স্বাধীনতা পরবর্তী সর্ববৃহৎ গণআন্দোলন আজ চল্লিশ দিন পেরোলো। মাঝে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিল, ডাক্তারদের কাজে যোগ দেওয়া আশু প্রয়োজন। তারপর হলো বহু-প্রতীক্ষিত মুখ্যমন্ত্রী ও ডাক্তারদের বৈঠক। তারপর একদল মানুষের ধারণা হলো, ডাক্তারদের সমস্ত দাবিই শোনা হয়েছে এবং কিছু আধিকারিকদের পদ থেকে সরানো হয়েছে। এরপর ডাক্তারদের কাজে ফিরে যাওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তবু জুনিয়র ডাক্তারেরা কাজে ফিরতে পিছপা হচ্ছেন। কেন? এর উত্তর শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি নিজেই বলেছেন- ডাক্তারেরা কর্মবিরতিতে আনন্দে নেই, তারা কর্মক্ষেত্রে অসুরক্ষিত বোধ করছে বলেই ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছে।
এই ভয়ের পরিবেশই পরোক্ষে আমাদের অভয়ার ভয়ংকর খুন ও ধর্ষণের জন্য দায়ী- একথা আজ প্রকাশ্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট। শুধু তাই নয়, অভয়ার ঘটনা এরকম বহু ছোট ছোট ঘটনার বীভৎসতম বহিঃপ্রকাশ- এবং এই ভয় ও দুর্নীতির পরিবেশ অব্যাহত থাকলে এরকম ঘটনা দ্বিতীয়বার হবেনা, এই প্রতিশ্রুতি কেউ দিতে পারেনা। যেখানে সর্ষের মধ্যেই ভুতের অবস্থান, সেখানে সিসিটিভি-পুলিশ ইত্যাদি নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারেনা সেটা বলাই বাহুল্য।
অভয়ার ন্যায়বিচারের দাবিতে আমাদের আন্দোলন, পাঁচ দফা দাবি নিয়ে আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম। এর কোনোটাই অন্যের থেকে বৃহত্তর বা ক্ষুদ্রতর এরকম কিছু নয়। অভয়ার হত্যার বিচার তদন্তসাপেক্ষ এবং তার জন্য সময়ের প্রয়োজন- এই দাবি আমরা মেনে নিয়েছি। ঘটনার তথ্যপ্রমাণ বিকৃতির দায়িত্ব নিয়ে অপসারণ হলো স্বাস্থ্য অধিকর্তা, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা ও পুলিশ কমিশনার। যদিও চারজন মানুষের দাবার ঘুঁটির মতো স্থানান্তর এই ব্যাপক আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য কখনোই ছিল না।
অভয়ার মতো ঘটনা ভবিষ্যতে যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় তার জন্য বিভিন্ন কলেজে কর্তৃপক্ষের দাক্ষিণ্যে যে স্বঘোষিত মস্তান বাহিনী গড়ে উঠেছে, তা সমূলে উৎপাটন করা একান্ত প্রয়োজন। বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্টে আপনারা ইতিমধ্যেই জেনেছেন বিভিন্ন কলেজে কিছু দুষ্কৃতী ডাক্তারেরা ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন ভাবে শোষণ করেছে। কলেজ কর্তৃপক্ষের মাথারা নিষ্ক্রিয় থেকেছে, এই ব্যবস্থায় পরোক্ষ মদত জুগিয়েছে। কখনো পরীক্ষায় বসতে না দেওয়ার হুমকি, বসলেও ফেল করিয়ে দেওয়ার হুমকি, কখনো রেজিস্ট্রেশন না দেওয়ার হুমকি, কখনো গবেষণাপত্র আটকে দেওয়ার হুমকি- বিভিন্ন কলেজ থেকে এরকম অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে। অভয়া হত্যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত অভীক দে এবং বিরূপাক্ষ বিশ্বাস মেডিক্যাল কাউন্সিলে তাদের অবৈধ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন কলেজে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, একথা আজ সবার জানা। যে রাজ্যে স্বয়ং কলেজের অধ্যক্ষ ছাত্রীর খুন-ধর্ষণে পরোক্ষ সাহায্য করেন, সেখানে আমরা কীভাবে সুরক্ষিত বোধ করতে পারি!
আজকের দিনে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রছাত্রীদের কোনো গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই তাদের দাবিদাওয়া শোনার জন্য। এই অসহায় ছাত্রছাত্রীরা কলেজের বিভিন্ন আধিকারিকের কাছে ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে- অবশেষে একদিন অভয়ার মতো পরিণতি হয়। তাই এদের দাবি তুলে ধরার জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকা এই সময়ের প্রয়োজন- শুধু তাই নয়, সেই প্রতিনিধিদের কলেজের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাসভায় স্বীকৃতি দেওয়াও দরকার- আজকে স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্নীতির এই বিকৃত রূপ আজ যে বেরিয়ে এসেছে, তার পুনর্বাসনের জন্য আমাদের এই দাবি যথেষ্ট তাৎপর্যবহ।
আমাদের একটা জিনিস ভুলে গেলে চলবে না, অভয়ার হত্যা একটা প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা। এই হত্যায় দায়িত্ব রয়েছে কলেজের, স্বাস্থ্য ভবনের, মেডিক্যাল কাউন্সিলের, স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়, হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড, স্বাস্থ্য দপ্তরের। এদের কারো দায়িত্ব এমনকি পরোক্ষ মদত- কোনোটাই কম নয়। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ব্যতীত এই সংস্কৃতির সংস্কার সম্ভব নয় এবং এই সংস্কার ব্যতীত এই আন্দোলন আমরা শেষ করতে পারিনা।