১
পাঠক জানেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সত্যান্বষী’ গল্প- যে গল্পে তিনি ব্যোমকেশ বক্সীকে প্রথম উপস্থাপিত করেন- তাতে অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে একটা ‘ইয়েল লক’-এর কথা আছে। মজা হচ্ছে, এ তালা বন্ধ করতে চাবির প্রয়োজন হয় না। দরজা টেনে দিলে নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। তখন চাবি না থাকলে বাইরে থেকে এই তালা আর কোনোভাবেই খোলা যায় না।
সিস্টেমটা মজার হলেও এর ফাঁদে যে একবার পড়েছে সে জানে এই ইয়েল লক কতটা বিপজ্জনক!
অনেকদিন আগের কথা। আমাদের তখনকার ফ্ল্যাটের মূল দরজায় একটা ইয়েল লক ছিল। এক রবিবার দুপুরে বন্ধুর মেয়ের অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন। ডায়মন্ড হারবারের কাছে সরিষাতে। আমাদের বাড়ি থেকে অনেক দূর, প্রায় উত্তর গোলার্ধ-দক্ষিণ গোলার্ধ। সকাল সকাল তাড়াহুড়ো, হইচই, ঝগড়াঝাঁটি করে শেষ পর্যন্ত রওনা হব। আমরা সবে ফ্ল্যাটের মূল দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি। চাবি এবং আমার একটা ব্যাগ তখনো ভিতরে, দরজার পাশে। ওগুলো নিতে হাত বাড়িয়েছি। এমন সময় হঠাৎ দমকা হাওয়ায় দুম করে দরজাটা সপাটে বন্ধ হয়ে তালাটা নিজে থেকে আটকে গেল। সর্বনাশ, এবার করি কি? চাবি আর ব্যাগ তো ঘরের ভেতরে রয়ে গেছে!
দরোয়ানকে ডাকলাম। সে বলল, কিছু করা যাবে না। ছুতোর মিস্ত্রী ডাকতে হবে। কাছাকাছি কাজ করছিল এক মিস্ত্রী। সে এসে দেখেশুনে বলল, ‘দরজা কাটতে হবে।’
দরোয়ান শুনে বলল, ‘না, এর অন্য সিস্টেম আছে।’
সেই বাড়ির অন্য ফ্ল্যাটেও একই তালা। আর মাঝেমধ্যেই কেউ না কেউ এরকম বিপদে পড়ে। অন্য এক ছুতোর মিস্ত্রী আছে যে এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। সে যেন কিভাবে তালা ভেঙ্গে উদ্ধার করে।
সেই মিস্ত্রীকে খবর দেওয়া হল। সে এল প্রায় দুঘন্টা পরে। তারপর দরজার তালা ভেঙ্গে বের করে নতুন তালা কিনে এনে লাগাতে আরো দু ঘন্টা। নেমন্তন্ন বাড়ি গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন ভাঙ্গা হাট। ক্যাটারারের লোকেরা মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত খাচ্ছে!
২
বৌবাজারে মেডিক্যাল কলেজের হোষ্টেলের দোতলায় আমাদের চারজনের ঘরে একটা উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত নম্বর মেলানো জার্মান তালা (কম্বিনেশন লক) ছিল। সেই তালার নম্বর আমরা বোর্ডার চারজন মাঝে মাঝেই ভুলে যেতাম। তবে তা মনে করানোর দায়িত্ব ছিল অন্যদের। অন্যদের, মানে অন্য রুমের বাসিন্দা, মেসের মালিক, রাঁধুনী, নীচের চায়ের দোকানের লালজী, মিষ্টির দোকানের মালিক, সিগারেটওয়ালা ছোটু, বৌবাজারের ওড়িয়া গুন্ডা বলরাম- সবারই আমাদের ঘরের তালার নম্বর মুখস্থ ছিল। তবু সত্যি বলতে কি, ঘর থেকে কোনোদিন কিছু খোয়া যায় নি।
৩
আমাদের ছোটবেলায় পাড়ায় দত্তকাকু ছিলেন। তিনি সব কিছুতে তালাচাবি দিয়ে রাখতেন। কাউকেই বিশ্বাস করতেন না। সব সময় কোমরে সাতাশ-টা চাবির এক গোছা কোমরে বেঁধে ঘুরতেন তিনি। ঘরের দরজায় দরজায়, এমনকি রান্না ঘরেও তালা। সকাল বেলা রান্নার হিসেব বুঝে চাবি দিয়ে ট্রাঙ্ক খুলে মশলা আর তেল বের করে দিয়ে আবার ট্রাঙ্কে চাবি দিয়ে অফিসে চলে যেতেন তিনি। আর বোকাসোকা জড়সড় কাকিমা ওই মশলা দিয়েই যা পারতেন রান্না করে রাখতেন। দত্তকাকু তাঁর সব টাকা পয়সা চাবি দিয়ে বাড়িতেই রেখে দিতেন। ব্যাঙ্কে রাখতেন না। সে টাকা পয়সার নাগাল পাওয়ার সাধ্য কারো ছিল না। অনেকদিন পরে শুনেছিলাম যে, একদিন দত্তকাকু স্ট্রোক হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু চাবির নাগাল পাওয়া যাওয়া যায় নি বলে টাকাপয়সার হদিশ কাকীমা পান নি। আর কাকুর চিকিৎসাও করা যায় নি।
৪
চাবি নিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা ডাক্তারদের কিছু কম নয়। এক অর্থোপেডিক সার্জেন অনেক রাতে অপারেশন করে বাড়ি ফিরছেন। বাড়ি মানে ফ্ল্যাটবাড়ি। সেদিন ডাক্তারবাবু বাড়িতে একা। তাঁর স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি গেছেন। অনেক রাত হয়েছে। কাজকর্মের শেষে ডাক্তারবাবু ক্লান্ত, অবসন্ন। ঘরে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়বেন এমন ইচ্ছে।
মাঝরাতে বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করে আবিষ্কার করলেন যে ফ্ল্যাটের চাবি সঙ্গে থাকলেও বাড়ির মেন গেটের চাবি ঘরেই রয়ে গেছে। ঘরে কেউ নেই। ছোট ফ্ল্যাট। দরোয়ান বা নিরাপত্তাকর্মী নেই যে ডাকলে মেন গেট খুলে দেবে। যার যার নিজস্ব চাবি দিয়ে মেন গেট খুলে ঢুকতে হয়। রোজ তাই করেন। কিন্তু আজ চাবি ভুলে ফেলে এসেছেন। এখন এত রাতে আর কাকে পাবেন! প্রতিবেশীরা সব গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই আর উপায়ান্তর না দেখে ক্লান্ত শরীরে মোটা ভুঁড়ি নিয়ে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে পাঁচিল টপকে নিজে বাড়িতে ঢুকতে গেলেন।
মাঝরাতে আর সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও পাড়ার মৈথিলী দারোয়ান জেগে ছিল। সে শব্দ পেয়ে গোলমাল আন্দাজ করে বাঁশি বাজিয়ে ছুটে এল। ‘হেই, কৌন হ্যায়? কৌন হ্যায়? চোর চোর।’
তারপর যেই না সে পাঁচ ব্যাটারীর টর্চের আলো ফেলল ডাক্তারবাবুর মুখে, অমনি চমকে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে ডাগদার সাব? আপ? হায় রাম, হায় হনুমানজী। তওবা তওবা…..
হনুমানজীর কৃপায় ডাক্তারবাবু সেদিন নিজের ঘরে ঢুকতে পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত।
৫
‘হাম তুম এক কামরে মে বন্ধ হো, আউর চাবি খো যায়ে…..’
সত্তর-আশির দশকে যৌবন কাটিয়েছেন আর এই রোম্যান্টিক গানের পংক্তি গুলো নিজের জীবনে অন্ততঃ একবার ঘটুক -এটা মনে মনে এমন কল্পনা করেন নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কিন্তু চাইলেই কি আর হয়? বরং উল্টোটাও হতে পারে।
মিউনিখে ফেলোশিপ করি। সপ্তাহান্তে বাসে করে বার্লিন বেড়াতে গেছি। বার্লিন ঘুরতে ঘুরতে কৌশিক নামে ফিনল্যান্ডবাসী এক মারাঠি যুবকের সাথে আলাপ হল। সারাদিন দুজনে বার্লিন ওয়াল, রাইখষ্ট্যাগ, ব্রান্ডেনবুর্গ গেট, অলটেস মিউজিয়াম, হলোকাষ্ট মিউজিয়াম ইত্যাদি দেখে সন্ধ্যায় দুজনে নিজের নিজের রাস্তা দেখলাম। ছেলেটি আমার হাতে একটা পিলসনার বিয়ার ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘গুডনাইট, আবার দেখা হবে।’
সারাদিন যা হোক একটা সঙ্গী ছিল। এবার একেবারে একা। রাত ন’টা বাজে। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। অচেনা দেশের অজানা শহর। বার্লিনের লোকেরা তবু একটু আধটু ইংরেজি বোঝে। কিন্তু রাস্তায় প্রায় কোনো লোকই নেই, কাকে রাস্তা জিজ্ঞেস করব? গুগল ম্যাপ দেখে দেখে চলেছি। জায়গাটা বার্লিনের বিখ্যাত শার্লটেনবার্গ এলাকায়। বেশ পশ এলাকা। বইতে পড়েছি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বার্লিনে এসে প্রথমে এই এলাকায় থাকতেন।
একটা তুর্কী রেস্তোরাঁয় ডোনার কাবাব দিয়ে ডিনার সেরে রাতের আস্তানায় গিয়ে পৌঁছলাম তখন রাত দশটা। আস্তানাটা ঠিক হোটেল না। একটা অষ্ট্রিয়ান গেষ্ট হাউস গোছের। অনলাইনে আগে থেকে বুক করা। তবে তাতে লেখা ছিল রাত ন’টায় মেন গেট বন্ধ হয়ে যাবে। তখন দশটা পার হয়ে গেছে!
রাত নটা থেকে দশটা নীচের সিরিয়ান রেস্তোরাঁয় চাবিটা থাকার কথা। সিরিয়ান লোকটা নানা আগডুম বাগডুম কথার পরে জানালো যে, চাবিটা সে একতলার সিঁড়ির নীচে লেটার বক্সে ফেলে দিয়ে এসেছে।
রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে বাড়ির সামনের দিকে গিয়ে দেখি বন্ধ মেন গেটের নীচে সিঁড়িতে একটা লোক বসে আছে। কাছে যেতেই বুঝলাম লোকটা চেনা। সকালের সেই মারাঠি যুবক কৌশিক! হতভাগা তার মানে এখানেই বুক করেছে এবং আমার মতই ঘরে ঢুকতে পারছে না।
সে বলল, ‘মারিয়া-কে ফোন করেছ?’
‘কে মারিয়া?’
‘এই পেনশনিয়ারের (গেষ্ট হাউস) ম্যানেজার। ওয়েব সাইটেই তো নম্বর দেওয়া ছিল।’
‘করছি।’
‘লাভ নেই।’
‘কেন?’
‘করলেই বলছে লেটার বক্স। আর বলছে কি – আকতুনদার জেকজুনজিকজিক। কিছুই বুঝতে পারছি না।’
আমি ফোন করলাম এবং আমার স্বল্পলব্ধ জার্মান ভাষার জ্ঞান পুঁজি করে বললাম, ‘ওটা আখটুনডারট জেক্সউনড জেগজিগ- মানে আটশ’ ছেষট্টি।’
লেটার বক্সে আট ছয় ছয় টিপতেই সেটা খুলে গিয়ে তার ভেতর থেকে এক আট ইঞ্চি লম্বা পেতলের অদ্ভুত দর্শন চাবি বেরোল, যার ওজন অন্ততঃ আধ পাউন্ড।
সেই চাবি দরজার ফুটোয় কিছুতে লাগে না। অনেকক্ষন কসরতের পরে যদি বা ঢুকল তো তালা কিছুতেই খোলে না। দুজনে ঝাড়া আধ ঘন্টা লড়াই করার পরে যখন হাল ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম- তালার তলায় কোনভাবে হাতের চাপ পড়ে হঠাৎ তালাটা খুলে গেল।
আমরা দুজন বিজয় গর্বে দোতলায় উঠে দেখি এক সোনালী চুলের সুন্দরী রিসেপশন টেবিলের উল্টোদিকে নির্বিকার মুখে বসে। হাত বাড়িয়ে আমাদের দুজনের বুকিংয়ের কাগজ নিয়ে ঘরের চাবি দিল। ওর মাথার কাছে সিসিটিভির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম- কিছুক্ষন আগে আমাদের নাজেহাল অবস্থাটা এইখানে বসে বসে সিনেমা দেখার মত উপভোগ করেছে।
বললাম, ‘এখানেই তো বসে ছিলে, নীচে গিয়ে চাবিটা দিয়ে এলে না কেন?’
‘ওটা আমার কাজ না।’
‘আচ্ছা।’
জার্মানরা সাধারণতঃ রোবটের মত হয়। কিন্তু রোবটকে শায়েস্তা করতে আমরাও জানি।
পরদিন বেরোনোর সময় রিসেপশনে কেউ নেই। মেন গেটের চাবিটা লেটার বক্সে ফেলে যাওয়ার কথা। কৌশিক ইঞ্জিনিয়ার। সে চাবিটা ফেলার আগে খুটখাট করে লেটার বক্সের কম্বিনেশন তালার নম্বর দিল পাল্টে। তারপর সে এয়ারপোর্টের রাস্তা ধরল। আর আমিও বেরিয়ে পড়লাম সকালের বার্লিন ঘুরতে।
৬
চাবি দিয়ে কি আর কাউকে আটকে রাখা যায়! শুনেছি কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে কে জীবনের শেষ কয়েকটা দিন ব্যাঙ্গালোরের বাড়িতে তালাচাবি দিয়ে আটকে রাখা হত। তিনি না পারতেন ঘর থেকে বেরোতে, না পারতেন কারো সঙ্গে কথা বলতে। কলকাতা থেকে তাঁর অনুজ শিল্পী, কম্পোজাররা বন্ধ তালার বাইরে থেকে তাঁকে দেখে চোখ মুছে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন অনেক বার।
অত কিংবদন্তী না হলেও অনেক দাপুটে মানুষকেই শেষ জীবনে ঘরে অসুস্থ অবস্থায় তালাচাবি বন্ধ করে ফেলে রাখা হয়েছে। প্রাক্তন পরিচিত, ছাত্র বা শুভানুধ্যায়ীদের উদ্যোগে হাসপাতালে ভর্তি, চিকিৎসা। তারপর হাসপাতাল, কেয়ার হোম, বাড়ি, হাসপাতাল- এই চক্করে ঘুরতে ঘুরতে একসময় অনন্তযাত্রা।
এই তো জীবন !