের কিছু জায়গায় চাপ দিতে বললেন, ব্যথা আছে।
এরপর সন্দেহের দৃষ্টিতে উনার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কাল রাতে কি খেয়েছিলেন?
এ প্রশ্নের উত্তরে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উনার সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী সংকোচ কাটিয়ে ঝরঝরে বাংলায় বলতে শুরু করলেন- গেল মাসে বিয়ের পরেই এখানে আসার টিকিট করেছিলাম। সেই থেকে এখানকার খাবারে রপ্ত হতে মাঝেমধ্যেই সামুদ্রিক স্কুইড, টুনা, স্যালমন খুঁজে খুঁজে বাড়ি আনছিলো। এমনিতে মাস ছয়েক আগে পিত্তথলির পাথর অপারেশন হয়েছে। তারপর এসব খাওয়া কি ঠিক বলুন তো? গতকাল সারাদিন রেড মিট আর স্কুইড দিয়ে বিয়ার খেয়েছেন। বারন করলেও শোনেন নি।
আমার এক প্রশ্নের উত্তরে এত্ত লম্বা উত্তর শুনে উনার বাঙালিয়ানা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রইলো না।
হাতব্যাগ হাতড়ে একখান অ্যাসিক্লোফেনাক ও ডেফ্লাজাকোর্ট সহযোগে অ্যান্টাসিড দিয়ে বললাম, খেয়ে নিন।
পরিচয়ের ফাঁকে চিকিৎসক বলে আগেই পরিচয় দিয়েছিলাম। তাই কোনো রকম সন্দেহ না করে তৎক্ষণাৎ ওষুধগুলো খেয়ে নিলেন উনি।
এরপর আমাদের বোট থেকে ডাক এলো। কিছুটা খুঁড়িয়েই বোটে উঠলেন উনি। বরফ দিয়ে চেপে রাখতে বললাম জায়গাটা।
এরপর মাংকি দ্বীপ হয়ে, ভাইকিং কেভ ঘুরে ছোট্ট ‘খাই‘ আইল্যান্ডে পৌঁছালাম আমরা। ভদ্রলোকের মুখে ততক্ষণে হাসি ফুটেছে। স্ত্রীর হাত ধরে নির্দ্বিধায় হাঁটছেন অপরূপ সৌন্দর্য ঘেরা সমুদ্রের কিনারা ধরে।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পড়ন্ত বিকেলের অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে ওপর পানে তাকিয়ে একটু হারিয়ে যেতে না যেতেই ভদ্রমহিলার হঠাৎ ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম।
একখানা ডাব হাতে ধরিয়ে বললেন– কি বলে যে ধন্যবাদ দেবো।এই বিদেশ বিভূঁইয়ে আপনি না থাকলে যে কি হতো !
মহার্ঘ্য ডাবে চুমুক দিয়ে বললাম, চিকিৎসার এখনও কিছুই হয়নি। মনে হয় অতিরিক্ত সামুদ্রিক খাবার, রেড মিট, মাংসের মেটে, অ্যালকোহল খাওয়ার জন্য শরীরে পিউরিনের আধিক্যে ইউরিক অ্যাসিড বেড়েছে। এর কনাগুলি জয়েন্ট স্পেসে জমে গিয়ে প্রদাহের কারণে গাউট বা গেঁটে বাত তৈরী হয়ে এই বিপত্তি। আপাতত এই ওষুধগুলো আরও দিন দুয়েক চলার পর বাড়ি ফিরে রক্তের ইউরিক অ্যাসিড টেস্ট করে নিতে হবে। সেই অনু্যায়ী নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে চিকিৎসা হলে তবেই সুস্থতা।এছাড়াও অতিরিক্ত পিউরিন সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
এরপর ফুকেট ঘুরে ফিরে এসেছি দিন পনেরো হলো। ভদ্রলোক রিপোর্ট করেছেন। মুঠোফোনে সে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন গতকালই। ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা ছয়ের গন্ডি পেরিয়ে নয় ছুঁয়েছে। ওখানে চিকিৎসকের পরামর্শে ফেবুক্সাস্ট্যাট শুরু করেছেন। বারে বারে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। সাথে বাংলাদেশ এলে সপরিবারে উনাদের বাড়ি যাওয়ার আমন্ত্রন জানাতেও ভোলেন নি।