‘ভয়ে ডাক্তারদের ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ ফোরাম খোলা বন্ধ করে দিয়েছি। প্রতিদিন ছবিসহ কোনো না কোনো চিকিৎসক, নার্স দিদিমণি বা স্বাস্থ্যকর্মীর ‘করোনা শহীদ’ হওয়ার খবর। ‘RIP’-র ঢল। কি মর্মান্তিক rest, কি অসহনীয় peace! নির্মম, অমোঘ সেই বাধ্যতামূলক অকাল বিশ্রামে গিয়ে ওঁরা নিশ্চয় বুঝছেন ‘পাশবালিশ’টি কতটা আরামের বা রোগটা ঠিক কতটা ‘পাতি’!
কর্তারা এবং কর্তাভজারা অবশ্য ‘তিন শতাংশ’ মৃত্যুহারের হরিনাম সংকীর্তন করে চলেছেন। কেউ আবার দেখাচ্ছেন টিবি, কেউ পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার। তার থেকে তো করোনায় মৃত্যু অনেক কম! অনেকটা সেইরকম, যেমন জ্যোতিবাবুর সরকার কথায় কথায় গর্ব করতেন ‘বিহারের থেকে আমাদের এই ভাল, সেই ভাল’ বলে!
এদিকে দেখতে দেখতে এই ‘তিন শতাংশ’এর সংখ্যাটা এই রাজ্যে সরকারীভাবে ১৮০০ ছুঁই ছুঁই। হতভাগ্য এই মানুষরা এক বিরাট মূল্য দিয়ে বুঝতে পেরেছেন যে তাঁরা পুরোপুরি ১০০ শতাংশই মারা যাচ্ছেন – এক শতাংশও বেঁচে থাকছে না পরিজনের জন্য। করোনা সংক্রমণ কোনো স্ট্রোক নয় যে একটা হাত পা অবশ হয়ে গিয়েও লাঠি হাতে অফিস করা যাবে, কিংবা কিছু ক্যানসার নয় যে অঙ্গটি বাদ দিয়ে, কেমো-রে নিয়ে আরও কয়েক বছর বেঁচে থাকা যাবে। এখানে আপনি বেঁচে ফিরলেন তো আপনি সিকন্দর, না বাঁচলে সান্ধ্য সরকারী বুলেটিনে আর একটি সংখ্যা যোগ হল – মাঝামাঝি কিছু নেই। ৯৭ শতাংশের বেঁচে ফেরার হিসেবটা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা মহামারী বিশেষজ্ঞের জ্ঞান বিচ্ছুরণ, টিভির সান্ধ্য আলোচনা বা সরকারী পরিসংখ্যান চর্চার জন্য – আপনার বা আমার individually করোনা হলে বাস্তবে হয় এসপার নাহয় ওসপার – All or None!
মুশকিল হচ্ছে কয়েক কোটি রাজ্যবাসী এই ‘তিন শতাংশ’ টাকে গুরুবাক্য ধরে নিয়ে মাস্ক, দূরত্ব সব উড়িয়ে দিয়ে বাঁধনহারা জীবনযাপনে ফিরে গিয়েছেন। সে নিয়ে আর বলে বা লিখে লাভ নেই। শুধু একটি নিবেদন। বোধহীন, হুজুগে জনগণকে – যাঁরা সমষ্টিগত সংখ্যাতত্ত্ব আর ব্যক্তিগত পরিণামের তফাৎ করতে জানেননা – তাঁদের তিন শতাংশের স্তোকবাক্য শুনিয়ে, রোগটিকে লঘু করে দেখিয়ে, বেপরোয়া হতে পরোক্ষ উস্কানি দেওয়া একটি সামাজিক অপরাধ কিনা আপনারা ভেবে দেখবেন।
আমি বিশেষজ্ঞ নই। লকডাউন করে ‘করোনার মাথায় হাতুড়ি মারা’ কিংবা জটিল mathematical model – এসব বোঝার মত বুদ্ধিশুদ্ধি তো নেই ই। বাস্তবে যা দেখি, তাই হাবিজাবি লিখি। এক সহকর্মী ও আর একজন সহপাঠী- দুজনেই ডাক্তার- সম্প্রতি করোনা আক্রান্ত হয়ে ventilation-এর চৌকাঠ থেকে ফিরে বাড়ি এসেছেন। একজন ITU-তে চারদিন শুয়ে চোখের সামনে চারজনকে ব্যাগবন্দী হয়ে বেরোতে দেখেছেন। আর একজন সর্বোচ্চ পরিমাণ অক্সিজেন নিয়ে, উপুড় হয়ে শুয়ে শ্বাসকষ্টে ভুগতে ভুগতে প্রহর গুনেছেন। ওঁরা একা নন, এরকম আরও কয়েক হাজার আছেন। এঁরা অঙ্কের নিয়মে বহুল বিজ্ঞাপিত ৯৭% এর মধ্যেই পড়েন – কিন্তু ওই অবর্ণনীয় শারীরিক কষ্ট ও মানসিক উৎকণ্ঠা, severe physical and mental morbidity – এর মূল্যায়ন কোন পরিসংখ্যানে পাওয়া যাবে!
কো-মর্বিডিটি ও বয়সের গল্পটিও এরকম অর্ধেক বোঝার কাহিনী। সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী মৃতদের মধ্যে ৮৭% এর কিছু না কিছু কো-মর্বিডিটি ছিল। ষাট বছরের উপরে মৃত্যুহার একলাফে প্রায় তিনগুণ বেশী। কিন্তু, দিনের শেষে সেটা নিছক পরিসংখ্যান। বাস্তবে ৮৮ বছরের ডায়াবিটিক, ৭৫ বছরের COPD রুগী করোনা জিতে বাড়ি ফিরছেন। আবার, ২৫-এর জোয়ান ব্যাঙ্ককর্মী, ৩০-এর তরতাজা ডাক্তার, ৩৫-এর কর্মোদ্যোগী প্রশাসক, ৪০-এর প্রাণবন্ত সিস্টার – চলে যাচ্ছেন কোনো কো-মর্বিডিটি ছাড়াই করোনার ছোবলে। বিশেষজ্ঞের পূর্বাভাসে ভরসা করা যাবে তো?
ইতিমধ্যে হাসপাতাল উপছে পড়তে আরম্ভ করেছে। একমাস ধরে আমাদের হাসপাতালে ৮৫-৯৫% বেড সবসময় ভর্তি। ICCU, ITU-র চাহিদা বাড়ছে দ্রুত, কখনো পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ছে। সরকার হাসপাতাল বাড়াচ্ছেন, বেড বাড়ানো হচ্ছে কলমের খোঁচায়। আবার পরিসংখ্যান।
শেষ কথা বলি। এবারে আমরা ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত। নিজের কর্মক্ষেত্র ছাড়াও দুটি Level 4 (যেখানে গুরুতর করোনা রুগীর চিকিৎসা চলে) করোনা হাসপাতালের সহকর্মীদের খবর জানি, যাঁরা একেবারে প্রথম থেকে করোনা লড়াইয়ে আছেন। প্রায় সবাই মানছেন, ১৭-১৮ সপ্তাহ ধরে ভয়ানক শারীরিক ও তার থেকেও বেশি মানসিক চাপ নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন কাজ করতে করতে এবারে স্নায়ু শিথিল হতে আরম্ভ করছে। (জানি, অনেকেই খবরের কাগজ পড়ে এক সপ্তাহ কাজ আর দু সপ্তাহ কোয়ারান্টাইনের উল্লেখ করবেন। সবিনয়ে বলি, অন্য কোথায় কি হচ্ছে জানিনা, আমি যে দুটি হাসপাতালের খবর রাখি, যেখানে এই ছুটি একটি অলীক বিলাসিতার গল্প, কারণ অত কর্মীই নেই)। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কোনও সহকর্মীর করোনার ছোবলে মৃত্যুসংবাদ আসছে – আদালত যতই গালি দিক, আমরা পেশাদার সৈনিক বা আত্মঘাতী সন্ত্রাসবাদী কোনোটাই নই। সামাজিক অত্যাচার চলছে নিরন্তর। আমাদের এক নার্স সহকর্মী তাঁর বাবার মৃত্যুতে গ্রামে ফিরেও শেষ দেখা দেখতে পারেননি – গ্রামের পাণ্ডারা করোনা হাসপাতালে কাজ করার অপরাধে গ্রামে ঢুকতে দেয়নি। আজ চারমাসের বেশি হয়ে গেল, আমরা, হাসপাতালের চিকিৎসকরা নিজেদের স্পেশালিটি বিষয়ের রুগী দেখতে পাচ্ছি না – শুধু জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, রেফার আর মৃত্যু। করোনা হাসপাতালে পরিণত হবার ফলে অপারেশন থিয়েটার বন্ধ – আরও অন্তত চার পাঁচ মাস পরে বহু যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যাবে, হয়ত সার্জিকাল দক্ষতাতেও ভাঁটা পরবে অনেকের।
কেউ আলো দেখাতে পারেন? জ্ঞানের আলো নয়, মহাপুরুষের বাণী নয়, বিধানসভা – লোকসভার হিসাব নয়, বছর পার করে ভ্যাকসিনের গপ্পো নয়- মহামারীর সুড়ঙ্গের শেষে জীবনের আলো?
দারুন। আমরা হলাম”চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি”। দারুন লেখা। আমি আপনাকে চিনি। “বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞান থাকে না” এটা মানুষের বুঝতেই কয়েক দশক কেটে যাবে। ভালো থাকবেন আর লিখবেন। আমি এর নিয়মিত পাঠক। আপনার সব লেখায় পড়ি।