‘জয় শ্রীরাম—’, ‘আল্লাহো আকবর—’, ‘হর হর মহাদেও—’, ‘নারায়ে তাকবীর—’ মুহুর্মুহু রণহঙ্কার, পাল্টা রণহুঙ্কার, তার সাথে ক্রমাগত গুলি ও বোমার শব্দ। ভয়ার্ত মানুষের চিৎকার, নারী-শিশুদের আর্তনাদ। খুন, জখম, ধর্ষণ, লুঠ, বাস্তুচ্যুতি। এর সাথে ঘরবাড়ি, গোয়াল, গোলা, বাস-ট্রেন, সরকারি সম্পত্তি পোড়ানোর লেলিহান শিখা রাতের আকাশকে লাল করে দেয়। একদা শান্তির নীড় সবুজে মোড়া এই প্রাচীন বর্ধিষ্ণু জনপদ উপর্যুপরি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। একটি দাঙ্গার ক্ষত শুকোতে না শুকোতে শুরু হয় আরেকটি। আর বছরভর চলতে থাকে নানারকম গুজব, প্ররোচনা, ঘৃণার দ্বেষ। দক্ষিণের এক রাজ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পরে প্রবেশ এবং তার উপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে চলল টানটান উত্তেজনা। কায়দা করে এক ধর্মীয় রীতি নিয়ে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা সংবাদমাধ্যম ও অন্তর্জালের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হল সারা দেশে। তার ফলশ্রুতিতে অন্য অনেক জায়গার মত এখানেও ঘটে গেল রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। অথচ সেদিন অবধি এখানকার নারীরা ঘরে বাইরে পুরুষের সাথে সমানতালে কৃষিকাজ সহ যাবতীয় কায়িকশ্রমের কাজ করতেন। এছাড়া হাঁস-মুরগী প্রতিপালন, যাবতীয় ঘর-গৃহস্থালী ও রান্নার কাজ এবং সন্তান জন্ম দেওয়া থেকে সামলানো ও তাদের বড় করার কাজে তারা সবসময় এত ব্যস্ত থাকতেন যে হিন্দু নারীর না ছিল পর্দা ও ঘোমটার বালাই আর মুসলমান নারীর হিজাব ও বোরখা পরার ফুরসত মিলত না। নারীর শিক্ষার হার ছিল যথেষ্ট ভাল এবং একের পর এক কৃষক ও প্রগতিশীল আন্দোলন সমাজের দৃষ্টিকোণকে আধুনিক করে তুলেছিল। বিগত বেশ কয়েকবছর ধরে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মদতে এমন সব অপ্রীতিকর ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড চলল যে বহুমানুষ স্বজনহারা ও ঘরবাড়ি ছাড়া। কিছু মানুষ যারা কোনরকমে ঘরবাড়িতে টিকে রইলেন তাদের প্রতিযোগিতা শুরু হল কে কত বড় হিন্দু বা মুসলমান সেটি প্রমাণ করার। যারা উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিলেন সেখানেও তাদের হিন্দু ও মুসলমান পৃথক শিবিরে ভাগ করা হল এবং তার মধ্যেও সম্মান হারানো নারীকে করে তোলা হল ঘোমটা-পর্দা ও হিজাব-বোরখার অভ্যন্তরে অন্তরীণ।
(২)
এখানকার কৃষির যেমন খ্যাতি ছিল, শিক্ষা-সংস্কৃতির সুনামও দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এখানকার অনেক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি, বেশ কিছু বিজ্ঞানী-শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি—চিত্রশিল্পী–চলচ্চিত্র পরিচালক–অর্থনীতিবিদ দেশ বিদেশের মঞ্চ আলো ঝলমলে করে রেখেছিলেন। শিক্ষার মান ছিল উন্নত। এখানে এতদিন ধর্মপ্রাণ মানুষের চাইতে কর্মপ্রাণ মানুষের সংখ্যা বেশি ছিল, যাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন নিরীশ্বরবাদী। এখানকার নারীরাও ছিলেন শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে। জাতীয়তাবাদী অহিংস গণআন্দোলন আর বিপ্লবী সহিংস সন্ত্রাসবাদ—স্বাধীনতা সংগ্রামের দুটি ধারার পীঠস্থানই ছিল এই অঞ্চল। আবার দাঙ্গা-দেশভাগের সময় অন্যান্য অঞ্চল যখন ছিল রক্তাক্ত, হিন্দু-মুসলমান মিলিত প্রতিরোধে এই অঞ্চল ছিল শান্ত। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ডিরেক্ট অ্যাকশনের পরিবর্তে এখানকার মুসলমান কৃষকরা দলিত-রাজবংশী, নমশূদ্র এবং আদিবাসী সাঁওতাল-ওরাঁও কৃষক, তার সাথে মদেশিয়া চা শ্রমিক ও নেপালি রেল শ্রমিকদের সাথে তেভাগার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পর পাঁচটি দশক এভাবে কেটে গেলেও পরের দুটি দশক সেভাবে কাটল না। মনুষ্যসৃষ্ট প্রবল পরিবেশ দূষণ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে নদীগুলি শুকিয়ে গেল, জলস্তর নেমে গেল অনেক নিচে। ভুল কৃষি ও শিল্পনীতি, নোংরা ভোটের রাজনীতি এবং সব কিছু থেকে লোভী নেতাদের উঞ্ছবৃত্তি একদা সম্পদশালী এই রাজ্য ও অঞ্চলকে মরুভূমিতে পরিণত করল। তার উপর পাশের দেশ ও রাজ্যগুলির দারিদ্র, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংখ্যালঘু নিপীড়ন এই রাজ্য ও অঞ্চলের ঘাড়ে বিশাল মানুষের বোঝা চাপালো। কারখানা থেকে চা বাগান সব বন্ধ। কাজ নেই, আয় নেই। গ্রামগুলি উজাড় করে মেয়ে মরদ ভিন্ রাজ্যে ফুরনের কাজে চলে যেতে লাগলেন। কাজ ও বিয়ে দেওয়ার নাম করে কত যুবতী, কিশোরী ও বালিকার যে বিভিন্ন শহরের গণিকালয়ে ও ধনীদের খামারবাড়িতে স্থান হল তার হিসাব নেই। ধান পার্টির স্বেচ্ছাচার হটিয়ে মানুষ লাশ পার্টিকে ক্ষমতায় আনলেও কাজের কাজ কিছু হল না। এরা রাজ্যের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বারোটা বাজিয়ে দিল। এদের নেতারা চুরি-কাট-সিণ্ডিকেট-প্রোমোটারি করে নিজেদের রসেবশে রাখলেও সাধারণ মানুষ দেউলিয়া হয়ে গেলেন। এরপর তারা ভোটে লাশ পার্টিকে হারিয়ে এক লড়াকু তরুণ তুর্কী নেতার তৈরি ঘাস পার্টিকে নিয়ে এলেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে অচিরেই সেই নেতা, তার পরিবার ও সাঙ্গোপাঙ্গোরা অসততার প্রতিমূর্তি হয়ে উঠে সব কিছু লুটেপুটে খেতে লাগলেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গণপরিবহন, সংস্কৃতির যা ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট ছিল এরা তাদের কফিনে শেষ পেরেকটুকুও ঠুকে দিলেন। অন্যায়, অত্যাচার, তোলাবাজি, লুঠ, অপরাধ, হিংসার এক নৈরাজ্য তৈরি হল। দারিদ্র, বেকারত্ব, কালোবাজারি, চোরাচালান, প্রতারণা, মাদকের নেশা, অবসাদ, অপঘাতে মৃত্যু প্রভৃতি সামাজিক ক্লেদগুলি বেড়ে চলল। অসহায় মানুষ হতাশায় ধর্মচর্চা, কুসংস্কার, পুজো-পার্বণ, অর্থহীন সব আচার-অনুষ্ঠানে নিজেদের ভাসিয়ে দিলেন।
(৩)
এই সুযোগে উঠে এল দুটি দল—রামপার্টি আর আল আকবর। মানুষকে ঠিকমত পানীয় জল, খাদ্য, পোশাক, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, উপার্জনের সুযোগ না দিতে পারলেও ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় উৎসব, যাগযজ্ঞ, পুজো-পার্বণ, আজান-নামাজের বাড়বাড়ন্ত শুরু হল। খাদ্যে ও ওষুধে ভেজাল মেশানো এবং ফাটকা ও দু নম্বরি ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করা গুজরাতি-মারোয়ারি কালোয়ারদের আর্থিক অনুদানে গড়ে উঠতে লাগল একের পর এক বড় বড় মন্দির, অনুষ্ঠিত হয়ে চলল অষ্টপ্রহর কান ঝালাপালা করে দেওয়া সব ধর্মীয় সমাবেশ। অন্যদিকে সৌদি আরবের তেলের টাকা অনুদানে তৈরি হয়ে চলল ঝা চকচকে বিশাল সব মসজিদ আর ইদগা। তার সাথে উলেমা-মৌলবীদের জড়ো করে বছরভর তাক লাগানো সব ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং মাইকে সেগুলির সম্প্রচার। প্রথমরা রাজ্যের সমৃদ্ধিশীল ভাষা ও বিশ্ববরেণ্য সংস্কৃতিকে পঙ্গু করে চাপিয়ে দিল হিন্দি ভাষা এবং হিন্দুত্ববাদী হিন্দুস্থানী সংস্কৃতি। দ্বিতীয়রা মাদ্রাসা-মোক্তবের মাধ্যমে শিশু বয়স থেকে আরবি-বেদুইন ভাষা, পোশাক ও সংস্কৃতি। নারী সমাজকে অবগুণ্ঠনে মুড়ে অন্তঃপুরে ঠেলে দেওয়া হল। অর্ধেক আকাশ গেল শুকিয়ে। ওরা হালাল নিষিদ্ধ করল তো এরা ঝটকা। এরা হাঁস পোষা বন্ধ করল তো ওরা মুরগী। ওরা পশ্চিমদিকে ফিরে কিছু করতে নিষেধ করল তো ওরা পূবদিক ফিরে। এভাবে একই অঞ্চলের অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যশালী একই জাতিকে কায়মনোবাক্যে আড়াআড়ি হিন্দুস্থানী ও আরবী জাতির নকলে পরিণত করা হল। এর সাথে বিভিন্নভাবে চলতে লাগল সাম্প্রদায়িক বিষ ঢালা ও পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণা তৈরি করা। তাতে অত্যন্ত সহায় হল টেলিভিশনের কেনা চ্যানেলগুলি আর ইন্টারনেট।
একটি পর্যায়ে সৌহার্দ্য পর্যবসিত হল সন্দেহে। তারপর সন্দেহ গড়াল বিদ্বেষে। বিদ্বেষ পরিণত হল অসহিষ্ণুতায়। অসহিষ্ণুতা শেষমেষ পৌঁছল সঙ্ঘর্ষে। রাম পার্টি আর আল আকবর তলে তলে প্রস্তুত হচ্ছিল। মজুত করে রেখেছিল গোলাগুলি, বোমা বারুদের স্তুপ। তাদের ঘাতক বাহিনী এবার অতর্কিতে অপর সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বহু মানুষের মৃত্যু হল, আহত হলেন আরও বেশি। মহিলাদের উপর ধর্ষণ ও নির্যাতন চলল। অনেক মানুষ পিতৃপুরুষের ভিটে হারিয়ে ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিলেন। কত যে পরিবার ধ্বংস হল! কত যে শিশু অনাথ হল! গভীর ও স্থায়ী ক্ষত নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ পরস্পরের বিরুদ্ধে যাবতীয় দোষারোপ, ক্রোধ আর জিঘাংসা নিয়ে পরবর্তী আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।
বিগত কয়েক বছর পরপর দাঙ্গা হয়ে একদা সুফলা সমৃদ্ধ এই অঞ্চল এখন অনাবাদী মৃতবৎসা। ঘাস পার্টি সরকারের সামান্য, তাও অনিয়মিত, ক্ষয়রাতি এবং রাম পার্টি ও আল আকবরের দুই সর্বোচ্চ নেতা প্রমোদ ঝুনঝুনওয়ালা আর আব্বাস মির্জার ধর্মীয়-সামাজিক সংস্থাগুলির কিছু সাহায্যের উপর এখন মানুষ নির্ভরশীল। প্রমোদ ও আব্বাস সভা-সমিতি-টেলিভিসনের পর্দায় বিরুদ্ধ দলের মুণ্ডপাত ও অপর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। আসলে দুজনের গলায় গলায় ভাব। বিদেশে গরু মোষের মাংসের রপ্তানির বিশাল ব্যবসার দুজনে অংশীদার। মোষের মাংস রপ্তানির ব্যবসা বৈধ, কিন্তু গরুরটি অবৈধ। তাই পাশের রাষ্ট্রে পাচার করে ওখান থেকে পাঠানো হয়। এছাড়াও বৈধ ও অবৈধ তাদের বহুরকম ব্যবসার কথা শোনা যায়। যার মধ্যে মাদক, মানব ও মানব অঙ্গ পাচার, অবৈধ খনি প্রভৃতি নিয়ে আড়ালে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে বলার কারো সাহস নেই। যে কজন সাংবাদিক এই বিষয়গুলি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন ভাগাড়ে তাদের থেতলানো মৃতদেহ পাওয়া গেছিল।
বেশ কয়েকবছর ধরে রমরমা ধর্ম ও রাজনীতির ব্যবসাতেও তারা অংশীদার। দুজনেই মাননীয় সাংসদ। অন্যদিকে দাঙ্গা, অশান্তি, নোংরা রাজনীতি, নিরাপত্তাহীনতা, কর্মসংস্থানের অভাব ইত্যাদি কারণে একদা জনবহুল এই রাজ্য ও অঞ্চল থেকে দলে দলে মানুষ অন্যরাজ্যে নিতান্ত দিনমজুরের কাজ নিয়ে পালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু সকলেই তো পারেন না। তাছাড়া এই লাশ-ঘাস-রাম-আল আকবরের নাগপাশ কাটিয়ে বেরোনোও প্রায় অসাধ্য। অগত্যা তারা দম দেওয়া পুতুলের মত এদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সমাবেশেগুলিতে উপস্থিত হন, নেতা নেত্রীর জয়ধ্বনি করেন, এদের নির্দেশমত ভোট দেন। বাকি সময় এদের অনুগ্রহপুষ্ট সামান্য ডোল নিয়ে ধুকতে ধুকতে কালাতিপাত করেন। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক থেকে এরা এখন নেতা, পার্টি ও সরকার নির্ভর অধিকার হারানো উপভোক্তায় পরিণত হয়েছেন।
(৪)
দাঙ্গার দপদপানি ও আগুন কমে এলেও সমগ্র জনপদে এখনও পরিবেশ স্বাভাবিক হয়নি। পোড়া বাড়িঘর থেকে এখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ধানক্ষেত, নয়ানজুলি, পচা ডোবা, বাঁশ বাগান কোথাও না কোথাও থেকে প্রতিদিন পাওয়া যাচ্ছে ক্ষতবিক্ষত লাশ। বিকৃত, বীভৎস, দুর্গন্ধময়। সশস্ত্র আধা সামরিক বাহিনী এনে রুট মার্চ ও মাইকিং করা হলেও মানুষ পারতপক্ষে ঘরের বাইরে বেরোচ্ছেন না। বিক্রিবাট্টা না হলে যাদের সংসার চলবে না সেই ছোট দোকানদাররা দোকানের শাটার অর্ধেক খুলে বসে আছেন যাতে আবার গোলমাল লাগলে দোকান বন্ধ করে দেওয়া যায়। যাদের দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বা লুঠ হয়ে গেছে অথবা দাঙ্গাকারীদের অস্ত্র যাদের পরলোকে পাঠিয়ে দিয়েছে তাদের অবশ্য সেই সুযোগ নেই। অন্যদিকে কাজে না বেরোলে যাদের পেট চলবে না সেই দিন মজুরদের বেরোতেই হয়েছে। এর বাইরে হাতে গোনা কয়েকজন বেরিয়েছেন বিপদে পড়ে। হয় ঘরে চাল, আটা, নুন বা ওষুধ ফুরিয়ে গেছে, নইলে বাড়ির কারো রোগ বেড়ে যাওয়ায় ডাক্তারের কাছে ছুটতে হচ্ছে। অনুরাধাদেরও তেমনি অবস্থা। ঘরে খাবার মত কিছু অবশিষ্ট নেই। দাঙ্গার কবল থেকে তাদের পাড়াটি কোনক্রমে বাঁচলেও ঐ ভয়ঙ্কর দিনগুলি থেকে সমস্ত নাগরিক পরিষেবা বন্ধ।
অনুরাধাদের অবস্থা এখন পড়তির দিকে। স্কুল শিক্ষক বাবার রোজগারে এবং নিজস্ব বাড়ি থাকার সুবাদে একসময় ওদের ছোট সুখী মধ্যবিত্ত সংসার ভালভাবে চলে যেত। ও ছিল একমাত্র সন্তান, খুব যত্নে মানুষ। পড়াশুনায় খুব ভালো, দেখতেও সুন্দর। স্বভাবও ছিল শান্ত ও ভদ্র। ওকে নিয়ে বাবা-মা, আত্মীয় ও পড়শিদের খুব গর্ব আর আশা ছিল। স্কুলের পরীক্ষায় বরাবর ভালো ফল হত। মাধ্যমিকেও খুব ভালো ফল হল। দূরে না দিয়ে কাছের সদর শহরের একদা নামী জেলার সবচাইতে ভালো কলেজে ওকে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি করা হল। এর পাশাপাশি চলল জয়েন্টের প্রস্তুতি। গঞ্জের মধ্যে স্কুলে সাইকেলে যাতায়াত করত। কলেজ থেকে প্রাইভেট বাসে কুড়ি মিনিটের মত জার্নি করতে হত। মধ্যবিত্ত পরিবারের ভালো দেখতে যুবতী মেয়েদের যা হয়। তারা তো আর এসি লাগানো কাচ ঢাকা দামী গাড়িতে সান্ত্রী পাহারায় যাতায়াত করতে পারে না। ক্লাশ সেভেন-এইট থেকে ছেলে ছোকরারা পিছনে লেগে যায়। বিরক্ত করতে থাকে। রাস্তাঘাটে বাসে-ট্রেনে-অটোতে বাবা-জ্যাঠার বয়সী লোকগুলি পর্য্যন্ত অসভ্যতা করে। অনুরাধার ক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। কলেজে ভর্তির পর এই অত্যাচার বেড়ে গেল। আর পাঁচটি সাধারণ বাড়ির দুর্ভাগা মেয়েদের মত অনুরাধাও সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে ও এড়িয়ে চলে দিন কাটাচ্ছিল। কিন্তু অসহনীয় হয়ে উঠল বাপী চাটুজ্যের আচরণ।
বাপী কুখ্যাত কোপাই চাটুজ্যের সুপুত্র। কোপাই একসময় কুপিয়ে বহু নকশাল ছেলেকে মেরেছিল তাই এই নামকরণ। তার আসল নাম সবাই ভুলে গেছে। সেই সময়কার ক্ষমতাসীন ধানপার্টির ছত্রছায়ায় তার দাপুটে গুণ্ডা বাহিনীর রমরমা আর বিস্তার। পরে লাশ পার্টি ক্ষমতায় এলে সেদিকে ভিড়ে গেল। বাহুবলে ভোটে জেতার অন্যতম সহায় হয়ে অচিরেই নেতাদের নয়নের মণি হয়ে উঠল। আর সেই সুযোগে করে নিল বিপুল সম্পত্তি। তার সথে ঠিকাদারি, ইমারতি, প্রমোটিং, হোটেল, পরিবহন, মদ প্রভৃতির অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। ক্রমশ হয়ে উঠল অতি ধনী ও প্রভাবশালী। নিজে জনপ্রতিনিধি হওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না নেমেই হয়ে গেল বেশ কিছু সাংসদ ও বিধায়কের ভাগ্যনিয়ন্তা। পরে আবার যখন লাশ পার্টিকে হটিয়ে ঘাস পার্টি ক্ষমতায় এল তখন ঘাস পার্টিতে যোগ দিল। বয়স ও অসুস্থতার কারণে রাজনীতি থেকে কিছুটা গুটিয়ে ব্যবসা নিয়ে থাকল। ততদিনে ওর জেষ্ঠ্যপুত্র বাপী ঘাস পার্টির তাজা যুব নেতা হিসাবে নাম করতে শুরু করেছে।
বাপী অনুরাধাদের কলেজ ইউনিয়নের ক্রান্তি পরিষদের নেতা। কলেজে নাম লেখানো থাকলেও ক্লাশ করে না। শুধু দাদাগিরি করে। ভর্তির সময় তোলা তোলে। ছাত্র নির্বাচনের সময় হুজ্জুতি করে। এর সাথে নেশা আর নিত্যনতুন নারীসঙ্গ। বাপী অনুরাধার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এত বিরক্ত করতে শুরু করেছিল যে ওর কলেজে আসা বন্ধ হওয়ার জোগাড়। কয়েকদিন না এসে পরীক্ষার ফর্ম ফিলআপের আগের দিন অনুরাধা কলেজে এসেছিল। বেপরোয়া বাপী তক্কে তক্কে ছিল। অনুরাধা কলেজ থেকে বেরিয়ে বাস স্টপের দিকে যাওয়ার সময় বাপী কয়েকজন সাকরেদকে নিয়ে জোর করে ওকে একটি এস.ইউ.ভি.তে তোলার চেষ্টা করে। অনুরাধা কোনরকমে ওদের নাগাল ছাড়িয়ে ছুটে আবার কলেজের মধ্যে ঢুকে যায়। প্রত্যাখ্যাত উদ্ধত ক্ষিপ্ত বাপী ওর গলায় একটি ছুরি চালিয়ে দেয়। রক্তারক্তি অবস্থা। হাসপাতাল, পুলিশ। ছুরির ফলাটা ভাগ্যিস ওর গলার ধার ঘেষে গভীর আঁচড় কেটে বেরিয়ে যায়। প্রচুর রক্তপাত ও চিরস্থায়ী দাগ হলেও অনুরাধা প্রাণে বেঁচে যায়। ঘটনাটি প্রকাশ্য দিবালোকে সবার ও সিসি টিভির সামনে হওয়ায় এবং উক্ত অঞ্চলে আলোড়ন তোলায় বাপী কিছুটা বিপাকে পড়ে যায়। কিছুদিন জেল খাটার পর কোপাই চাটুজ্যে অনেক টাকা ঢেলে ও প্রভাব খাটিয়ে বাপীকে বের করে আনে। এরপর বাপী একটি সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড করে। অনুরাধা আরেকদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাপীর লোকেরা ওর মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে দেয়।
এই ঘটনাটি অনুরাধার জীবনটাই পালটে দেয়। অনেক মাস পর যখন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরে তখন আয়নায় নিজের কুৎসিত মুখ দেখে আঁতকে ওঠে। আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিল। কিন্তু বয়স্ক বাবা-মাকে কে দেখবে চিন্তা করে পেছিয়ে আসে। অনুরাধার জীবনে আর না হল উচ্চশিক্ষা-চাকরি, না হল বিয়ে-সংসার। এইরকম একটি ভয়ঙ্কর ঘটনার অভিঘাতে, তার সাথে চিকিৎসা খরচ, আইন-আদালতে দৌড়াদৌড়ি ও খরচ, বাপীর কেস তোলার হুমকি, পার্টির চাপ—সব মিলিয়ে এই সুন্দর পরিবারটি দুমড়ে মুচড়ে গেল। প্রত্যক্ষ কোন প্রমাণ নেই তাই বাপীকে কিছু করাও গেল না। তবে বিরোধী দলের সাথে সঙ্ঘর্ষে তাদের দুই কর্মী খুনের কেসে বাপী আরো কয়েকজনের সাথে কয়েক বছরের জন্য জেলে গেল। বাপীর অত্যাচার সাময়িক বন্ধ হলেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উপদ্রব শুরু হল।
অনুরাধার উপর অ্যাসিড আক্রমণের পর থেকে ওর উৎসাহী অঙ্ক শিক্ষক বাবা পুলিশ, প্রশাসন, আদালতে প্রচুর দৌড়ঝাঁপ করলেও ভেতরে ভেতরে একদম ভেঙ্গে পড়েছিলেন। স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। সারাক্ষণ গুমরে থাকতেন। সুগার ও প্রেসার ধরা পড়ল। মা হয়ে গেলেন মানসিক রোগী। এক সময়কার এক আনন্দময় স্বচ্ছল পরিবার ক্রমশ ক্ষয় পেতে পেতে খুঁড়িয়ে দিন কাটাতে লাগল। আর সেই পরিবারের উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতিবান তরুণীটি বিধ্বংসী সামাজিক ক্ষত বয়ে কোনরকমে এক প্রান্তিক জীবন কাটাতে লাগল। এর মধ্যেও সেইই পরিবারের একমাত্র ভরসা। বাবা ও মা খুবই অসুস্থ। সঞ্চয় প্রায় শেষ। সম্বল বলতে বাবার পেনশনটুকু। অন্যের অপরাধে নিজের মুখ ঢেকে দোকান-বাজার-ব্যাঙ্ক-পোষ্ট অফিস-ওষুধের দোকান যে টুকু না করলেই নয় অনুরাধাকেই করতে হয়। দক্ষিণের এক রাজ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পরা নিয়ে বিতর্কে এই অঞ্চলে দাঙ্গা চলল বেশ কদিন ধরে। সাঙ্ঘাতিক পরিস্থিতি। ওদের পাড়াটি এ যাত্রায় রেহাই পেলেও কয়েকদিন কোথাও বেরোনো সম্ভব হয় নি। ওদিকে ঘরে চাল, আটা, নুন সবই ফুরনোর পথে। তাই শাড়ির আঁচল পেচিয়ে মাথা ও মুখ ঢেকে আজ বাধ্য হয়ে ওকে বাড়ির বাইরে বেরোতে হয়েছে।
(৫)
কার্ফু শিথিল হতেই বটতলার মোড়ে বাঁধানো চাতালের ঠেকে বাপী চাটুজ্যে তার দলবল নিয়ে হৈ চৈ করছে। পাশে রাখা অনেকগুলি বাইক। সে এখন সমগ্র অঞ্চলের অপরাধী চক্রের পাণ্ডা এবং সাধারণের কাছে ত্রাস। জেলের মধ্যে থেকে বাইরে বিভিন্ন অপরাধ সংগঠিত করে দাঙ্গার আগে রাম পার্টির সুপারি নিয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর যথারীতি তাণ্ডব চালায়। ওর এখন প্রচুর সম্পত্তি, অনেক আস্তানা। তবুও বটতলার পুরোনো ঠেকটিকে ভুলতে পারে না। সময় পেলেই সাঙ্গোপাঙ্গ দেহরক্ষীদের সঙ্গে নিয়ে চলে আসে। রঙ্গ তামাশা, আড্ডা, তার সাথে খবরাখবর নেওয়া, লোকজন বিশেষ করে মেয়েদের মাপা। ভালো দেখতে কোন যুবতী মেয়ে দেখলেই তাকে দখল নেওয়া। বাপীর সিণ্ডিকেটের সঙ্গে এই তল্লাটের আর কোন গ্যাং পেরে ওঠেনা। দাঙ্গা, ভোট করানো, টেণ্ডার ও সম্পত্তি দখল, ঠিকাদারি-প্রমোটরি-ইমারতি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ বাপীর একচেটিয়া। সাথে রয়েছে ঘাস আর রাম পার্টির বরাভয়। তাই পুলিশ প্রশাসন কিছুই বলে না। দাঙ্গা-হাঙ্গামার পর পরবর্তী অ্যাকশনের আগে ওরা কিছুটা রিল্যাক্সড মুডে আছে। নানারকম ফূর্তিফার্তার পরিকল্পনা করছে। খবর পেয়েছে রাজধানীতে কয়েকজন বিস্ফোরক রুশ নর্তকী এসেছেন। এখানে ওদের প্রমোদজীর রিসর্টে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে।
ভয়ার্ত চোখে সঙ্কুচিতভাবে ও সন্তর্পণে অনুরাধা চলেছে বাড়ির জন্য কিছু খাবার জোগাড় করতে। রাস্তাঘাট এখনও শুনশান, কোন যানবাহন চোখে পড়ে না, দু-একটি পথচারী, বেশিরভাগ ঘরের দরজা জানালা বন্ধ। রাস্তার পাশে পাশে অনেক জায়গায় পোড়া জিনিসপত্রের ছাই এবং অর্ধদগ্ধ গাড়ি ইত্যাদি পড়ে আছে। এলাকা জুড়ে এখনও প্রবল আতঙ্ক রয়েছে। প্রায়ই খবর আসছে এখানে সেখানে পড়ে আছে পোড়া অথবা গুলিবিদ্ধ বা ছুরিবিদ্ধ লাশ কিংবা ধর্ষিতা ছিন্নভিন্ন নারীর মৃতদেহ। ওদের পাড়াসহ সমগ্র এলাকায় কোন দোকান এখনও খোলেনি। অগত্যা ভীতসন্ত্রস্ত হলেও ও একটু দূরে কদমতলা বাজারের দিকে এগিয়ে চলল। বড় বাজার, নিশ্চয় কোন না কোন দোকান খোলা থাকবে। বাড়ির যা অবস্থা কিছু খাবার জোগাড় না করলেই নয়। চৌপথির কাছে এসে খেয়াল করল এর মধ্যেও বটতলার চাতালে কিছু যুবকের জটলা। ও তাড়াতাড়ি শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢাকা মাথা ও মুখের জায়গাটি টানটান করে নিল। তারপর রাস্তার একদম অন্যসাইড দিয়ে চৌপথি পেরোচ্ছিল। কিন্তু ঐ মার্কা মারা সমাজবিরোধী দাঙ্গাকারীদের চোখে পড়ে গেল। শুরু হল ওকে নিয়ে অশালীন সব আলোচনা, অশ্লীল সব কটূক্তি।
‘‘এই মালটা আবার এই সময়ে কোথা থেকে এল?’’ ‘‘…মাগীর সতীপনা দেখেছিস কাপড় দিয়ে পুরো মুখ ঢেকে রেখেছে।’’ কয়েকজন ‘হো হো’ করে হেসে উঠল। বাপী একজন খোচরের সাথে কথা বলছিল। এবার ও এদিকে তাকাল। পরক্ষণেই গর্জে উঠল, ‘‘শালা—, হিজাব নিয়ে এত কিচাইন, তারপরেও… মাগীটা হিজাব পড়েছে। ধরে নিয়ে আয় ঐ … মারানীটাকে। ওর হিজাব, কাপড় সব খুলে ওকে ভালো করে…দিতে হবে।’’ যেমন নির্দ্দেশ তেমন কাজ। কয়েকজন দুষ্কৃতী ওকে টেনে হিঁচড়ে বাপীর কাছে নিয়ে আসছিল। অনুরাধা সাধ্যমত বাধা দিচ্ছিল আর কাঁদছিল, ‘আপনারা ছেড়ে দিন আমাকে, ছেড়ে দিন।’’ অসহায় নারীর দুরবস্থায় দুঃশাসনকূল আরও উল্লসিত হয়ে ওকে দুহাত ধরা অবস্থায় বাপীর সামনে এনে হাজির করল। বাপী এবার বলিউডের ঝাম্পু সিনেমার ভিলেনের মত উঠে দাঁড়াল। ‘‘…বাচ্চার এত সাহস?’’ বলেই একটানে মাথা ও মুখ ঢাকা শাড়ির আঁচলটি ছিঁড়ে দিল। ওর একদম সামনে অ্যাসিড আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত চূড়ান্ত কদর্য এক নারীর মুখ যার গলায় গভীর ক্ষতের দাগ। বাপী ওয়াক করে উঠল। পরক্ষণেই টলতে টলতে চাতালে বসে পড়ে বমি করতে লাগল। সাকরেদরা হৈ হৈ করে উঠল। সমাজের দগদগে ক্ষত নিয়ে এক অপাপবিদ্ধ নারী রাক্ষসদের ভিড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
অক্টোবর ২০২৩