পূর্ববর্তী পর্বের পর……….
বিধাতা পুরুষ না নারী- এক লহমায় দেখিয়া অসিতবাবু তা ঠাহর করিতে পারিলেন না। এত বৎসরের চিকিৎসাবিদ্যা কোনও কাজে আসিল না। বস্তুতঃ ঠাহর করিবার কোনো উপায় বিধাতা রাখেন নাই । পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এড়াইবার জন্যই এই ব্যবস্থা।
বিধাতা অন্তর্যামী। তিনি বুঝিতে পারিয়া বলিলেন, ‘আমি অর্ধনারীশ্বর।’
ইতিমধ্যে এক অতীব সুন্দরী রমণী খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে অকুস্থলে প্রবেশ করিল। তৎক্ষণাৎ, আট হইতে আশি- অকুস্থলে উপস্থিত সকল বয়সের পুরুষগণ অভ্যাসবশতঃ সেই সুন্দরী রমণীর দিকে এমনভাবে চক্ষু ফিরাইল, যেন স্বর্গরাজ্যে দেখিবার যোগ্য আর কিছুই নাই ! তাহার উপযুক্ত কারণও আছে। রমণীটি হইলেন প্রখ্যাত স্বর্গনর্তকী রম্ভা। গত সন্ধ্যায় ইন্দ্রের সভায় নৃত্য পরিবেশনার সময় পা পিছলাইয়া তাঁহার গোড়ালি মচকাইয়াছে। তাঁহার পা ফুলিয়া ঢোল। স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহার পিছনে পিছনে আসিতেছেন।
বিধাতা তাহা দেখিয়া বিরক্ত হইয়া বলিলেন, ‘এ কি পুরন্দর, তোমার কোনো কাজ নাই? স্বর্গশাসন কি ডকে উঠিয়াছে?’
ইন্দ্র অজুহাত দিলেন, ‘অশ্বিনী কুমারদ্বয় ফাঁকি মারিতেছে। স্বর্গের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তাদের টিকিরও দেখা নাই। বস্তুতঃ তাঁহারা আজ মর্ত্যে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে ব্যস্ত। খবর পাইলাম এক চিকিৎসকের আত্মা এইমাত্র স্বর্গদ্বারে আসিয়াছে। তাই চিকিৎসার নিমিত্ত…রম্ভাকে লইয়া আসিলাম আর কি!’
বিধাতা কহিলেন, ‘কেন, রম্ভা একা আসিতে পারিত না? ইহা কি এমন ভয়ানক চোট?’
দেবরাজ একটু থতমত খাইয়া তোতলাইতে লাগিলেন, ‘না, মা-মানে আ-আজ সন্ধ্যায় আবার বিশেষ নৃত্যানুষ্ঠান আছে। তাছাড়া অ-অবলা নারী…’
বিধাতা উত্তরে সন্তুষ্ট তো হইলেনই না। পরন্তু আরো জোরে ধমক দিলেন, ‘হ্যাঁ, আর অমনি অবলা নারী দেখিয়া তোমার নাড়ী জাগ্রত হইয়া উঠিল। তুমি ক্যাচ মারিতে চলিয়া আসিলে! সাধে কি আর মহর্ষি গৌতম তোমার সর্বদেহে সহস্র চক্ষু অঙ্কন করিয়া দিয়াছিলেন!’
ইন্দ্র লজ্জায় আর পালাইবার পথ না পাইয়া ‘ন যযৌ, ন তস্থৌ’ পোজে খাড়া হইয়া রহিলেন।
বিধাতা প্রায় স্বগতোক্তি করিলেন, ‘বেচারা স্বর্গে থাকিবে, না নরকে যাইবে- তাহাই এখনো ঠিক হয় নাই। ফাইল নাকি পাওয়া যাইতেছে না। অপদার্থ চিত্রগুপ্ত! এত খরচ করিয়া এ আই সিস্টেম বসাইয়া কি লাভ হইয়াছে, কে জানে!’
চিত্রগুপ্ত পিছন থেকে বলিলেন, ‘ফাইল পাওয়া গিয়াছে। উনি স্বর্গেই থাকিবেন।’
নিদান শুনিয়া অসিত বরণ কিঞ্চিত আশ্চর্য্য হইলেন। দীর্ঘজীবনে সামান্য কিছু কিছু খুচরো পাপ তো করিয়াছেন !
জয়েন্ট এন্ট্রান্সে সহপাঠী প্রদীপের খাতা দেখিয়া ত্রিকোণমিতির অঙ্কন ও জৈব রসায়নের কয়েকটি বিক্রিয়া টুকিয়াছিলেন। তাহা পরীক্ষকের চোখ এড়াইয়া গেলেও বিধাতার চোখ এড়ানোর কথা নহে।
কলেজে রাজনীতি ও ত্রিকোণ প্রেম জনিত বিস্তর মারপিটে তাঁর নাম জড়াইয়াছিল।
এছাড়া সুন্দরী সহকর্মী এবং নার্সের প্রতি মন বিক্ষিপ্ত হওয়া, অ্যানাস্থেটিস্টকে ছেঁড়া নোট বা কম পেমেন্ট দেওয়া, রোগীর কাছে প্রতিযোগী চিকিৎসকের বিষয়ে মিথ্যা দুর্নাম করা- কোনোটাই ঠিক স্বর্গবাসের উপযুক্ত কর্ম নহে।
তবু তিনি কিভাবে সরাসরি স্বর্গে প্রেরিত হইলেন- এ প্রশ্ন তাঁহার মনে উত্থিত হইতেই বিধাতার বাণীতে উত্তর পাইয়া গেলেন।
‘বৎস, তুমি এত বৎসর ভারতবর্ষে ডাক্তারি করিয়াছ। ইহাতে তোমার সকল পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইয়াছে।’
(ক্রমশঃ)
চিত্র: অন্তর্জাল