লক ডাউন আর করোনাজনিত কারণে হাতুড়ের বহুদিন নিতাই কেশকর্তন মন্দিরে যাওয়া হয় নি। ইতিউতি গোঁফ দাড়ি আর সুদীর্ঘ কিছু গুচ্ছ চুলে চেহারাটা দিব্য খোলতাই হয়েছে। গড়িয়ার পেঁকো মশক অধ্যুষিত খালপাড়ে শরতের ঝাপসা বিকেলে উনি বাল্যস্মৃতি কন্ডুয়নে ব্যস্ত ছিলেন। শারদীয় বিকেলে কতো উলোঝুলো বালিকা ওনার স্মৃতিপথে যে আনাগোনা করলো, ইশকুলের কতো রকমের বীভঙ্কর সব শাস্তির স্মৃতিতে যে বিচ্ছিন্ন সব দাড়ি গোঁফ বিদ্যুৎ স্পর্শে যেন খাড়া খাড়া হয়ে উঠলো তা বলার নয়। এমৎসময়ে পেছনে মিহি কন্ঠে ডাক শোনা গেলো “হাতুড়েদাদা ও হাতুড়েদাদা”
গলাটা সত্যজিতের বঙ্কুবাবুর বন্ধূক্ত ভিনগ্রহের অ্যাংয়ের মতোন মিহি, বলা যায় প্রায় ভৌতিক।
হাতুড়ে বাবলা কাঁটার খোঁচা খাওয়ার মতো (বাবলা কাঁটা ফুটলে ভয়ানক বেদনা হয়) তিড়িং লাফ দিয়ে বললেন “কে হে বাপু তুমি?”
ঘুরে দেখেন মুরগি বেচা সূদন। লক ডাউনেও চেহারাটা বেশ ফুলটুসি গোল্লু হয়ে গেছে।
“ইকিরে বাপু, পেছন থেকে হঠাৎ করে এমন মিহি সুরে ডাকছো কেন? আরেকটু হলেই তো আমি ভয়ের চোটে ভির্মি খেতাম…”
উনি আবার ওনার বসার ইঁটের পাঁজার ওপরে বসে পড়লেন।
সূদন বহু কষ্টে ওর নিজের ডান পা’টা দুহাতে করে টেনে ওনার মুখের সামনে তুলে ধরে টাল সামলাতে না পেরে নিজেই হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেলো। আরেকটু হলেই গড়িয়ে পচা খালের কাদায় ডুবে যেতো। হাতুড়ে অগত্যা ওর ঊর্ধ্বমুখী ঠ্যাং ধরে ফের ভূমিষ্ঠ করলেন।
দম-টম নিয়ে হাতুড়ে বললেন “বাছাধন, এবার বলো দেখি ভর সন্ধেবেলা পেছন থেকে মিহিসুরে চিৎকার করে, মুখের সামনে ঠ্যাং তুলে ধড়ফড়িয়ে কুমড়োগড়ান গড়ানোর মানেটা কী?”
সূদন জানালো ও নিতান্তই গোবেচারা মুরগি ও মোরগ বিক্রেতা, পা ফুলে গেছে তাই হাতুড়েদাদাকে দেখাতে এসেছে। এবং ও ওর সাধ্যমতো মিষ্টি সুরেই ডেকেছে, হাতুড়েকে ভয় দেখানোর ওর কোনও দুরভিসন্ধি ছিলো না।
হাতুড়ের চিরকালই রহস্যভেদী গোয়েন্দা হওয়ার ইচ্ছে। এই ধরণের রহস্যময় সমস্যা সমাধান করতে ভালবাসেন। বসলেন, বিড়ি ধরিয়ে (ধূমপান হাতুড়ে ছাড়া বাকি সকলের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর) গোটা কয়েক ইঁটের ওপর। খালপাড়ের রাস্তা দিয়ে আরও দুটো আবছা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। জয়ন্ত শেঠি, ল্যাবরেটরির রক্তচোষা- তার হাত ধরে একটা রোগা সাত আট বছরের মেয়ে, গোটা গায়ে খোশ প্যাঁচড়া, মুখ হাত পা ফোলা। সে’ও এসে বসলো হাতুড়ের চারপাশে।
হাতুড়ে এখন সরলাক্ষ হোম (শার্লক হোমসের পরশুরামকৃত বঙ্গীয় অবধূত)।দাঁতে বিড়ি চেপে প্রশ্ন করলেন “কতদিন যাবৎ ফোলাটা লক্ষ্য করছেন?”
উভয়ের সমবেত উত্তর “চার পাঁচ দিন”
“পেচ্ছাপ কী রংয়ের হচ্ছে?”
সূদন বললো “লালচে”
মেয়েটা চুপ করে রইলো। জয়ন্তবাবু বললো “বল না, কী রংয়ের হচ্ছে”
মেয়েটা অধোমুখে বললো “লালচে… কি রকম যেন”
হাতুড়ে বললেন “বাচ্চাটার তো দেখাই যাচ্ছে গোটা গায়ে প্যাঁচড়া (impetigo), সূদন তোমার কিছু অসুখ হয়েছিল? গত কয়েক দিনের মধ্যে?”
সূদন জানালো “দিন কতক আগে রেতে বাসে করে মেদিনীপুর থেকে ফিরছিলাম, বাসে জানালার ঠান্ডা বাতাস লেগে খুব গলায় ব্যথা হয়েছিল (রোগীরা সাধারণতঃ সব রোগের একটা চটজলদি কারণ খাড়া করে ফ্যালে, হাতুড়ে অবশ্য সেসবে বিশেষ কান দ্যান না)”
চিন্তিত বদনে উনি বলেন “হুমমম, দেখা যাচ্ছে দুজনেরই কিছুদিন আগে থেকে ইনফেকশন রয়েছে…..তাহলে এটা পিএসজিএন …অর্থাৎ পোস্ট স্ট্রেপ্টোকক্কাল গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস”
তিন জন দারিদ্র্যের নিচের দিকে থাকা মানুষ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো।
হাতুড়ে কোমল স্বরে বললেন “শরীরে কোথাও স্ট্রেপ্টোকক্কাস পায়োজেনস জীবাণু দিয়ে ইনফেকশন হলে তখন আমাদের শরীরে এর বিরুদ্ধে লড়তে একটা প্রোটিন তৈরি হয়, ইমিনোগ্লোবিউলিন। যেই মাত্র এই প্রোটিন কিডনিতে পৌঁছয় তখনই ভয় পেয়ে কিডনি এটার থেকে বাঁচার জন্য নিজের ছাঁকনিতে একটা দেওয়াল তৈরি করে, অথবা এই প্রোটিন নিজেই কিডনির ছাঁকনিতে পুরু হয়ে জমে ছাঁকনিটা নষ্ট করে দ্যায়।”
“এটা ঠেকানো যায় না?” জয়ন্তবাবুর প্রশ্ন।
“একবার ইনফেকশন ঢুকে গেলে আর উপায় নেই। এর কোনও ভ্যাক্সিন নেই। সাধারণতঃ অপরিস্কার জায়গায় থাকলে বা ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা কম হলেই এটা হয়”
“এটা সারে?” জয়ন্তবাবু আর সূদন দুজনেই প্রশ্ন করে’ ওঠে।
“হ্যাঁ। সাধারণতঃ সেরে যায়। তবে দেখা যাচ্ছে যাদের এটা হয়েছে তাদের মধ্যে ক্রনিক বা চিরকালীন কিডনি খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশী” হাতুড়ে বিড়ি আর দিয়াশলাই বার করেন।
দাঁতে বিড়ি কামড়ে ধরে বলতে থাকেন “প্রতি বছর পৃথিবীতে চার লক্ষ বাহাত্তর হাজার মানুষ- এদের মধ্যে বাচ্চাই বেশী-এই রোগে ভোগে, এরমধ্যে পাঁচ হাজার মানুষ আর বাঁচে না… এই রোগে প্রেসার বাড়ে, পেচ্ছাপের পরিমাণ কমে যায়, পেচ্ছাপে রক্ত আর প্রোটিন বেরোতে থাকে। এই যেসব কথা বলছি সেগুলো কেবলমাত্র যারা হাসপাতালে এসেছিল, যারা পরীক্ষা করিয়েছিল- তাদের কথা। হাসপাতালে একটা পরীক্ষার তারিখ দ্যায় এক মাস….এক মাস পরে। ততদিনে রুগী চলে যায় অন্য কোথাও। দূর গাঁয়ের গরীব ক্ষেত মজুর শহরে এসে পৌঁছয় না- বাচ্চাটা মেয়ে হলে… হয়তো দেখাতেই আসে না…..কতো মৃত্যুই তো হিসেবের বাইরে… দু হাজার কুড়ি সালের মে মাসে….কেবলমাত্র মে মাসে শুধু রাজস্থানে সাতচল্লিশ হাজার মানুষ অজানা জ্বর আর শ্বাসকষ্টে মারা গেছে…..গোটা ভারতে সম্ভবতঃ বাড়তি দুই লক্ষ। গরীব মানুষ আবার মানুষ নাকি? গ্রামের মানুষ তো খবরেরও বাইরে। যাও দুজনেরই ইউরিন রুটিন পরীক্ষা করাও।জয়ন্তবাবু নিজে যেখানে কাজ করে সেখানেই করাও। তারপর দেখা যাক”
।এরা গোধূলির রাস্তা ধরে ফিরতে থাকে। বৃদ্ধ পাগল হাতুড়ে দেখতে পান ওদের পেছনে পেছনে অনেক অনেক মানুষ- ছায়ার মতো- নিঃশব্দ মৌনমিছিলের মতো, কাঁধে কাঁখে তাদের বাচ্চা।সবাই চলেছে পেচ্ছাপ পরীক্ষা করতে। হাতুড়ে স্তব্ধ বসে থাকেন।বেঁচে থাকো দরিদ্র ভারতের দরিদ্র শিশুরা। অন্ধকারও যবনিকা নামায়।
কত সহজ করে লেখা যায়। আপনার লেখা না পড়লে হয়ত বুঝতেই পারতাম না।