একটি দীর্ঘ প্রোডাকশন
বিধিসম্মত সতর্কীকরণ ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর ।
শুভারম্ভম
কিছুদিন আগে আমাদের হাতুড়ে পড়ে গিয়ে ডান হাতের কব্জিতে আঘাত পেয়েছেন। ওনার তরলপ্রীতির কারণে জনগণের ধারণা কিছুটা অন্যরকম- তবে আসলে কমজোরি মেরুদন্ডের কারণে উনি মাঝে মাঝে ভারসাম্য হারিয়ে ফ্যালেন। বহু মানুষের মেরুদন্ডই কমজোরি তাই এটা খুব উল্লেখ্য নয়।
যাইহোক পাড়ার বাড়িগুলোর পাঁচিল ধরে ধরে ক্যামেলিয়া সিনেনসিস পান করতে বিমলবাবুর দোকানে যাচ্ছিলেন। একটা বাড়িতে বেশ ভালো শব্দ যন্ত্রে একটা গান বাজছিল– যার লাগি ফিরি একা একা আঁখি পিপাসিত নাহি দেখা, তারই বাণী ওগো তারই বাণী…. । হঠাৎ আকাশে থমকিয়ে গ্যালো মেঘ। কতো দিন পরে সকালে কারো বাড়ি থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে পেলেন।
বিমলবাবুর দোকান আজ তুলনায় ফাঁকা। বিমলবাবু নিজের বসার প্ল্যাস্টিকের টুলটা বার করে বসতে দ্যান। হয়তো একেই বলে ভালবাসা ….অথবা করুণা। দশাননবাবু অন্য একটা টুলে বসেছিলেন। এগিয়ে এসে গরুড়পক্ষীর মতো জোড়হস্তে বললেন “একটা কতা বলার ছিলো ….. নিবেদন করবো?”
হাতুড়ে স্বভাবতঃই এই সব ভান ভণিতা পছন্দ করেন না। বাঁ হাত বাড়িয়ে চা নিয়ে গলা চাষনালার খাদে নামিয়ে বললেন “বলুন। নিবেদিত হোক”
“গতকাল বাড়িতে পেসারটা নাপিয়ে দেখলাম পেসার হেব্বি হাই” মুখখানা যথাসম্ভব কাঁচুমাচু করে বললেন “এ্যাকন কি আমাকে পেসারের ওষুদ খেতে হবে? শুনিচি এ্যাকবার পেসারের ওষুধ ধরলে আর…….?”
হাতুড়ে ফুসফুস ভরে পোড়া ডিজেলের ধোঁয়া টেনে ন্যান। একপাল ছেলে মেয়ে সরু রাস্তায় একগুচ্ছ রডোডেনড্রন ফুল ফুটিয়ে চলে যায়।
দশাননবাবু তাড়া দ্যান “কি হলো? আমার কি হবে?”
হাতুড়ে সরপড়া দুধচায়ে চুমুক দিয়ে বলেন “প্রেসার কে মেপেছে? কোন যন্ত্রে?”
দশানন উজ্জ্বল আননে বলেন “আমি নিজেই নেপেছি” তারপর সগর্বে যোগ করেন “ আমার বেটা ব্যাঙলোর থেকে গিফ্ট দিয়েছে”
হাতুড়ে পকেট হাৎড়িয়ে একটা সিগারেট আর দেশলাই বার করে দেশলাই কৌটোটা দশাননবাবুর দিকে এগিয়ে বললেন “মুখে আগুন দিয়ে দিন”
দশাননবাবুর সহসা রামজীর কথা মনে পড়ে গ্যালো “আরে সি সি কী যে বলেন সার….”
হাতুড়ে কব্জি দেখিয়ে বললেন “ব্যথা … টুলটা টেনে নিয়ে বসুন” দশাননবাবু বসলেন। “দশাননবাবু ব্লাড প্রেসার মাপার মূল নীতি টা জানেন?”
এর মধ্যে হঠাৎ নীতিকথা এসে পড়ায় উনি যৎপরনাস্তি বিরক্ত হয়ে বলেন “হাতে পেসার যন্ত্র বান্ধবেন তারপর ফুস ফুস ফুস ব্যস হয়ে গ্যালো। এর্মদ্যি নীতি আবার কোত্থেকে আসছে?”
হাতুড়ে ক্যামন একটা বিষাদবক্র হাসি হাসেন “সত্যি সত্যি আছে-নীতি নিয়ম পরিবেশ আর যন্ত্রের ক্ষমতার ব্যাপার আছে – তাহলে ধৈর্য ধরে শুনুন ……ও বিমলবাবু দুটো ছোটো চা দ্যান তো…”
বিমলবাবুর স্বগোতোক্তি করেন “বুড়ো পারেও বাবা বকতে – সবাইকে ডাক্তারি পড়াচ্ছে .. সাধে কি আর লোকে পাগলা হাতুড়ে বলে ….” একটা প্রশ্নচিহ্ন দিয়ে বিমলবাবু বক্তব্য শেষ করেন।
“শুনুন তাহলে” অক্লান্ত হাতুড়ে শুরু করেন “আমাদের শরীরে ধমনীরা হার্ট থেকে গোটা শরীরে রক্ত বহন করে”
ধমনী শুনে দশাননবাবুর চোখের মণি গোল গোল হয়ে যায়। হাতুড়ে ধমনী কথাটা বদলে দ্যান “আচ্ছা ঠিক আছে…. আর্টারি হার্ট থেকে রক্ত নিয়ে যায় আর ভেইন সেই রক্ত শরীরের সব জায়গা থেকেই ফেরৎ নিয়ে আসে… আর্টারিতে রক্তের চাপ মানে ব্লাড প্রেসার ভেইনের থেকে বেশী থাকে। কেননা হার্ট খুব ফোর্সে আর্টারিতে ব্লাড পাম্প করে দ্যায়। আর্টারিগুলো শরীরের অনেক ভেতর দিয়ে মানে ডীপ দিয়ে গ্যাছে আর ওপরে যেগুলো দ্যাখা যায় সেগুলো ভেইন ….” হাতুড়ে ওনার ময়লা কালো কুষ্ঠি হুডির ভেতর থেকে শিরা ওঠা হাত বার করে দেখিয়ে দ্যান। উপস্থিত মানুষজন দেখে সন্তুষ্ট হলে ফের বলতে আরম্ভ করেন। “এইসব আর্টারিতে যে ব্লাড যায় সেটার চাপ ইয়ে প্রেসার মাপা হয়। একটা কাপড় জড়িয়ে নিয়ে সেটাকে এ্যাত্তো পাম্প করা হয় যে ওই হাওয়া ভরা কাপড়ের চাপে আর্টারিতে ব্লাড যাওয়াই বন্ধ হয়ে যায়। তখন স্টেথোস্কোপ ঐ আর্টারির ঠিক ওপরে বসিয়ে একটু একটু করে হাওয়া ছাড়া হয়। কমাতে কমাতে যখন একটা বিশেষ প্রেসারে এসে পৌঁছোবে যেখানে আর্টারির সরু একটা ফাঁক দিয়ে সামান্য ব্লাড খুব স্পিডে যেতে পারবে তখন হার্টবিটের মতোন একটা শব্দ স্টেথোস্কোপে শোনা যাবে। তারপর যখন ঐ হাওয়া ভরা কাপড়ের হাওয়া অনেক কমে যাবে তখন আর শব্দ শোনা যাবে না”
বিমলবাবু দশাসই দশাননবাবু দুজনেই যুগপৎ যুগলবন্দী জোড়েন “বোঝা গ্যালো না বোঝা গ্যালো না বোঝা গ্যালো না”
হাতুড়ে শীতের সকালে ঘেমে ওঠেন। পকেট থেকে প্যাকেট বার করেন। বিমলবাবু লাইটার জ্বালিয়ে ধরেন। ধূম্রজাল ত্যাগ করে ধূম্রলোচন হাতুড়ে বলতে থাকেন “আমি বহু বছর আগে একবার কেদারনাথ গিয়েছিলাম। পায়ে হেঁটে নামতে দেরী হয়ে গেল তখন চন্দ্রপুরি বলে একটা জায়গায় মন্দাকিনি নদীর এ্যাকেবারে গায়ে একটা কাঠের বাড়িতে রাত কাটাই। নদী ওখানে উচ্ছলা বালিকার মতোন পাথরে পাথরে জলের নূপুর বাজিয়ে নেচে চলেছে। সে শব্দ বড্ড তীব্র – ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকটাও শোনা যাচ্ছে না – সব শব্দই নদীর শব্দে ঢাকা পড়ে গ্যাছে। সারারাত সেই নদীর নাচের শব্দ শুনতে শুনতেই ভোর হোলো। পরের দিন সোজা হরিদ্বার – অলকানন্দা আর গঙ্গা সেখানে মিলে গ্যাছে। সন্ধেবেলা গঙ্গার পাড়ে বসে আছি। বিস্তীর্ণ নদী নিঃশব্দে বরফ শীতল জল নিয়ে ভয়ানক গতিতে বয়ে চলেছে। নদীর জলে আলোকমালার ছায়াচিত্র কাঁপছে…”
ইতিমধ্যে একজন উত্তর দেশের তিলকধারী গল্পের টানে জুটে গ্যাছেন “গঙ্গামাইয়া কি জয়। হামি ভি উখানে গিয়েছিলাম। উরিব্বাস কীৎনা তেজ নদী লেকিন কোঈ আওয়াজ নেই …. তাজ্জুব”
হাতুড়ে খেই ধরেন “হ্যাঁ চন্দ্রপুরিতে সরু জায়গা দিয়ে অনেক গতিতে জল বয়ে যাচ্ছে– পাথরে জলের বাধা পাওয়ার শব্দ হচ্ছে তাই অতো আওয়াজ আবার হরিদ্বারে নদী অনেক চওড়া– তীব্র গতিতে বাধাহীন নদী বয়ে যাচ্ছে তাই কোনও আওয়াজ নেই। ঠিক তেমনই যতক্ষণ ঐ হাওয়া ভরা কাপড়ের চাপ বেশী থাকে ততক্ষণ স্টেথোস্কোপে আওয়াজ শোনা যায়। যেই মুহূর্তে চাপ কমে গ্যালো আর রক্ত বয়ে যাওয়ার কোনও শব্দ শোনা যায় না”
তিনজন শ্রোতাই বোধহয় ঘটনাটা বোঝেন। তাঁরা বিভিন্ন ভাবে ঘাড় নেড়ে নেড়ে সম্মতি জানান।
“তাই যে যন্ত্র শুনতে পায় না কেবল মাত্র স্পন্দন অনুভব করে সে ঠিকঠাক প্রেসার মাপতে পারবে না। যেটা ঐ ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক প্রেসার যন্ত্রের ত্রুটি”
দশাননবাবু বপু নাড়িয়ে বলেন “বুইতে পারসি”
“না, এটাই সব নয়। অন্যান্য উত্তেজনা থেকে রোগীকে মুক্ত করে তারপর মাপতে হয়। প্রয়োজনে অন্য গল্প করে দু তিন বার (দ্রষ্টব্য:- হঠাৎ করে ব্লাড প্রেসার)।
গোপীনাথজী ওনার দেশওয়ালী ভাষায় বলতে থাকেন “আচ্ছা কোয়াকজী হামার শুগার কা বিমারি আছে। হামি ল্যাব্রেটরিসে যো টেস্ট করাই আর উঙলি ফুটা করে যে টেস্ট করাই দোনো মে আসমান জমিন ফর্ক হয়ে যায়। কৌনওয়ালা সহি হ্যায়?”
হাতুড়ে বলেন “কোথায় পরীক্ষা করান?”
“আরে উও যে মধুবালা মেডিসিন শপ আছে না? আপনি তো চেনেন মোশা …. উখান থেকে বাপি এসে কলেক্ট করে লিয়ে যায়”
“কোন ল্যাবরেটারিতে পরীক্ষা হয়?”
“য়্যো তো জানা নেই কোয়াকজী। লিয়ে যায় ভি রিপোর্ট ভি দিয়ে যায়…”
“ঐ ল্যাবরেটারি আপনি চোখে দেখেছেন?”
“নহি জ্জী বিলকুল নহি। আঁখোসে তো রিপোর্ট দেখিয়েসি ল্যাব্রেটরি তো দেখি নি…”
“তাহলে তো মিথ্যা রিপোর্ট হতে পারে। তাই না?”
গোপীনাথজী গুমরে যান “তো ফির ক্যা করুঁ?”
“এ্যামন ল্যাবরেটারি থেকে করুন যেটা চোখে দেখেছেন”
“ফির ভি উঙলি ওয়ালাসে ফর্ক হোতা হ্যায় । ক্যুঁ?”
বিমলবাবুরও শুগার আছে। উনিও প্রশ্ন করেন “লোকে যে বলে ঐ মিটারটা ভুল রিপোর্ট দ্যায় …”
বিমলবাবুর হাতে চায়ের একটা বড় খুরি। দশাননবাবুর হাতে সিগারেট দেশলাই। সত্যি সবাই এই বুড়ো হাতুড়ের কতো খেয়াল রাখে। বুড়ো চায়ের খুরি বাঁ হাতে আর ডান হাতে সিগারেট নিয়ে বলতে থাকেন “আর্টারির কাজ শরীরের প্রত্যন্ত প্রান্তে খাবার অর্থাৎ গ্লুকোজ পৌঁছে দেওয়া আর ভেইনের কাজ শরীরের খাওয়া হয়ে গেলে সেই খাবারহীন রক্ত ফের হার্টে ফেরৎ নিয়ে যাওয়া। সুতরাং আর্টারির সঙ্গে ভেইনের একটা যোগাযোগ থাকে। যারা যোগাযোগ করে তাদের নাম ক্যাপিলারি। সাধারণ ব্লাড শুগার পরীক্ষায় ভেইন থেকে রক্ত নেওয়া হয় যেখানে শুগারের পরিমাণ খুবই কম কেননা তখন রক্তের গ্লুকোজ ব্যবহৃত হয়ে গেছে। আর গ্লুকোমিটার ক্যাপিলারি থেকে মানে রক্ত জালিকা থেকে রক্ত নিয়ে মাপা হয়। এখানে খাবার অর্থাৎ গ্লুকোজ পুরোপুরি ব্যবহৃত হয়নি। তাই গ্লুকোমিটারে সামান্য একটু বেশী রেজাল্ট দ্যায়– এবং এটা আপনার ডাক্তার বাবু জানেন। চেনা ল্যাবরেটারি না হলে গ্লুকোমিটার অনেক সহজ কম খরচের এবং নির্ভরযোগ্য একটা পরীক্ষা।
দশাননবাবু প্রশ্ন করে “তাইলে পালস অক্সিমিটার যে এ্যাকেক আঙ্গুলে এ্যাকেক রকম রিডিং দ্যায়? সেটা ক্যানো হয়?”
হাতুড়ে হাসেন। মুখোশের আড়ালে সে হাসি দ্যাখা যায় না শুধু শোনা যায়। তারপর বলেন “আবার সেই আর্টারি আর ভেইন আর ক্যাপিলারির গল্প তার সঙ্গে শরীরের তাপমাত্রাও জড়িত। অবশ্যই এটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট ফুল প্রুফ নয় তবু একটা প্রায় নিঁখুৎ রেজাল্ট পাওয়া যায়। আর্টারি রক্তের সঙ্গে অক্সিজেন নিয়ে যায় ক্যাপিলারি মানে জালিকাতন্তু সেটা প্রতিটি কোষে সাপ্লাই করে ভেইন সেই কম অক্সিজেন আর আগের থেকে একটু বেশী কার্বনডাই অক্সাইডওয়ালা রক্ত হার্টে ফেরৎ ন্যায়। সুতরাং যে হাত বেশী কাজ করে শরীর নিজেই সেখানে বেশী রক্ত চলাচলের ব্যবস্থা করে রাখে। তাই সেই হাতে একটু বেশী অক্সিজেন স্যাচুরেশন দ্যাখায়। শুয়ে থাকলে একটু কম হয় – উঠে বসলে একটু বেশীই হয়। তাছাড়া ঐ অঙ্গটা ভীষণ শীতল হলে সেখানে তাপ সংরক্ষণের জন্য শরীর নিজেই শিরা ধমনী সব গুটিয়ে রাখে – ব্লাড প্রেসার খুব কম হলেও রক্ত সরবরাহ কমে যায় – এইসব ক্ষেত্রে অক্সিমিটার কাজ করবে না। তবে ঐ কিনা এগুলো বড্ড প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি….”
বিমলবাবু দোকানে গিয়ে বসেন– খরিদ্দার এসেছে। দশাননবাবু রাম নাম সৎ হৈ বলতে বলতে রাস্তা দ্যাখেন। গোপীনাথজী কানে ভ্রাম্যমাণ ফোন লাগিয়ে বেওসা বাৎ করতে থাকেন। হাতুড়ে খালপাড়ে একটা হলদে ঝুঁটি মোরগটি এবং ওর পেছনে নজরদার কমলা বিড়ালের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে মনোযোগী হয়ে পড়েন। সাইকেল সারানোর দোকানে বোশেখে পাখি উড়্যা গেল ফাগুন মাসে সে ফিরলো না বাজতে থাকে। শত কলরবের মধ্যেও গান বেজেই যেতে থাকে।