আমাদের সব কিছুই কেড়ে নেয় ওরা। যেমন করে চে এর ছবি লাগানো টি শার্ট বিক্রি করে ওরা বড়লোক হয়, ঠিক তেমনি করেই আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মহিলা দিবস থেকে ওই “শ্রমজীবী” কথাটা ওরা কেড়ে নিয়ে ওটাকে স্রেফ আন্তর্জাতিক নারী দিবস বানিয়ে দিয়েছে, তাতে ওদের গিফট কার্ড বিক্রি বাড়বে। আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস থেকে ওই “শ্রমজীবী” কথাটা ছেঁটে ফেলার ফলাফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। লোকে দেদার “হ্যাপি উইমেন্স ডে” বলে নিজের মা, বউ, প্রেমিকার ছবি পোস্টাবে আজ। ভাতের থালা আগলে রাখা মা, চুলে বিলি কেটে দেওয়া বউ, সাজগোজ করে সেলফি পাঠানো প্রেমিকাকে কৃতজ্ঞতা ভালোবাসা প্রেম জানাতেই পারেন কেউ, কিন্তু তার ফাঁকে “শ্রমজীবী” কথাটাই কেমন ফুড়ুৎ করে হারিয়ে যায়। শব্দটার সাথে অনেক সংগ্রাম, অনেক রক্ত, ঘাম, অশ্রু বেদনার কাহিনী জড়িয়ে আছে যে।
অন্যান্য দিনের মতো আজও দিনটা যাদের সাথে কাটবে সেই সব সহকর্মীদের সিংহভাগ হলেন শ্রমজীবী মহিলা – এএনএম, জিএনএম, নার্স, আশাকর্মী, অঙ্গনওয়ারী কর্মী। এদের অধিকাংশই মলিন মুখেই দিনটা কাটাবেন। কেউ তাদের পারিশ্রমিক বাড়ানোর দাবিতে চিল্লিয়ে ক্লান্ত, কেউ ন্যায্য প্রমোশনের একটা সুযোগ চেয়ে, কেউ বা আবার চাইল্ড কেয়ার লিভ চাইতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের মুখ ঝামটা শুনে।
এরা তো তাও সংগঠিত শ্রমজীবী। মাস গেলে কিছু একটা হাতে পান। আর যারা অসংগঠিত, তাদের তো কথাই নেই। ইটভাঁটার মহিলা মজুর, যাদের ভাঁটা বন্ধ ছিল করোনা কালে, কিংবা কাজের মাসি, গৃহ পরিচারিকা, যার কাজটাই চলে গেছে, পিএফ নেই, পেনশন নেই তাদের বেলায়? তারা আছে আরো মলিন মুখে।
এদের শ্রমদানটা তাও চোখে দেখা যায়। কিন্তু সেই গর্ভবতী বধুটি? গর্ভাবস্থাতেও যা’র ছুটি মেলে না, সংসারের সব গৃহকাজ মুখ বুঁজে করে যেতে হয়, হাজার হাজার গৃহসমীক্ষায় যারা “আপনি কি করেন?” এই প্রশ্নের উত্তরে জানান যে “তারা কিছুই করেন না, তারা স্রেফ গৃহিণী”। সমাজ তাদের অমনি উত্তর দিতে শিখিয়েছে যে।
যারা ওই শ্রমজীবী শব্দটা ছিনতাই করে নিল তারা আসলে ভুলিয়ে দিতে চায় বিপ্লবী নারীবাদী আন্দোলনের নেত্রী আলেকজান্দ্রা মিখাইলভনা কোলনতাই এর এই কথাটা: “Women’s world is divided, just as is the world of men, into two camps; the interests and aspirations of one group bring it close to the bourgeois class, while the other camp has close connections with the proletariat, and its claims for liberation encompass a full solution to the woman question.” শ্রেণী বিভক্ত সমাজে নারীমুক্তির দাবি আসলে অসাম্য এর বিরুদ্ধে লড়াইতে মিলে মিশে একাকার।
হ্যাপি উইমেন্স ডে তাই একটা নিষ্ঠুর পরিহাস। তাই হ্যাপি বলবো না। আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মহিলা দিবস আসলে তাদের সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মরণ করে আরো দৃঢ় সংকল্প হয়ে দাবি আদায় করার দিন। যেদিন শ্রমজীবী মহিলাদের সব দাবি আদায় হবে, তাদের শ্রম সমাজের চোখে সমান মর্যাদা পাবে, সেদিন বলবো হ্যাপি উইমেন্স ডে। আজ আনহ্যাপি ডে টাই পালন হোক সংগ্রামী চেতনাকে ভোঁতা করে দেওয়ার সমস্ত চক্রান্ত ছিন্ন করে। সংগ্রামী অভিবাদন সমস্ত শ্রমজীবী মহিলাদের।