সুব্রত হাঁটছে। হাঁটছে না বলে ছুটছে বলাই ভালো। এক কাঁধে ওষুধের ব্যাগ আর এক কাঁধে নিজের জামাকাপড়ের ব্যাগ। ছুটছে এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে।
গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষে সুন্দরবনকে তছনছ করে দিয়েছিল এক সাইক্লোন। তার রিলিফের মেডিক্যাল ক্যাম্পে সারাদিন রুগী দেখে পনেরো-কুড়ি কিলোমিটার দূরে আর একগ্রামে রাতের মধ্যে হেঁটে পৌঁছে যাওয়া। পরদিন সকালে আবার ক্যাম্প। এই ছিল রুটিন। কীসের এই তাড়না । মানুষের পাশে থাকার তাড়না। আর কেন এই তাড়া। সময় যে বড়ো কম।
অবেদন আর ব্যথার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে দুটো বইতে ডা. সুব্রত গোস্বামীর এই তাড়না পরতে পরতে প্রকাশিত। দেখা যাচ্ছে অবেদন-এর লেখক কাঞ্চন মুখোপাধ্যায় এবং অনুপ ধর আর ব্যথার পাহাড় ডিঙ্গিয়-এর লেখক ডা. সুব্রত গোস্বামী আর অনুলেখক হিসেবে নাম আছে পিয়ালী দে বিশ্বাস এবং শুক্লা সরকার-এর। দুটো বইতেই বলা আছে ডা. সুব্রতর সঙ্গে দিনের পর দিন কথা বলে যাবার ফসল এই বই দু-টি। তাই ওঁকে কি বাচীক বলা যায়? জানি না।
প্রথমে আসি অবেদন-এ। অবেদনে ‘অবতরণিকা ‘ও ‘কেন এবং কীভাবে এই বই’ সেই কৈফিয়তের বাদে বারোটি অধ্যায় আছে। প্রত্যেকটি অধ্যায়ের আলাদা আলাদা আকর্ষণীয় ও অনুপ্রাসিত নাম আছে। যেমন ‘গোঁসাই বাড়ির পুত’, ‘ভবঘুরের ভাব বদল ‘, ‘টি বয় থেকে ওটি বয়’ ইত্যাদি।
গুপ্তিপাড়ার সুব্রত। সবুজ মাঠ, উন্মুক্ত আকাশ, প্রবাহিণী গঙ্গা মিলেই সম্ভবত এক শান্ত অথচ আবেগি মন তৈরি করে দেয়। পরম বৈষ্ণবী পিতামহী আর চরম নাস্তিক পিতার মাঝে বড়ো হওয়া সুব্রত জন্ম থেকেই শিখে যায় জীবনে ভারসাম্য রেখে যাওয়ার কাজ। যেটা তার পরবর্তী জীবন দর্শন হয়ে যায়।
জয়েন্টে ভালো র্যাংক করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয় ১৯৮২ সালে গুপ্তিপাড়ার শিক্ষকদের স্নেহের এবং সহপাঠীদের ভালোবাসার সুব্রত। এরকম একজন মানুষ ছাত্র রাজনীতি করবেই। আর সেটা যেন নিয়তি নির্ধারিত। তাই MCDSA বা মেডিকেল কলেজ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন-এ যুক্ত হওয়াটা ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলির বাইরে নিজস্ব ভাবনাচিন্তার গণতান্ত্রিক পরিসর সে এখানেই খুঁজে পেয়েছিল। মানুষে মানুষে সম্পর্ক গড়ে তোলা, সমাজবদলের স্বপ্ন দেখা এই সংগঠনে থেকেই। একসময়ে দখলে থাকা ছাত্র সংসদের জয়ী সদস্য পরবর্তীকালে সংসদ হারালেও MCDSA-র অবিংসবাদী ছাত্র নেতা। ১৯৮৭ সালে ডাক্তার হওয়া। ইতিমধ্যে হাজারো মেডিক্যাল ক্যাম্প। সেটা ঝড়ে বিধ্বস্ত সুন্দরবন বা বন্যার জলে ডোবা মালদা।
কখনো সাধারণ মানুষদের জন্যে ক্লিনিক চালানো আগরপাড়া রানীহাটি বা উখড়া পাণ্ডবেশ্বরে। কলেজে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে কর্মবিরতির নেতৃত্ব দিয়ে সরকারের চরম বিরাগভাজন হওয়া।
কিন্তু কাঠ কাঠ আন্দোলনের নেতা তো কখনো সুব্রতর মতো মানুষ হতে পারে না। তাই একসময়ের শিক্ষক ও সিনিয়র ডাক্তারের হাত ধরে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের সংক্ষেপে CAB-তে ডাক্তার হিসেবে ইডেনে প্রবেশ নব্বই দশকের মাঝামাঝি। পরবর্তীকালে CAB, IFA এবং বেঙ্গল হকি অ্যাসোসিয়েশনে ডাক্তার হিসেবে পরিচিত মুখ। আরও অসংখ্য গল্পকথার মতো অসংখ্য ঘটনা আর তাতে দেখা ও পাশে পাওয়া চরিত্রদের দেখা যাবে বইটাতে।
এরমধ্যে বিবাহ। সহধর্মিণীর সর্বদা উৎসাহ দান। এবং স্বপ্ন এবং বাস্তবের ফারাক মুছে দিয়ে পেইন ইনস্টিটিউট বানানোর অতিমানবিক প্রচেষ্টায় ঝাঁপানো ও সফল হওয়া। সেটা নিয়ে আর একটি বই ব্যথার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে-র কথা বলব একটু পরে।
সুব্রত খুব অসুস্থ। এম এন ডি নামে একটি ভয়ংকর রোগ তার প্রতিটি পেশিকে ধংস করে দিচ্ছে প্রতি মুহুর্তে। চলা ফেরা হাত নাড়া কিছুই সে পারে না। কথা বলাটাও কষ্টকর। শারিরীক শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও কাজ করে গেছে সে। পাশে থেকেছে বন্ধু, কলিগ, অনুজ প্রতীম কলেজের ছেলেদের। এখন শয্যাশায়ী সে। পেয়েছে অখণ্ড অবসর । অতি সক্রিয় মস্তিষ্ক আর সজাগ চোখ কানে নতুন করে সম্পর্ক করছে জানালায় রাখা ফুল গাছটির সঙ্গে, ভেসে আশা পাখির ডাকে। এভাবে শেষ হচ্ছে একটা সুন্দর মনের মানুষের কথাচিত্রণ করা কোথাও যেন চিনচিনে ব্যথার রেশ রেখে যাওয়া বইটি। না এখানেই শেষ নয় পরে আসব সে কথায়।
সমাজে দু-ধরনের মানুষ আছে। এক ধরনের মানুষ মনে করে এই সমাজ ব্যবস্থা ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দিয়ে একেবারে নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুললেই তবে মানুষের মুক্তি। আর এক ধরনের মানুষ আছে যারা মনে করে এই ব্যবস্থার ভেতরে থেকেও অনেক কিছু পরিবর্তন করে মানুষের কাছে সহনশীল একটা সিস্টেম তৈরি করা যায়। সুব্রত দ্বিতীয় পথের পথিক। যুদ্ধ কিন্তু দুটোতেই করতে হয়। সেটা নিয়েই এই বই ব্যথার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে।
মেডিক্যাল পড়ার সময় বিশ্বাস করত হায়ার কোয়ালিফিকেশান না করেও সাধারণ মানুষের উপকারে আসা যায় চিকিৎসার নানা শাখায় দক্ষতা অর্জন করে। তাই এম.বি.বি.এস. পাশ করে সার্জারি, অর্থোপেডিক্স, অ্যানেস্থেশিয়া ইত্যাদি বিষয়ে হাউস স্টাফশিপ করে ডা. সুব্রত।
ইতিমধ্যে পরীক্ষা দিয়ে ই.এস. আই.-তে চাকরিতে ঢোকে। পোস্টিং মানিকতলা। নিজের কোমর ব্যথার অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য ব্যথা বিশেষ করে ক্যান্সারের ব্যথার রুগীদের অসহ্য কষ্ট এবং তৎকালীন চিকিৎসা দিয়ে উপশম না করতে পারার অসহায়তা ভাবাত খুব সংবেদনশীল এই ডাক্তারটিকে। তাই ব্যথা উপশম করাই তার জীবনের লক্ষ্য হয়ে ওঠে। ই এস আই তার আদর্শ ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায় কারণ অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ এখানকার রুগী। আর তার ফলশ্রুতিতে তৈরি হয় ই এস আই শিয়ালদহে ভারতের প্রথম পেইন ইনস্টিটিউট।
এই কাজের লক্ষ্যে রাস্তাটি কিন্তু সুগম ছিলনা। পদে পদে যে বাধা এবং সেই বাধা অতিক্রম করার দলিল হচ্ছে এই বইটি। তাই বইটির নাম বোধহয় বাধার পাহাড় ডিঙ্গিয়েও দেওয়া যেত!
ব্যথাতে ওজোন থেরাপির প্রয়োগ শেখার জন্যে প্রথমে যান দিল্লিতে ডা. দুরেজার ব্যক্তিগত পেইন ইনস্টিটিউটে। ইনিও ম্যানেজমেন্টের বাধায় AIIMS-এর লোভনীয় চাকরি ছেড়েছিলেন। এঁর কাছে কাজ শিখে ফিরে এসে মানিকতলার ই এস আই-তে কাজ শুরু করা। প্রায় চ্যালেঞ্জ নিয়ে এক কোমর ব্যথা রোগীর ওপর ওজোন থেরাপি প্রয়োগ করে সফল হয়ে সুপারের আস্থাভাজন হওয়া।
এরপর অর্থোপেডিক্স ডিপার্টমেন্টের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ওজোন থেরাপির অপরিহার্য সি আর্ম মেশিনটি একা হাতে এবং আক্ষরিক অর্থেই পায়ে চালিয়ে কাজ করা। মেশিন কোনো কারণে খারাপ হয়ে গেলে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষের’ মতো ডা. সুব্রতর ঘাড়ে নেওয়া। অবশেষে শ্রমমন্ত্রীকে ক্যান্সার পেশেন্টের যন্ত্রণার প্রেজেন্টেশন দেখানো এবং উপশমের উপায়ে মেশিনের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে শিয়ালদহ ই এস আই-তে সি আর্ম মেশিন কেনানো একটি ধাপ পেরোনো। পরবর্তীতে রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি জেনারেটর নামক অত্যাধুনিক মেশিন কিনতে গিয়ে আরও লড়তে হয় নাছোড়বান্দা ডাক্তারবাবুকে। তবে এবার লড়াইটা দিল্লি পর্যন্ত নিয়ে যেতে হয়েছিল।
এতো গেল মেশিন কেনার গল্প। মানুষ সুব্রতকে আর কী করতে হচ্ছিল কাজের জায়গায়। ব্যথার অচলায়তন ভেঙে সম্পূর্ণ অজানা বিভাগ পেইন ক্লিনিক তৈরি করতে তাকে রাতে দিনে অমানুষিক পরিশ্রমের ডিউটি করতে হত।
ক্রমশ রুগীর চাপ বাড়তে থাকে শিয়ালদা পেইন ক্লিনিকে এবং অনেকেই পেইনের ট্রেনিং নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে। প্রয়োজন হয়ে পড়ে আরও বড়ো কিছু। রুগীর চাপে এক চিলতে বারান্দা পাওয়া যায় না যেখানে, একটা আস্ত পেইন ইনস্টিটিউট বানানো দিবাস্বপ্ন। আবার লড়াই। শূন্য থেকে শুরু করে ভোজবাজির মতো শিয়ালদহ ই এস আই-এর ছাদে আত্মপ্রকাশ করে পেইন ইনস্টিটিউট। ভারতবর্ষে প্রথম।
ট্রিটমেন্ট, ট্রেনিং এবং গবেষণা চলছে এই ইনস্টিটিউটে। তাদের সার্ভে প্রমাণ করেছে জুটমিল শ্রমিকদের কোমর ব্যথা অকুপেশনাল ডিজিজ বা পেশা সম্পর্কিত রোগ। আজ এস এস কে এম হাসপাতালে পোস্ট ডক্টরেট কোর্স চালু হয়েছে এই ইনস্টিটিউট-এর সিলেবাস নিয়ে। আর জি কর হাসপাতালেও পেইন ক্লিনিক চালু হয়েছিল ডা. সুব্রতর উদ্যোগে।
অনেক ঘটনার ঘাত প্রতিঘাত এবং অবিচল লক্ষ্যে কাজ করে গেলে যে সাফল্য আসে সেই বার্তা পাওয়া যায় ডাক্তার সুব্রত-র এই বইটাতে।
দুটো বইই আরও কিছু জানার প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেয়। অবেদন এর লেখকরা যেহেতু তার কলেজের এবং হস্টেলের অনুজ এবং সাথি তদের কাছে আরও দাবি থাকে। ডা. সুব্রত এক কৌতুক প্রিয় চরিত্র। যেকোনো আপাত সাধারণ ঘটনা মজার মোড়কে উপস্থাপনা করা তার প্রিয় বিষয় ছিল। এরকম কিছু উদাহরণ পেলে ভালো হত। আর চলার পথে যে সমস্ত চরিত্ররা এসেছে তাদের নাম পরিবর্তন না করলেও হত। একটি নাম হচ্ছে একটি চরিত্র, সে নিজের নামে থাকলে আরও কিছু মনে পড়ায়।
ব্যথার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে-র গতি ধরে রাখা হলেও মনে হয় ‘চাওয়া পাওয়া’ চ্যাপ্টারটি আর একটু পরিমার্জন করে সব শেষে এলে ভালো হত।
যখন এই বুক রিভিউ-এর কথা আমাকে জানানো হয় আর আমি যখন সেটা করছি তখন অনেক মানুষের কাছে পৃথিবীটা ঠিক আগের মতো নেই। কারণ এই দু-টি বইয়ের নায়ক আর নেই। সুব্রত গান ভালোবাসত। তার একটা প্রিয় গান ছিল ‘ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে সাথিরে’। সে তার সাথিদের রেখে চিরকালীন একক যাত্রায় চলে গেছে। এখন তার সাথিদের কাজ তার স্বপ্নকে জীবন্ত রাখা।
পুনশ্চ: এটা ঠিক প্রথাগত বুক রিভিউ হল না। কারণ এক অপ্রথাগত মানুষ যার কেন্দ্রে সেই বই-এর আলোচনা সমালোচনা কী করে প্রথাগত হবে। মানব দরদ এবং হাল না ছাড়া মানসিকতাকে উজ্জ্বল করে রাখতে বই দু-টি অবশ্যই পড়া উচিত।