বিবেকানন্দকে একবার বিধবাবিবাহ ও নারীশিক্ষা নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিলো। বিবেকানন্দ বলেছিলেন উনি বিধবাও নন, নারীও নন, সুতরাং এ বিষয়ে ওনাকে প্রশ্ন করা বৃথা (১৩ ফেব্রুয়ারী মাদ্রাজে প্রদত্ত ‘ভারতীয় জীবনে বেদান্তের কার্যকারিতা’ শীর্ষক বক্তৃতাকালে)।
এটাই ছিলো ধর্মাচ্ছন্ন সাধারণ মানুষের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। ভুল হলো যতক্ষণ না আপন হৃদয়ের পুত্তলীর গায়ে লাগছে ধর্মের তীব্র আঁচ । এই রকম একজন ছিলেন বিক্রমপুরের রাজা রাজবল্লভ রায়; ওনার প্রাণের পুত্তলী যখন বালবিধবা হয়ে একাদশীর দিন নিরম্বু উপবাসে অশ্রুজলে ভাসছে তখন ঈশ্বরের আগেই উনি বিধবা কন্যার বিবাহ দিতে ইচ্ছুক হলেন। বহু পন্ডিত পক্ষে মত দিলেন কিন্তু নবদ্বীপের পন্ডিতরা সহমত হলেন না। বিবাহ পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হলো।
ইতিমধ্যে ঈশ্বর যাচ্ঞা করেছিল নারীশিক্ষার আলোকে নারী ন্যায় অন্যায় বুঝতে শিখুক, নতুবা অশিক্ষার অনন্ত অন্ধকারে নারী পচে মরবে। চালু হলো নারীশিক্ষার বিদ্যালয়। সমগ্র হিন্দু সমাজ কেঁপে উঠলো। ধর্মের আসনে বোধ করি এবার কুলার বাতাস লাগবে। নারীরাই তো আবহমান কাল ধরে ধর্মস্থাপনের ভিত্তি (সেই নিও প্যালিওলিথিক যুগের মাঝামাঝি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ভেঙে চালু হয় পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা)।
ঈশ্বর উন্মাদের মতো মেয়েদের বিদ্যালয় খুলতে লাগলো। সঙ্গে চললো সরকারের কাছে আবেদন, নিবেদন।পুস্তকাদি থেকে কতো আর উপার্জন? চালু হলো স্ত্রীশিক্ষার বিদ্যালয়। অতঃপর ভারতময় সিপাহি বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠলো (১৮৫৭)। সে এক অগ্নিময় কাল; স্বদেশ উত্তাল। ঐ সময় থেকে আমার ঈশ্বর স্ত্রী শিক্ষা আর বাল্যবিবাহ প্রথার বিষয়ে তত্ত্ববোধিনীতে (ইয়াং বেঙ্গল চিন্তার মানুষের পরিচালিত) লিখনী চালু করে। তখন ঈশ্বর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। তার কথা আর যুক্তিবাদী- নিঃস্বার্থ মনোভাবে বহু উচ্চপদস্থ সাহেব মুগ্ধ। তখন ঈশ্বর একত্রিশ।
মূল বিষয়ে ফেরত আসা যাক। প্রথম বালিকা বিদ্যালয় বেথুন সাহেবের নামে। অনাড়ম্বর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেথুন সাহেবের বক্তৃতাটি উল্লেখ্য। শেষ বাক্যটি ছিলো সংস্কৃতে “কন্যাপেব্যং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিযত্নতঃ” (কন্যাকেও যত্নে পালন করো, শিক্ষা দাও-আমার অক্ষম অনুবাদ), আমার ঈশ্বর বেথুন স্কুলের গাড়ির দুই পার্শ্বে বাক্যটি লিখিয়ে নিলো। ঈশ্বর কিন্তু একটিও টোল চতুষ্পাঠি খোলে নি। তখন রমরমিয়ে চলছে সাহেবী ইশকুল সমুদয়। ঈশ্বর পাল্লা দিয়ে খুলে চললো বিদ্যালয়। আধুনিক গণিতের পুস্তক রচনা করালো অপূর্ব সর্বাধিকারী নামক এক ছাত্রকে দিয়ে।জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (বীটন) ছিলেন প্রকৃত বিদ্যানুরাগী। অক্সফোর্ড র্যাংলার। রাজার জাতের মানুষ রইলো কর্মযজ্ঞের সামনে। বেথুন স্কুলের প্রথম একুশ জন ছাত্রীর মধ্যে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের দুই কন্যা ভূবনমালা ও কুন্দমালা অন্যতমা। যথারীতি হিন্দুত্ববাদীরা কলরব তুললো। রসাতলে গেল বুঝি ধরিত্রী। নাটুকে রামনারায়ণ বাবুদিগের মজলিশে বলতে লাগলেন “বাপরে বাপ, মেয়েছেলেকে লেখাপড়া শেখালে কি আর রক্ষা আছে?” (যদিও বহু পরে হলেও সিমোন দে ব্যাভিয়ের ঈশ্বরের সমচিন্তার শরিক এবং একই সনে জাত ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ঈশ্বরের বলার চৌঁত্রিশ বৎসর পরে সংসার এবং ঈশ্বরের বিষয়ে সমমতাবলম্বী)। কেননা অশিক্ষাই ধর্মের ধারক ও বাহক (ধার্মিক হইতে গেলে আপনাদিগকে প্রথমেই গ্রন্থাদি ফেলিয়া দিতে হইবে। বই যত কম পড়েন ততই ভাল। স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ৯৯; অবশ্যই একশত আশি ডিগ্রি বিপরীত মন্তব্যও আছে, এক্ষেত্রে আমরা বিবেকানন্দকে স্ববিরোধী বলতে পারি)। কিন্তু স্ত্রীশিক্ষা এগিয়ে চললো। ডানকুনিস্থিত জনাই বালিকা বিদ্যালয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে প্রবল বর্ষণে বেথুন সাহেব জলসিক্ত হলেন; কিন্তু প্রত্যাগমন না করে বালিকা বিদ্যালয় উদ্বোধন করলেন এবং তৎপরে প্রবল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করলেন। জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বীটনের মৃত্যুতে (১২ই অগাস্ট,১৮৫১) আমাদের ঈশ্বর মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও নারীজাগরণের কাজ এগিয়ে নিয়ে চললো। শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে মুক্তি। ডিগ্রী নয় শিক্ষা। তফাৎটি বড়ই সূক্ষ্ম, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বর ছিলো জ্ঞানতাপস, শিক্ষার পূজারী।
১৮৫৯ সালে ইংরাজ সরকার বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য ঈশ্বরের প্রার্থনা নামঞ্জুর করে’ অর্থবরাদ্দ বন্ধ করে দিলো (সোমপ্রকাশ পত্রিকা ১লা অগাস্ট,১৮৫৯)।
১৮৬৬ সনে মিস মেরি কার্পেন্টার (সমাজ সংস্কারিকা, শিক্ষা উদ্যোগী) এসে এদেশের বিদ্যালয়গুলির অবস্থা পরিদর্শনে ইচ্ছুক হলেন। আমার ঈশ্বর ছিলো সঙ্গে। উত্তরপাড়া বালিকা বিদ্যালয় গেছিলেন। ১৪ই ডিসেম্বর, ১৮৬৬, ঈশ্বরের ঘোড়ার গাড়ি উল্টে গেলো। ঈশ্বরের বুকের ওপর ঘোড়া পা তুলে দাঁড়িয়ে রইলো। কোনও বাঙালি এগিয়ে আসে নি। একজনও না। সহযাত্রী ছিলেন উইড্রো সাহেব এবং অ্যাটাকিনসন সাহেব (শিক্ষা বিভাগের প্রধান); এই দুজন ঘোড়াকে টেনে সরিয়ে না নিলে পথেই ঈশ্বরের মৃত্যু হতো। এই ঘটনায় ধীরাজ কবিয়াল গান বাঁধলো, জনগণ স্ফূর্তি উপভোগ করলো
“অতি লক্ষ্মী বুদ্ধিমতী এক বিবি এসেছে
ষাট বৎসর বয়স তবু বিবাহ না করেছে।।
…..
উত্তরপাড়া স্কুলে যেতে বড়ই রগড় হলো পথে
…..”
এই হলো বাঙালি; আপনার গর্ব হয়না, স্ফূর্তি জাগে না উক্ত রগড়ের কথা ভেবে? ঈশ্বর এরপর চিররুগ্ন হয়ে যায়।যকৃতে অ্যাবসেস হয়, যকৃৎ ছিঁড়ে, পাঁজর ভেঙে ভেতরে পূঁজ জমে এবং এই যকৃতের বেদনাতেই ঈশ্বর বিদায় নেয়।
ঈশ্বর ১৮৫৬ সনের মধ্যে নিকটবর্তী প্রতিটি জিলায় পাঁচটি করে স্কুল স্থাপনে সক্ষম হয়। ১৮৬৮ সনে বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮টিতে । নিজের গ্রামে নিজস্ব ব্যয়ে ভগবতী বিদ্যালয় স্থাপন করে, উইলে ঈশ্বরের পুঁজি থেকে ঐ বিদ্যালয়ের ব্যয়নির্বাহ করার ব্যবস্থা ছিলো (সুপুত্র নারায়ণচন্দ্র সেই বিদ্যালয় বন্ধ করে দেন, যদিও চরিত্রহীনতা দোষের জন্য ঈশ্বর নারায়ণচন্দ্রকে সকল সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছিল। সে অন্য আখ্যান)। সর্বশেষ তৈয়ার হয় মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউট (১৮৭২) ঈশ্বরের স্বপ্নের বিদ্যায়তন (বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে খ্যাত।
ইতি অষ্টম সর্গস্য সমাপ্তিসূচিতম্।
পুনশ্চঃ:-ঈশ্বরের কর্মকান্ডের বিশালতা হেতু কালপঞ্জি বজায় রাখা গেল না। কর্ম ধরে বিভাগ তৈয়ার হলো।