আজই পানহাটি সরকারি হাসপাতালের এক ডাক্তারের লেখায় এক ইউএসজি রিপোর্ট আর তার থেকে তৈরি হওয়া অনাসৃষ্টির কথা পড়লাম। কনডোম ক্যাথেটার পরানো রোগীর ইউএসজি রিপোর্ট এসেছে ইউরিনারি ব্লাডারে ক্যাথেটার টিপ দেখা যাচ্ছে না (কনডোম ক্যাথেটারে তা’দেখা যাবার কথাও না) আর তারপরেই সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে যে ফলস প্যাসেজে ক্যাথেটার গেছে(এ’ক্ষেত্রে আদৌ তা’ নয় )। রোগীর বাড়ির লোককে সেই মত জানানোও হয়েছে যে ভুল ভাবে পরানো ক্যাথেটারের জন্য উদ্বেগজনক অবস্থা তৈরি হয়েছে (ইউএসজি করা ডাক্তারের রোগীর বাড়ির লোকের সাথে রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা রীতি নয় যদিও)। বড় গোলোযোগ আর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের হেনস্থা অল্পের জন্য হতে হতে হয়নি।
ইউএসজি সংক্রান্ত আমার নিজের জীবনের কিছু ঘটনা মনে পড়ে গেল।
খড়দায় দেখাতে এলেন একজন মহিলা। পেটব্যথা। ইউএসজি করাতে বললাম। রিপোর্ট এলো গলব্লাডার প্যাংক্রিয়াস কিডনি সব নর্মাল। ওই যেমন গতের রিপোর্ট হয় আর কি!
রোগিনী আমার কাছে রিপোর্টের সবটা শুনে বললেন রিপোর্টটা যেন বিশদভাবে প্রেসক্রিপশনে লিখে দিই।
এ’রকম ক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে বিশদ না লিখে ‘ইউএসজি নর্মাল’ এইটি লেখাই প্রথা। বিশদে লেখার কারণ জিজ্ঞেস করতে আমেরিকা প্রত্যাগত তিনি বললেন, সে’দেশে থাকতে ল্যাপারোস্কোপি করে তাঁর গলব্লাডার বাদ দেওয়া হয়েছে।
সেই তখন ল্যাপারোস্কোপি ও’দেশে সবে শুরু হয়েছে। এ’খানে তখনও পেট কেটে… মানে গলব্লাডার অপারেশন মানেই পেটে মস্ত দাগ। ল্যাপারোস্কোপির সুক্ষ্ম চিহ্ন তা’ও আবার আমবিলিকাস মানে নাভির দাগের সাথে মিলিয়ে কেন না কসমেটিক কারণে বিশেষ করে মহিলা শরীরে দাগ রাখা বারণ, ইউএসজি যিনি করেছেন দেখতেই পাননি সম্ভবত। তারপর যা হয়, তাড়াহুড়োয় ভেবে নিয়েছেন গলব্লাডার ঠিকঠাক রয়েছে, ভাবাটা ভুল যদিও। সেই মত তিনি রিপোর্টেও লিখেছেন।
রোগিণী প্রচণ্ড আইন জানা মহিলা। এ’দেশে এসে তাঁর গলব্লাডার স্বস্থানে আছে জেনে তিনি প্রবল উল্লসিত কম্পেনসেশনের আশায়। হয় ওখানে, ভুল অপারেশনের জন্য নয় এখানে মিস্-ডায়াগনোসিসের জন্য। আদায় করবেনই।
কথায় কথায় জেনেছিলাম আর পাঁচদিন পর তাঁর মার্কিন মুলুকে ফেরার কথা। বিপদ বুঝে আমি এক হপ্তা চেম্বারে ডুব দিলাম। যাতে তিনি আমাকে অন্তত এই কেসে সাক্ষী না মানতে পারেন।
আমার প্রাকটিশ জীবনের গোড়ার আর এক জনের কথা বলি। ইনিও রোগিণী।
অনূঢ়া বছর পঁয়ত্রিশের মহিলা। রক্তশূন্য… সাদা। হাত পা সমেত সারা শরীরই ফোলা। পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখি পেটে বিরাট টিউমার।
আত্মীয়দের বাড়ি আশ্রিতা। ষণ্ডা দেখতে কিছু পরোপকারী যুবক তাকে নিয়ে এসেছে।
তড়িঘড়ি আলট্রাসোনোগ্রাফি করতে পাঠালাম। সদ্য পোস্টগ্রাজুয়েট করা মাথায় বহু মারাত্মক রোগ গজগজ করছে। খানিক বাদে চেম্বারের সামনে সাইকেলের বেল বাজল। মফসসলের ছোট ইউএসজি সেন্টার থেকে লোক এসেছে। সে সন্তর্পনে কানের কাছে মুখ এনে বলল,
ও ডাক্তারবাবু, ও’টা টিউমার কোথায়, স্যার (মানে ইউএসজির ডাক্তারবাবু) তো বলছেন ফিটাস।
কাণ্ড ভাবুন, কোথায় আমার অনভিজ্ঞ মাথায় তামাম কঠিন রোগের লিস্টি আর কোথায় অবিবাহিত মেয়ের প্রেগন্যান্সি, যা বাড়ির লোককে সেই মফসসলে বললে প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারব কি না সন্দেহ।
ইউএসজি করেছেন যিনি, একই বিপদ তাঁরও। অতি কষ্টে দু’জনে মিলে বাড়ির লোককে বোঝানো হল, আমরা ঠিকঠাক বুঝতে পারছি না পেটে কী হয়েছে। তাড়াতাড়ি কলকাতায় নিয়ে যাওয়াই ভালো। বাড়ির লোক পরে জানিয়েছিলেন কলকাতায় অপারেশন হয়েছে। খুব সময়মত খারাপ টিউমার(?) ধরা গেছে বলে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে রোগিনী। একজন আবার জিজ্ঞেস করলেন, হোমিওপ্যাথি ওষুধের জন্য এ’রকমের টিউমার হতে পারে কি না। তিনি নাকি মাঝে মাঝে রোগিনীকে হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিতেন।
বুঝলাম।
কত অভিজ্ঞতাই যে একজীবনে হল।