(এক আধবুড়ো হাতুড়ের ভাষ্য)
চান্স একবারই এসেছিলো জীবনে। হাতুড়ের খুপরির উল্টোবাগের পাড়ার মহিলারা সবাই ওনার রোগী- তাই মহিলা সমিতির বিজয়া সম্মিলনী নামক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমাদের হাতুড়েবুড়ো একবার গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। উদ্বোধনী সঙ্গীত।
শিল্পীদের জন্যে আবার বিরানীর প্যাকেট আছে। ওনার পরে সব বাঘিনী বাঘিনী শিল্পীদের ভিড়। মঞ্চে ওঠার সময় বুড়ো পাড়ার ডাকসাইটে মামীমার সুমিষ্ট কন্ঠ শুনতে পেলেন “একটা গান হলেই বুড়োকে ঘাড় ধরে নামিয়ে দিবি” হাতুড়ে একটা বক্র হাসি হেসে মঞ্চারোহণ করলেন।
তারপর সে এক ইতিহাস- স্বেচ্ছাসেবকদের ভিমড়ি খাইয়ে বুড়ো ননস্টপ গান চালিয়ে গেলেন। এ্যাকটা থেকে অন্য গান – না থেমে। একুশ নম্বর গানের সময় দর্শকাসন ফাঁকা হয়ে গ্যালো। বাকি শিল্পীরা উত্তেজনায় স্থানত্যাগ করেছেন। ক্রুদ্ধ মামীমা এসে হার্মোনি বাজনা সমেত হাতুড়েকে মঞ্চ থেকে টেনে নামালেন। হাতুড়ের কপালে বিরানীর প্যাকেটও জোটে নি। তারপর থেকে মহিলা সমিতির সদস্যবৃন্দ হাতুড়েকে বহুদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বয়কট করেন। এরপর গড়িয়ার পেঁকো খাল দিয়ে বহু ঘোলা জল বয়ে গেছে। করোনা এসেছে– সঙ্গে এসেছে ভয়ঙ্কর মৃত্যুভয়। করোনা ঠ্যাকাতে এসেছে লক ডাউন। সব দোকান বাজার বন্ধ। মাংসাশী বুড়োর রাস্তার ধারের দোকানে মাটনের একটা পিসের দাম পঞ্চাশ টাকায় চড়ে গেছে। তাই বুড়ো আবার অর্থাভাবে স্বদুঃখে খুপরিযাপন শুরু করেছেন।
“এই হাতুড়েবুড়ো- ইম্যুনিটি কারে কয়?”এই প্রশ্ন নিয়ে অবশেষে একদিন হাতুড়ের খুপরিতে মহিলা সমিতির দু’জন কেঁদো কেঁদো সদস্য এসে হাজির হলেন।
হাতুড়ে বসে বসে নাক খুঁটছিলেন। চটজলদি বললেন “যে ক্ষমতাবলে আমাদের শরীর বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে তাহাকে ইম্যুনিটি বলে।”
চমৎকার উত্তর, কিন্তু একজন রাশভারী সদস্যা চশমা নামিয়ে তীব্র অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে হাতুড়ের অন্তরাত্মা শিহরিত করে জিজ্ঞাসিলেন “সেটা আবার কী? মাথায় ঢুকলো না তো.”
দ্বিতীয় জন বললেন “সহজ করে বলুন দেখি …..”
হাতুড়ে নাক চুলকোলেন, টাক চুলকোলেন। তারপর গলা খেঁকরিয়ে বলতে শুরু করেন “সব বলবো কিন্তু ঐ বিজয়া সম্মিলনীর মতো করে আমার কন্ঠস্বর চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা চলবে না”। মঞ্চ থেকে টেনে নামানোর ব্যথা বুড়ো আজও ভোলেননি। বিরানীর প্যাকেটের শোক তো সঙ্গে আছেই। অগত্যা থমথমে মুখে দুই সদস্যা শর্ত মেনে নিলেন।
হাতুড়ে ওনার সুন্দরী পিসিমাকে ডেকে তিনকাপ চা দিতে বললেন। আমরা জানি কোনও এক অজ্ঞাত কারণে হাতুড়ে ওনার বাচ্চা সহকারিনীকে পিসিমা বলে ডাকেন। চায়ে চুমুক আর তত্ত্বালোচনা সমলয়ে চলতে থাকলো।
“আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুই প্রকার। ইন্নেট বা জন্মগত এবং অ্যাকোয়ার্ড বা পরে জোগাড় করা। একটা শিশু যখন মায়ের পেট থেকে এই জীবাণু কিলবিল পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় তখন সমস্ত জীবাণুরা ঐ শিশুকে ধ্বংস করার জন্য হাঁপসিয়ে পড়ে। কিন্তু বেশীরভাগ শিশুই বেঁচে যায়। কেননা ওদের শরীরে একটা ইম্যুনিটি জন্ম থেকেই থাকে। এটাকেই ইন্নেট ইম্যুনিটি বা জন্মগত প্রতিরোধ ক্ষমতা বলা যেতে পারে..”
চশমা চোখে সদস্যা কিছু বলার তোড়জোড় করছিলেন কিন্তু হাতুড়ের চোখের ভাষা পড়ে (যেটা মেয়েরা ভালোই পারেন) থতচকিত থমকদার হলেন।
“এই জন্মগত বা অন্তর্নিহিত ইম্যুনিটি আবার দু ধরনের হয়। নন স্পেসিফিক যেটা মোটামুটি অনেক অনেক সাধারণ রোগের জন্যে কাজ করে। এর জন্যে সাইটোকাইন, নিউট্রোফিল, ব্র্যাডিকাইনিন, হিস্টামিন, ইত্যাদিরা প্রতিরোধের কাজটা করে। আবার কিছু কিছু প্রজাতির মানুষের মধ্যে বিশেষ কিছু রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা রেডিমেড থাকে। সেই সেই প্রজাতির মানুষের ঐ বিশেষ রোগ হবে না – এটা স্পেসিফিক ইম্যুনিটি। এটাকে জন্মগত বা ইন্নেট ইম্যুনিটি বলা হয়। করোনা রোগে এই ইন্নেট বা জন্মগত ইম্যুনিটি উল্টোপাল্টা কাজ করে ফলতঃ ইন্নেট ইম্যুনিটির জন্য প্রয়োজনীয় নিউট্রোফিলগুলো নিজেরাই ক্ষেপে গিয়ে ফুসফুস হৃদয় ইত্যাদির ক্ষতি করে।”
“সবাই যে বলছে ইম্যুনিটি বাড়াতে?” একজন প্রশ্ন করেন।
“তাহলে করোনার ইম্যুনিটি কোথায়?” অন্যজন জানতে চান।
প্রশ্নের ব্লিৎসক্রীগ যুগল সম্মিলনে ভ্যাবাচাকা হাতুড়ে বলেন “এরপরে শিশু যত বড়ো হতে থাকবে তার শরীরে ইম্যুনিটি গজাবে। এটাকে বলে অ্যাকোয়ার্ড ইম্যুনিটি। এটাই আমাদের সাধারণতঃ বিশেষ বিশেষ রোগ থেকে বাঁচায়”।
তণ্বী চশমাহীনা ধরতাই দ্যান “কিন্তু করোনা…!”
“আ মোলো যা এ তো দেখি করোনা করোনা করে ক্ষেপে গ্যাছে। সব আসবে – করোনা, টিবি, পোলিও, টিটেনাস, হাতি, ঘোড়া, সাপ, ব্যাঙ …. সব …শুধু উত্তেজনা করবেন না। আমি ভয়ানক ভীতু মানুষ..” হাতুড়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে একটা বিচ্ছিরি হাসি দ্যান।
“অ্যাকোয়ার্ড ইম্যুনিটি শরীরে কোনও অসুখ ঢুকলে তবেই শরীরের ভেতরে তৈরি হবে। জীবাণুটাকে দেখে দেখে শরীর তার জন্য বিশেষ ধরনের ইমিউনোগ্লোবিউলিন তৈরি করবে এবং পরবর্তী কালে সেই ইমিউনোগ্লোবিউলিন আবার ফের অসুখটা হলে তাকে পিটিয়ে মারবে। এটা দুই রকম হয় একটা হলো অ্যাকটিভ যেটায় শরীরের ভেতরে কিছু অক্ষম অ্যান্টিজেন বা অক্ষম জীবাণুদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয় কিম্বা যখন আপনার শরীরে কোনও অসুখ হয় তখন এক্ষেত্রে শরীর নিজে নিজে ঐ জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এটাতে ইম্যুনিটি তৈরি হতে সময় লাগে। য্যামুন ধরুন টিটেনাস ভ্যাক্সিন। তিনটে ডোজ নিতে হয় এবং ইম্যুনিটি তৈরি হতে প্রায় তিন সপ্তাহ সময় লাগে। আর যদি আপনার ইতিমধ্যেই শরীরে কোথাও কেটে গিয়ে থাকে তাহলে সরাসরি ইমিউনোগ্লোবিউলিন ঢুকিয়ে দিতে হবে যা কিনা সরাসরি লড়াই করবে। এটা খুব ক্ষণস্থায়ী ইম্যুনিটি”।
“ব্যাস হয়ে গ্যালো আপনার সাতকাহন?” চশমাধারিণী ক্ষুব্ধ।
“না না এছাড়া গর্ভাবস্থায় মায়ের রক্ত থেকে প্লাসেন্টা দিয়ে ইমিউনোগ্লোবিউলিন আসে – ওটা শিশুকে প্রায় ছমাস ইম্যুনিটি বজায় থাকে আর আছে মাতৃদুগ্ধ – ওতেও প্রচুর ইম্যুনিটি হয়। বাচ্চা ওতেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পায়”।
“মায়ের দুধে বুঝি ভিটামিন সি আছে? নৈলে ইম্যুনিটি কি করে আসবে?” প্রথমার সরল প্রশ্ন!
দ্বিতীয়া “খিল খিল খিল খিল খিল খিল খিল খিল খিল খিল খিল খিল খিল। (পেটে খিল ধরার উপক্রম) এম্মা তাহলে তাহলে তাহলে তো মায়ের বুকেই দুধ ছানা কেটে যাবে”
প্রথমা যারপরনাই ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন “তাহলে কি আছে?”
ভীত সন্ত্রস্ত হাতুড়ে বলেন “ইমিউনোগ্লোবিউলিন”
দুই মহিলা সমস্বরে হতাশ হন“ এটা আবার কোত্থেকে এলো রে বাবা? ভিটামিন সি নয়, বি নয়, এ নয় ,হলুদ নয়, রসুন নয়, দারচিনির দানা নয়, লবঙ্গের গুঁড়ো নয়, তেজপাতা বাটা নয়– এ তবে কি জিনিস?”
দুজন সুন্দরীর হতশ্বাস ক্রন্দনে হাতুড়ে ম্রিয়মাণ হয়ে বললেন “প্রোটিন। কেবলমাত্র এক ধরনের প্রোটিন। এই ধরনের ইমিউনোগ্লোবিউলিনগুলোই আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। শিশুদের জন্য আইজিএম (ইমিউনোগ্লোবিউলিন এম) বড্ড দরকারি। তাই প্রথম ছমাসে শিশুকে মায়ের দুধ ছাড়া কিচ্ছু দিতে নেই.”
প্রোটিনের কথা তো কোনও কাগজপত্রে লেখে নি। টিভির কোনও সুবক্তারাও বলেনি তো! দুজন মহিলাই বেজায় আশাহত হন।
“তাইলে কি করে ইম্যুনিটি বাড়াবো?” সরল মনে মহিলাদ্বয় সমস্বরে চ্যাঁচান।
“রোগ ঢুকলে শরীর জীবাণুটাকে চিনবে তবে তো ইম্যুনিটি তৈরি হবে। শরীরে প্রোটিন কম না পড়ে এটা খেয়াল রাখতে হবে– শারীরিক কসরৎ করতে হবে। তাতে সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গে রক্ত সরবরাহ ভালো হবে.”
“কালো জিরা লবঙ্গ তুলসী নিমপাতা এতে কিছু হবে না?”
হাতুড়ে প্রবল হাসতে থাকেন। হাসতে হাসতে নিজের ভাঙা চেয়ার থেকে উল্টে পড়েন। “হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে হে” হাতুড়ে হাত্তালি দিয়ে দিয়ে গড়াগড়ি খেয়ে হাসতে থাকেন। “কালোজিরে গোবর গোমূত্র কিস্যুতে কিস্যু হবে না হে হে হে হে হে হে….”
ওনার পিসিমা দরজায় উঁকি মেরে বলে “মরণদশা”।
ভালো লেখা। তবে ভিটামিনের প্রসঙ্গটা আরেকটু আলোচিত হলে ভালো হতো।
ভিটামিন সি-র নামে যে মিথ, এমনকি চিকিৎসকরা পর্যন্ত যেটাতে অনবরত ধুয়ো দিয়ে চলেছেন, সে ব্যাপারে কিছু মন্তব্য থাকলে ভালো হত। আর এখন তো ইমিউনিটি বুস্টার-এর যুগ। দ্বর্থহীন ভাষায় চিকিৎসকদের তরফ থেকে এ বিষয়ে যুক্তিপূর্ণ মতামত উঠে আসা দরকার।
এটা সম্পূর্ণ মীথ । এ বিষয়ে এই পাতায় কিন্তু চার পর্বের একটা লেখা আছে । তাই আমি এটা আর বাড়ালাম না । আর কেউ যদি বলে ভিটামিন ই খেলে অথবা মটরশুঁটি খেলে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে । সেক্ষেত্রে প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্বন্ধে সামান্য একটু আন্দাজ দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই ।
এটি একটি সুপাঠ্য রম্য রচনা। তবে পাঠকের প্রাপ্তি শুধুই পড়ার আনন্দ, সমৃদ্ধ হবার সুযোগ পায়নি।
এটা কেবলমাত্র ইম্যুনিটি সম্বন্ধে একটা অতি গোড়ার কতগুলো কথা । যাঁঁরা গোমূত্র খেয়ে রোগ সারাতে চান ধরে নিচ্ছি তাঁরা ইম্যুনিটি বিষয়টাকে অলৌকিক কিছু ভাবেন । তাই তাঁদের উদ্দেশে এই নিবেদন । শিক্ষিত পাঠক পাঠিকাদের মোহভঙ্গের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী ।