শরতের শেষে খুব অল্প দিনের জন্য কুয়াশায় মোড়া হেমন্ত আসে। পাখীর পালকের মত হাল্কা, পাতা ঝরার দিনগুলো দ্রুত শেষ হয়ে যায়। এসে যায় দুঃসহ শীত।
এরকম এক হেমন্তের সকালে চা-জলখাবার খেয়ে হোষ্টেলের বারান্দায় হাল্কা রোদে পিঠ দিয়ে কম্যুনিটি মেডিসিন পড়ছি। কম্যুনিটি মেডিসিনের তখন ছিল একটাই বই-‘পার্ক এ্যান্ড পার্ক’। ডাক্তারী ছাত্র মাত্রই জানেন, সে অতি বিষম বস্তু। হোষ্টেলে কারো অনিদ্রা রোগ হলে তাকে ‘পার্ক এ্যান্ড পার্ক’ পড়ার নিদান দেওয়া হত। সামনেই পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট এন্ট্রান্স পরীক্ষা। লোকে বলে নাকি জগতের কঠিনতম পরীক্ষা। রোদে বসে পড়ছি, বা বলা ভালো ঝিমোচ্ছি- এমন সময় একটা ফোন এলো। তখন হাতে হাতে ফোনের এত রমরমা ছিল না। একটাই ভারী কালো তারওলা টেলিফোন, শালগ্রাম শিলার মত বারান্দার মাঝখানে অধিষ্ঠিত। ফোনটা এল এবং গোটা হোষ্টেলে হইচই, দৌড়োদৌড়ি শুরু হল। মেন হোষ্টেলে কোন ছাত্র নাকি ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়েছে। পাঁচ তলা থেকে পড়লে বাঁচার সম্ভাবনা কম, কিন্তু এখনো বেঁচে আছে। এমার্জেন্সি বিভাগে নিয়ে গেছে। তারপর কানাঘুষোয় শুনলাম ও নাকি আমাদের হেমন্ত। পাজামার উপর হাতের কাছে পাওয়া শার্ট গলিয়ে নিয়ে, কার একটা হাওয়াই চপ্পল পরে দৌড়লাম। ইডেন বিল্ডিং থেকে নেমেই দেখি নিউরোসার্জেন ডাঃ অঞ্জন ভট্টাচার্য্য। বিধান সরণীর বাড়ি থেকে রোজকার মত হেঁটে কুমার্স ক্যান্টিনে চা খেয়ে ডিপার্টমেন্টের দিকে চলেছেন। স্যারের ইন্টার্ন ছিলাম। চিনতেন। স্পাইন নিয়ে আমার ইন্টারেস্ট ছিল বলে আরো।
‘কি হয়েছে রে? কোথায় দৌড়চ্ছিস?’
‘একজন ষ্টুডেন্ট মেন হোষ্টেলের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়েছে। শিগগির চলুন স্যার।’ আমার মন বলল নিউরোসার্জেনকে এক্ষুনি দরকার হবে।
‘চল।’ উনিই আমায় টানতে টানতে নিয়ে চললেন।
অত্যন্ত ছাত্রদরদী ছিলেন।
‘ছিলেন’, কারন এই ঘটনার বছর খানেক পরেই ঘুমের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বছর চল্লিশেক বয়সে পরপারে চলে যান তিনি।
ক্যাজুয়ালটি ব্লক লোকে লোকারণ্য। অঞ্জন ভট্টাচার্য্য স্যারের সাথেই দোতলায় উঠলাম। হেমন্ত রক্তাক্ত, অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে। স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ। এসব ক্ষেত্রে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে চোট লাগতে পারে। মাথায়, এবং বিশেষতঃ ঘাড়ে চোট লাগলে শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। গলায় টিউব লাগিয়ে অ্যানাস্থেশিয়া মেশিন দিয়ে কৃত্রিম ভাবে শ্বাস চালু রাখা হয়েছে। কিছু সময় এভাবে চলতে পারে। কিন্তু বেশীক্ষন এভাবে রাখা যাবে না। মেডিক্যাল কলেজে তখন কার্ডিওথোরাসিক ছাড়া কোথাও আই টি ইউ নেই। ভেন্টিলেটর তো দূর অস্ত। সিটি স্ক্যান বা এম আর আই মেশিনও নেই। দুটোই তক্ষুণি দরকার।
তাই প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ঠিক হল যে, হেমন্তকে পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। শেষ চেষ্টা। কিন্তু যাবে কিভাবে? অ্যানাস্থেশিয়া মেশিন তো আর নিয়ে যাওয়া যাবে না!
কেউ কেউ বলল, একটু খানি তো পথ। অ্যাম্বু ব্যাগ টিপতে টিপতে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস জারি রেখে নিয়ে মেতে হবে। কিন্তু এই ঝুঁকি কে নেবে? মাঝরাস্তায় শ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অঞ্জন স্যার আমার দিকে তাকালেন। আমার মন বলল, ‘দেখিই না একবার, যা হওয়ার হবে। একটা চেষ্টা তো করি’। কাছেই ছিল দ্বৈপায়ন । ওকে বললাম, ‘চল যাই’।
দুজনে বসলাম অ্যাম্বুলেন্সে। হেমন্ত-র মাথা আমার কোলের কাছে। আমার হাতে অ্যাম্বুব্যাগ। অ্যানাস্থেটিষ্ট দাদা যেভাবে দেখিয়ে দিয়েছে, সেভাবে প্রাণপণে টিপে চলেছি। গ্রীন করিডোর ছিল না তখন। দ্বৈপায়ন ন্যাভিগেটর হয়ে কয়েক মিনিটে পৌঁছে দিয়েছিল পিজি হাসপাতালে। হেমন্তকে আই সি ইউ-তে ভর্তি করে ফিরে এলাম। আই সি ইউ-এর ডাক্তার বাবু গম্ভীর। বললেন, ‘আশা বিশেষ নেই’। ভাবলাম,’তবু যদি মিরাকল্ হয়’।
হেমন্ত ডাক্তারি পড়তে এসেছিল সুন্দরবনের গহীন গ্রাম থেকে। হতদরিদ্র ঘরের চুড়ান্ত মেধাবী ছাত্র। নরেন্দ্রপুরে বিনা পয়সায় পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু নেই নেই করেও ডাক্তারি পড়ার খরচ অনেক। সেই নিয়ে অনেক টেনশন ছিল ওর। পড়া শেষ করতে পারবে কি না ইত্যাদি। সেই টেনশন ও হতাশায় কি এরকম করল? না কি অন্য কোনো কারণ। কেউ কেউ বলেছিল, কয়েক দিন জ্বরে ভুগছিল। তখন খুব ফ্যালসিপেরামের যুগ। ফ্যালসিপেরাম ম্যালারিয়া হয়েছিল ওর। কুইনাইন খাচ্ছিল। কুইনাইনে খুব সাইকোসিস হয়। তাতেই কি?
বাস্তবে, আসলে কখনো মিরাকল্ হয় না। বিকেলে খবর এলো হেমন্ত মারা গেছে। আমরা দল বেঁধে মেন হোষ্টেলে গেলাম। ওর বাড়ি থেকে বাবা- কাকা এসেছে। মা মূহুর্মূহু অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। বাবা-কাকা খালি পায়ে, গ্রাম্য মানুষ। জুতো পর্যন্ত পরেনি কোনো দিন। জলের মাছকে ডাঙ্গায় তুললে তেমন হয়, সেরকম অবস্থা। তাদের নিয়ে আমরা ক’জন আবার ছুটলাম পিজি-তে।
কিন্তু হেমন্ত ততক্ষণে মর্গের ঠান্ডা ঘরে। বাড়ির লোকেরা শেষবারের মত একবার দেখতে চায়। কিন্তু অত রাতে মর্গ কর্তৃপক্ষ, হাসপাতাল সুপার কাউকে অনুরোধ করেও মর্গের দরজা খোলানো গেল না। আমরা তিন-চার বন্ধু হতাশ হয়ে ধর্ণা দিলাম লোকাল থানায়। ভবানীপুর থানার তৎকালীন ওসি ছিল অত্যন্ত অভদ্র, অসভ্য ও অনুভূতিহীন। আমরা প্রায় হাতে-পায়ে ধরেছিলাম একবার হেমন্তকে দেখাবার জন্য। কনস্টেবল দিয়ে কুকুরের মত বের করে দিয়েছিল আমাদের।
ভাবলাম, শেষ চেষ্টা করে দেখি। থানার সামনের পিসিও বুথ থেকে ফোন করলাম মেডিক্যাল কলেজের ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডাঃ অপূর্ব নন্দীকে। স্যার আমাকে খুব পছন্দ করতেন। আর ফরেন্সিক-এর ডাক্তারদের পুলিশ ভীষণ ভয় পায়। স্যার বললেন, ‘তোমরা আবার ওসি-র কাছে যাও। আমি ফোন করে দিচ্ছি।’ আবার ওসি-র ঘরে ঢুকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। রাত বারোটা বাজতে চলেছে। ‘কি ব্যাপার, তোমাদের চলে যেতে বললাম না?’ বলতে না বলতেই ফোন এল। ‘হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার’ বলে ওসি তো প্রায় গলে বেরিয়ে যায় আর কি!
‘না না, ওনাদের তো আমি বলেছি ব্যবস্থা করে দেব’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ স্যার, এক্ষুণি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’
ফোনটা রেখে আমাদের দিকে তাকিয়ে ওসি বলল, ‘আপনারা বলবেন তো যে ডাঃ নন্দীর ছাত্র! গাড়ি করে চলে যান, মর্গ খুলে দেবে।’
পুলিশের গাড়িতে হেমন্ত-র বাবা এবং কাকাকে পিজি হাসপাতালের মর্গে নিয়ে গিয়ে হেমন্তর দেহ দেখানো হল। তারপর তাদের সামলে হোষ্টেলে ফিরতে ফিরতে রাত তিনটে। রাত শেষ হয়ে আসছে। ঘুম আর আসবে না আজ। বড় যন্ত্রণা বুকে। এক কাপ করে কফি বানিয়ে তিনজনে ছাদে গিয়ে বসলাম। শীতের সকাল আসছে। হেমন্ত চলে গেছে।
প্রতি মুহূর্তে মরতে মরতে বেঁচে থাকা । হতাশার ওষুধ খেয়ে বেঁচে থাকা – যদি হেমন্ত হতে পারতাম । হয়তো সুখী হতাম ।
It seems like a true tale. As if I got to see the whole thing which is very painful at a glance. Very precise but truly penetrating, a well told story of a student of Medical Science.
না পড়লেই ভালো হতো। প্রত্যেক চিকিৎসকেরই ছাত্র জীবনে হেমন্তের মতো বন্ধু থাকে। যার আর ডাক্তার হওয়া হয়না।
প্রিয় চিন্ময়, শেষ বসন্তের এক বিষন্ন সকালে তোমার লেখা পড়ে না জানি কখন চোখের জলে চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে গেল। অতি কঠিন বাস্তব। একটু আশার গল্প শোনাও না গো।তোমার লেখা পড়ে বোঝা যায় যে লেখার হাত খুব ভালো। অপেক্ষা করছি । মিরাকল তো আজ ও হয়!
Like!! I blog quite often and I genuinely thank you for your information. The article has truly peaked my interest.
Thank you ever so for you article post.
Thanks so much for the blog post.
Your site is very helpful. Many thanks for sharing!