ডা নন্দ ঘোষের চেম্বারের পাশেই সাধনের চা দোকান। সকাল থেকেই তার দোকানে চা-বুভুক্ষুরা ভিড় জমান। এলাচ দিয়ে ঘন দুধের চা-ই হোক কিংবা লেবু বা মশলা চা.. সাধনের হাতে জাদু আছে। চা-টা ব্যাটা একঘর বানায়। এলাকায় সাধনের গুণগ্রাহীর সংখ্যা অগুনতি। কেবল একটাই দুঃখ, পঁচিশ না পেরোতেই বেচারার মাথার অর্ধেক চুল টা টা বাই বাই করে চলে গিয়েছে। শুধু পেছনের দিকে কিছু চুল ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব কেশাগ্র’ ইত্যাদি বলে দাঁতে দাঁত চিপে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এমত সাধন কেশলক্ষ্মী বড়ির বিজ্ঞাপন দেখে যেন স্বর্গ হাতে পেল। দশদিন খেলেই নতুন চুল গজাতে শুরু করবে.. একমাসে ঘন কালো একঢাল চুল.. নির্জন রাস্তা.. বাইক.. সপ্তপদী.. রিনা ব্রাউন.. উফ!!
ডা. ঘোষ সন্ধেবেলা সাধনের দোকানে চা খেতে যান। ডাক্তারবাবুকে দেখেই সাধন উশখুশ করতে শুরু করলো। ওষুধ কেনার আগে একবার স্যারকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে। আগেরবার ট্রেন থেকে দাদ-হাজার ওষুধ কিনে যা ভুগেছিল.. গোটা গায়ে চুলকুনি হয়ে গেছিল। শেষে প্রায় ছ’মাস ডাক্তারবাবুর কাছে চিকিৎসা করিয়ে ভালো হয়। একটু ইতস্তত করে সাধন ডাক্তারবাবুর কাছে কথাটা পেড়েই ফেললো..- স্যার, একটা কথা বলবো?
– বলবি ভেবেছিস যখন বলেই ফেল। নইলে আবার পেটে কথার গ্যাস জমে ভুটভুট করবে..
সাধন হেসে ফেলে। – বলছি স্যার, এই কেশলক্ষ্মী বড়ি খেলে কেমন চুল গজায় দেখুন..
– ও তাই? কীভাবে বুঝলি?
– এই তো ছবি দিয়েছে দেখুন। আগে.. পরে..
– সে তো দেখতেই পাচ্ছি। দুটো ছবি যে একই লোকের কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছিস? তাছাড়া এডিট করে এসব একটু আধটু চুলটুল বসিয়ে দেওয়া কয়েক সেকেন্ডের কাজ।
– কিন্তু স্যার..
– আচ্ছা নে। তোর কথাই মেনে নিলাম। ছবি দুটো একই লোকের। কিন্তু ওই ওষুধ খেয়েই চুল গজিয়েছে তার প্রমাণ কী?
– ছবিতে তো সেরকমই দেখাচ্ছে..
– কাক গেল আর বেল পড়ল। তা বলে কি কাকের আসাটাই বেল পড়ার কারণ? হয়তো এমনিতেই চুল গজাতো। কিংবা ধর, কেশলক্ষ্মী বড়ির পাশাপাশি অন্য কোনও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা চলছিল। রোগ আর চিকিৎসার পুরো ইতিহাস না জেনে এসব বলা যায় নাকি?
– টাকে চুল নিজে থেকে গজায় নাকি?
– অনেক সময়েই গজায়। টেলোজেন ইফ্লুভিয়াম বলে একটা রোগে হয়। তাছাড়া কিছু এলোপেসিয়া এরিয়েটা কিংবা স্ক্যাল্পে সংক্রমণ..
– বড্ড কঠিন হয়ে যাচ্ছে স্যার। একটু সহজ করে বলুন..
– শোন, তোকে তাহলে ওষুধ-বিজ্ঞানের গোড়ার কথাগুলো বলি। বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে তোলার প্রাথমিক শর্ত হ’ল সন্দেহ করা। চোখ-কান বুজে কোনো কিছু মেনে নিবি না। একটা কথা আছে, “যেটা মন জানে না, সেটা চোখ দেখে না।” অর্থাৎ তুই যদি কারও ওপরে অন্ধবিশ্বাস রাখিস তাহলে তার খারাপ দিকগুলো তুই দেখতেই পাবি না। তোর মনে হবে তার সবটাই ভালো। এসব অন্ধবিশ্বাস ওষুধের ক্ষেত্রে হলে মুশকিল। ওষুধ বিজ্ঞানে কোনও একটা ওষুধ প্রয়োগে রোগ সারে কিনা তা বোঝার জন্য ‘ডাবল ব্লাইন্ড র্যান্ডোমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল’ করা হয়।
সাধন মাথা চুলকোতে শুরু করেছিল। ডা. ঘোষ অল্প হেসে বলতে শুরু করলেন..- বুঝেছি, বুঝেছি। মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে দেওয়ালে দাগ হয়েছে। ‘ধৈর্য ধর ওরে বৎস ক্ষণকাল..’
– আর এক ভাঁড় চা দিই স্যার? ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে..
– দিবি? আচ্ছা দে.. চায়ে না বলতে নেই। যাক গে, যেটা বলছিলাম.. পরীক্ষার আসল উদ্দেশ্য হ’ল- কারো ব্যক্তিগত মনে হওয়া যাতে পরীক্ষার ফলাফলে প্রভাব না ফেলে। যেমন ধর, একই ফুল দেখে তোর মনে হ’ল তাজা, আমার মনে হ’ল বাসি।
– সেটা আবার কীভাবে বোঝা যাবে?
– যাবে, যাবে। ধর, ১০০ জন রোগীকে দু’ভাগ করে নেওয়া হ’ল। কারো ইচ্ছে অনুসারে নয়। ‘র্যান্ডম’ বা এলোমেলো ভাবে যেভাবে তাস দু’দিকে ভাগ করে দেওয়া হয় ঠিক সেভাবে। তারপর দু’দলের মধ্যে এক দলকে ওষুধ দেওয়া হল আর এক দল ওষুধের মতো দেখতে চিনির দানা বা ওই জাতীয় অন্য কোনও মিছিমিছি ওষুধ (প্লাসিবো) খেল। অর্থাৎ, ওষুধ খাওয়া দলের সাথে বয়স, শারীরিক ক্ষমতা বা অন্যান্য দিক দিয়ে সমতুল্য একটি ‘কন্ট্রোল’ নেওয়া হ’ল। অথচ রোগী বা পরীক্ষক কেউ জানলেন না কোন দল আসল ওষুধ খেয়েছে। তার মানে পরীক্ষার্থী এবং পরীক্ষক দুজনেই ফলাফলের ব্যাপারে অন্ধ বা ‘ডাবল ব্লাইন্ড’। পরীক্ষক ফলাফল নথিভুক্ত করবেন এবং সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিকভাবে সে ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা হবে। যদি ওষুধ-পক্ষ নিশ্চিতভাবে প্লাসিবো-পক্ষের থেকে ভালো করে তবেই বোঝা যাবে সত্যিই ওষুধে কাজ হয়েছে।
– তার মানে, যতক্ষণ না এরকম পরীক্ষা হচ্ছে ততক্ষণ কোনও ডাক্তারেরও নিজের মনে হওয়ার কোনও দাম নেই?
– সাব্বাশ! একদম ঠিক ধরেছিস। বিজ্ঞানের কাছে কারো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কোনও মূল্য নেই। কারণ চোখ ততটাই দেখে যতটা কেউ দেখতে চায়। অনেক রোগই এমনি এমনি সেরে যায়। তোর বিজ্ঞানমনস্কতা না থাকলে প্লাসিবো চিনির দানাকেই মহার্ঘ্য ওষুধ মনে হবে।
– হ্যাঁ.. তাই তো..
– এজন্যেই নতুন ওষুধ তৈরি অনেক দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপার। আগে সাইড এফেক্টের ব্যাপারে নিশ্চিত হত হয়। তারপর প্রথমে অল্প, পরে বৃহৎ সংখ্যক রোগীর ওপর ওষুধ পরীক্ষা করে দেখা হয়। ওষুধের ডোজ কত হবে, আগের ওষুধের চেয়ে এই ওষুধ বেশি কার্যকরী কিনা সেসব বুঝতে হয়। বাজারজাত হওয়ার পরেও নিয়মিত নজর রাখা হয়। বুঝলি? ‘আগে-পরে’ ছবি দিয়ে বিজ্ঞানের ‘ব’ টুকুও শেখা যায় না।
– আপনি না বললে আর আমাদের কে বোঝাবে বলুন? আমরা সাধারণ লোক, সহজেই এসব বিশ্বাস করে ফেলি..
– আরও একটা ব্যাপার। ‘আগে’ আর ‘পরে’র মাঝের সময়টাও বুঝতে হবে। অর্থাৎ, শুধু কাজ করে বললেই হবে না। সে ওরকম ভাবে অনেকের মতে তাবিজ, মাদুলি বা আংটির পাথরও কাজ করে। কীভাবে কাজ করে তার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিতে হবে। একটি রাসায়নিককে ‘ওষুধ’ হয়ে উঠতে গেলে তার সম্পূর্ণ কার্যপ্রণালী, শরীরে গিয়ে তার পরিপাক ও বিক্রিয়া থেকে শুরু করে নিষ্ক্রমণ অব্দি প্রতিটি ধাপ বিস্তারিতভাবে জানতে হবে। নইলে দাবী আর বিশ্বাসের সাথে বিজ্ঞানের তফাৎ থাকে না।
– অর্থাৎ, কেশলক্ষ্মী কিনে গ্যাঁটের লক্ষ্মী খরচ করে লাভ নেই। তাই তো স্যার?
ডা. ঘোষ হেসে ফেলেন– আপাতত তোর মাথার খুশকিগুলো দূর কর। চুল পড়ে যাওয়ার বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা আছে। এমনিতেও তোর ব্যক্তিত্ব শুধু চুলের ঘনত্ব দিয়ে বিচার হয় না। তুই এই যে এত সুন্দর চা বানাস.. মিষ্টি করে কথা বলিস.. এই গুণগুলোও তোর সৌন্দর্য, তোর ব্যক্তিত্ব।
সাধন ডাক্তারবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকে। ডা. ঘোষ ব্যাগটা বেঞ্চ থেকে কাঁধে তুলে নেন..- উঠি রে.. রাত হ’ল। আর শোন, টাকমাথা কয়েকজন বিখ্যাত মানুষের নাম জেনে আসিস। কাল ধরবো..